বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১১

২। সিদ্ধান্ত-সূত্র (Premiss)

এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা আছেন কি নেই- এ প্রশ্নের বিচার করার আগে প্রথমেই বোলে নেই যে, প্রমাণ বোলতে চাক্ষুস প্রমাণ বোঝালে তা নেই এবং তা থাকতেও পারে না । তিনি যদি থেকে থাকেন তবে কোনদিন তিনি এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন নি যে- এই যে আমি তোমাদের স্রষ্টা এবং নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কোনদিন তা দাঁড়াবেন না । কারণ, তাহলে মানুষ নামের এই বিশেষ সৃষ্টিটি অর্থহীন হোয়ে যেতো, আমরা গাছ-পাথর, হাতী-ঘোড়ার মত শুধু আরেকটি সৃষ্টি হোয়ে যেতাম । দ্বিতীয়তঃ আমাদের বিশ্বাস জন্মানই যদি কথা হোয়ে থাকে তবেও তাকে নিজে দেখা দিয়ে চাক্ষুস প্রমাণ দেয়ার দরকার নেই । কারণ তিনি সর্বশক্তিমান স্রষ্টা হোয়ে থাকলে তিনি ইচ্ছা কোরলেই তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এই মুহূর্তে তাকে না দেখেই বিশ্বাস কোরবে (কোরান- সূরা আল আ'নাম ৩৫, সূরা ইউনুস ৯৯, সূরা আন নহল ৯)’। তাকে সামনে এসে দাঁড়াবার প্রয়োজনই হবে না । এতে প্রমাণ হোচ্ছে যে স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন তবে তিনি নিজে দেখা দিয়ে বা ইচ্ছে কোরে আমাদের মনে তার অস্তিত্বের বিশ্বাস এনে দিতে চান না । তিনি দেখতে চান তিনি যে একটি মাত্র সৃষ্টিকে বুদ্ধি, যুক্তির শক্তি, উপলব্ধির শক্তি (Intellect, Reason, Rationality) দিয়ে সৃষ্টি কোরলেন সেটা অর্থাৎ মানুষ তার ঐ শক্তিগুলি দিয়ে, চাক্ষুস নয়, তাকে উপলব্ধি করে কি করে না । এ জন্য তিনি লক্ষ রকমের চিহ্ন, যুক্তি দিয়েছেন । মানুষকে এ কথা, এ যুক্তি বোঝার শক্তি (Inference) দিয়েছেন যে ধোয়া থাকলেই আগুন থাকবে । এখন আমাদের দেখতে হবে ধোয়া অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্বের এই ধরনের প্রমাণ আছে কিনা ।

আরেকটি কথা- স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা কোরতে গেলে বইয়ের পর বই লেখার প্রয়োজন হোয়ে পড়বে- আমার উদ্দেশ্যও তা নয় । আমি শুধু মৌলিক দু'একটি কারণ ও যুক্তি এখানে উল্লেখ করবো যা উন্মুক্ত মনের মানুষের কাছে যথেষ্ট । এতে যাদের প্রত্যয়ের উন্মেষ হবে না, হাজার বই লিখেও, লক্ষ যুক্তি দিয়েও তাদের বোঝান যাবে না ।

প্রথমতঃ যুক্তির গোড়ার কথায় যদি যাই- অর্থাৎ ধোয়া থাকলে আগুন থাকতেই হবে তবে যেহেতু সৃষ্টি আছে কাজেই স্রষ্টা অনিবার্য । তবুও এ প্রশ্নে আরও এগুনো যাক এবং স্বভাবতঃই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এগুতে হবে । মহা বিশ্বের (Universe) সৃষ্টি কেমন কোরে হোয়েছে সে সম্বন্ধে মানুষ আজও অজ্ঞ- যদিও প্রচণ্ড বিস্ফোরণ (Big Bang), স্থিতাবস্থা (Steady State), স্পন্দনশীল (Oscillating) ইত্যাদি বিজ্ঞানীদের কয়েকটি ধারণা (Theory) আছে । কিন্ত আজও কোনটাই প্রমাণিত হয়নি এবং বিজ্ঞানীরা নিজেরাই একমত নন । কিন্তু মতবিরোধ যাই থাকুক একটা কথা অনস্বীকার্য্য, এরং তারাই স্বীকার কোরেছেন যে গোড়ার কথায় গেলে এই মহা বিশ্ব সৃষ্টির মাত্র দু'টি সম্ভাবনা আছে । যেহেতু সৃষ্টি হোয়েছে এবং আছে সুতরাং ঐ দু'টি সম্ভাবনার মধ্যে একটি অবশ্য (Must) হোতেই হবে- তৃতীয় কোন সম্ভাবনাই নেই । এই দু'টির একটি হোল - এই বিশাল সৃষ্টি নিজে থেকেই আচম্বিতে হোয়ে গেছে (Accidental), দ্বিতীয়টি পরিকল্পিত (Planned)।

প্রথমে দেখা যাক আচম্বিতের ধারণা । এই থিওরী মতে মহাশুন্য [মহাশুন্য (Space) কি তা কিন্তু তারা বিশ্লেষণ কোরতে পারেন না] শুধু গ্যাস (Gas) আর ধুলিকণা (Dust) দিয়ে পূর্ণ ছিলো । এই গ্যাস আর ধুলিকণা কোথা থেকে এলো এ কথার তারা কোন উত্তর দিতে পারেন না- শুধু বলেন এগুলো আগে থেকেই ছিলো । তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম ওগুলো আগে থেকেই ছিলো- যদিও স্রষ্টা ছাড়া ওগুলোর সৃষ্টি কেমন কোরে এ প্রশ্ন থেকেই যায় । যাই হোক, এখান থেকেই, অর্থাৎ এই উপাদান থেকেই মহা-বিশ্বের সৃষ্টি আরম্ভ এবং ক্রমে ক্রমে কোটি কোটি, অর্বুদ অর্বুদ বছর ধরে নানা রকম আচম্বিত ঘটনার (Accidents), মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্য্যায়ে এসে পৌঁছেছে । কেমন কোরে কি কি ঘটনার মধ্য দিয়ে এখানে পৌঁছলাম তা নিয়ে বহু মতবিরোধ রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে । এই আচম্বিতের থিউরী মতে অর্বুদ অর্বুদ বছর আগে থেকে আজ পর্য্যন্ত সৃষ্টিতে যা কিছু হোয়ে আসছে তাতে কোন পরিকল্পনা (Plan) নেই- কারণ স্রষ্টাই তো নেই- সব হোয়েছে এবং হোচ্ছে আচম্বিতে(Accidentally)। পরিকল্পনার কথা আসলে তো অবশ্যই স্রষ্টা এসে যান । এখন থেকে এগুবার আগে আরেকটা কথা জেনে নিতে হবে । সেটা হোচ্ছে- এই যে আচম্বিতে ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং ঘটছে এগুলো যেখানে খুশী, যখন খুশী ভাবে ঘটেনি । এগুলোকে ঘটতে হোয়েছে ধারাবাহিক ভাবে (In sequence)। একটা আচম্বিত ঘটনা যখন ঘটেছে বোলে মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু ইত্যাদি বেঁচে আছে, ঐ ঘটনাটা তখন না ঘটে যদি তার আগে বা পরে ঘটতো তবে কোন প্রাণী পৃথিবীতে থাকতো না, হয়ত জন্মই হতো না, এই সৃষ্টিও আজ যা দেখছি তা হোতনা, হয়ত মোটেও হতো না । কাজেই আচম্বিত ঘটনা ঘটেছে এবং ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে । এইরূপ ঘটনাগুলির (Accident) সংখ্যা কোটি কোটি- অগুণতি । এইবার দেখা যাক এটা কতটুকু সম্ভব । ঠিক একই আকারের টাকা বা আধুলির মত গোল দশটি ধাতব বা প্লাষ্টিকের চাকতি নিন এবং এগুলোর ওপর এক থেকে দশ সংখ্যা লিখুন । মনে রাখবেন এই চাকতিগুলি সেই কোটি কোটি আচম্বিত ঘটনাগুলোর মাত্র দশটি প্রতীক এবং সংখ্যাগুলো হোল ওগুলোর ধারাবাহিকতা (Sequence)- যার কথা বোলে এলাম । এই চাকতি দশটি আপনার পকেটে রেখে নেড়েচেড়ে মিলিয়ে দিন । এইবার আপনি চোখ বুজে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি চাকতি বের করুন । এই চাকতিটি এক থেকে দশ নম্বরের যে কোনটি হোতে পারে এবং প্রথম বারেই এক সংখ্যার চাকতিটি আপনার হাতে উঠে আসার সম্ভাবনা দশের মধ্যে এক (১:১০) । ধরুন প্রথমবারেই আপনার হাতে এক নম্বর চাকতিটি উঠলো । এবার ওটা পকেটে ফেরৎ রেখে নেড়েচেড়ে মিশিয়ে দিয়ে আরেকটি চাকতি বের করে নিন । দ্বিতীয় বারে আপনার হাতে দুই নম্বর দেয়া চাকতিটি উঠে আসার সম্ভাবনা একশ'র মধ্যে এক । অর্থাৎ আপনি যদি একশ'বার পকেট থেকে একটা একটা কোরে চাকতি বের করেন তবে এক নম্বর ওঠাবার ঠিক পরের বারে দুই নম্বরের চাকতি উঠে আসার সম্ভানা থাকবে একশ'বারের মধ্যে এক বারের । অর্থাৎ ( ১:১০×১০=১০০)। ঠিক তেমনিভাবে তৃতীয় বারের তিন নম্বর চাকতি উঠার সম্ভাবনা এক হাজার বারের মধ্যে একবার (১:১০০×১০=১০০০)। অর্থাৎ আপনি দশবার পকেট থেকে চাকতি উঠালেন । এক থেকে ধারাবাহিকভাবে দশ পর্য্যন্ত উঠার সম্ভাবনা এক হাজার কোটি বারের মধ্যে একবার (১:১০০০০০০০০০০)।

আমরা কোটি কোটি নয় অসংখ্য আচম্বিত ঘটনার মধ্যে মাত্র দশটির প্রতীক নিয়েছিলাম । তাতেই এই সংখ্যার সম্ভাবনা পাচ্ছি । তাহলে কোটি কোটি নিলে দেখা যাবে, যে সৃষ্টি আচম্বিতে (Accident) হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অসীম সংখ্যার, অর্থাৎ যে সংখ্যার শেষ নেই, তার মধ্যে একবার- অর্থাৎ অসম্ভব । এখন- দু'টো সম্ভাবনার মধ্যে একটি অসম্ভব বোলে বাদ পড়লে বাধ্য হোয়ে দ্বিতীয়টিকে গ্রহণ কোরতে হবে, এবং সেটা পরিকল্পিত হোল (Planned) এবং পরিকল্পিত মানেই স্রষ্টা । তৃতীয় আর কোন থিওরীর সম্ভাবনা কিছুই নেই । এই একই হিসাব ঠিক উল্টো দিক থেকেও করা যায় । যেমন যে কোটি কোটি আচম্বিত ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে আসার দরুণ আজ আমরা এই বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছি- ঠিক তেমনি কোটি কোটি অন্য রকম আচম্বিত ঘটনা (Accident) এই মহাকালের মধ্যে ঘটতে পারতো । যার একটি মাত্র ঘটনাও সমস্ত লণ্ডভণ্ড কোরে দিতে পারতো । কিন্তু তেমন একটি মাত্র ঘটনাও ঘটেনি । যেমন ধরুন- উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর জমানো বরফ যদি গলে যেতো বা যায় তবে বিজ্ঞানীদের মতে, পাহাড়-পর্বত ছাড়া সমস্ত পৃথিবী পানিতে ডুবে যাবে । ঘটতে পারতো, ঘটেনি ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, অংকের হিসাবে, (Mathematics or Figure of chance) স্রষ্টার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে । যে কোন চিন্তাশীল মানুষ এই বিশাল সৃষ্টির দিকে চেয়ে দেখলে এর মধ্যে এক বিরাট পরিকল্পনা দেখতে পাবেন যেটাকে অস্বীকার করা অসম্ভব । জ্ঞানের অভাবে যারা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, অর্থাৎ নাস্তিক, তারা ধারণা করেন যে, মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে, ভয় দেখাতে , স্রষ্টাকে সৃষ্টি করা হোয়েছে । এই ধারণাটা বিশ্লেষণ করা যাক । এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্রষ্টার ধারনা আজকের নয় । ইতিহাসের অনেক আগে যখন থেকে মানুষ সম্বন্ধে জানা যায় তখন থেকেই মানুষ একজন স্রষ্টার ব্যাপারে সচেতন ছিলো । প্রত্নতাত্বিকেরা মাটি খুড়ে হাজার হাজার বছর আগের যে সব জনবসতির খোঁজ পেয়েছেন, দেখেছেন সবখানেই ধর্মের অর্থাৎ স্রষ্টার কোন না কোন রকমের ধারণা ছিলো । বিভিন্ন মহাদেশে, পৃথিবীর যেখানেই কোন প্রাক-ঐতিহাসিক জনপদের সন্ধান পেয়েছেন সেখানেই তারা পেয়েছেন উপাসনার, ধর্মের চিহ্ন । অর্থাৎ স্রষ্টা সম্বন্ধে একটা ধারণা, একটা চেতনা পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিলো এটা সন্দেহাতীত । পৃথিবীর প্রধান ভূ-ভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়াতেও যেসব প্রাক-ঐতিহাসিক মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে সে সব গুলিতেও তাই । যখন এইসব বিভিন্ন জনসমষ্টির মধ্যে কোন সংযোগ, আদান-প্রদান ছিলো না, ভাষা, সংস্কৃতি সব কিছুই ছিলো ভিন্ন, একে অন্যের অস্তিত্ব পর্য্যন্ত জানতো না, তখন ঐ একটি ব্যাপারে সবাই সচেতন ছিলো এটা কেমন কোরে হলো? পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা এই জনসমষ্টিগুলি শুধু যে স্রষ্টার ব্যাপারে সচেতন ছিলো তাই নয়- তারা ঐ স্রষ্টার গুণাবলী- আমরা যেটাকে বলি সিফত- একই বোলে কেমন কোরে স্থির করলো? অর্থাৎ স্রষ্টা মহা-শক্তিশালী, সর্বব্যাপী, দয়ালু যা ইচ্ছা কোরতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি । তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষ যদি স্রষ্টার ধারণাকে সৃষ্টি কোরে থাকে তবে স্বীকার করে নিতে হবে যে বহু আগে- কত আগে কেউ বোলতে পারবে না, তবে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগে, সমস্ত পৃথিবীময় বিচ্ছিন্ন, বিভিন্ন স্থানে মানুষ একটা জুজুর ভয় সৃষ্টি করলো, যে জুজুটার গুণাবলী অকস্মাৎ কেমন কোরে একই হোয়ে গেলো- অর্থাৎ ঐ জুজুটা সর্বশক্তিমান, সর্বত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞানী, অসীম ক্ষমাশীল, দয়াময়, ইত্যাদি । এবার দেখা যাক এটা কতখানি সম্ভব ।

পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি (Gravity) আছে এ কথা প্রতিষ্ঠিত সত্য- এবং এটা আছে পৃথিবীর সৃষ্টির একদম প্রথম থেকে এ কথাও প্রতিষ্ঠিত সত্য । এ পৃথিবী স্রষ্টাই তৈরী কোরে থাকেন আর আচম্বিতে নিজেই সৃষ্টি হোয়ে থাক, এই মধ্যাকর্ষণ পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম মুহূর্ত থেকে আজ পর্য্যন্ত এই পৃথিবীর সমস্ত জিনিষের, পাহাড়-পর্বত, নদী, সমুদ্রের এক কথায় প্রত্যেক জিনিষের প্রতিটি অণুপরামানুকে নিচের দিকে টেনে রাখছে । আপনার আমার দেহের প্রতিটি অণু-পরামাণুকেও টেনে পৃথিবীতে ধোরে রেখেছে । সৃষ্টির প্রথম থেকে আজ পর্য্যন্ত এক সেকেণ্ডের এক ভগ্নাংশের জন্যও কখনো বিরতি দেয়নি । যে মস্তিষ্ক (Brain) দিয়ে মানুষ চিন্তা করে, অনুভব করে, সেই মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ (Cell)কেও সেই অনাদিকাল থেকে এই মধ্যাকর্ষণ অবিরতভাবে টেনে রেখেছে । কিন্তু মানুষ এই সর্বব্যাপী শক্তির কথা জানতো না । কোনদিন একে আবিষ্কার কোরতে পারেনি, একে ধারণাও কোরতে পারেনি । মাত্র সেদিন নিউটন (Newton) একে আবিষ্কার কোরলেন । কেন? এতদিন কি মানুষ তার মগজ মস্তিষ্ক ব্যবহার করেনি? নিশ্চয় কোরেছে । নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের আগে মানুষ বহু কিছু আবিষ্কার কোরেছে, পিরামিডের মত কালজয়ী সৌধ তৈরী কোরেছে, কিন্তু যে শক্তির অধীনে থেকে তার জীবনের প্রতি মুহূর্ত কাটছে, যে শক্তি এক মুহূর্ত বিরতি দিলে সে পৃথিবীর বহির্মুখ, অপকেন্দ্রীক শক্তির (Centrifugal force) ফলে ছিটকে মহাশূণ্যে নিক্ষিপ্ত হবে সে শক্তি সম্বন্ধে সে ছিলো সম্পূর্ণ অজ্ঞ- মাত্র কয়েক বছর আগে পর্য্যন্ত ।

যেটা নেই (স্রষ্টা) তাকে মানুষ সেই প্রাক-ঐতিহাসিক সময়ে কল্পনা কোরে নিলো, শুধু কল্পনা কোরে নিলো না , সেটা কী রকম তার একই রকম বিস্তৃত বিবরণ পৃথিবীর এধার থেকে ওধার পর্য্যন্ত বিশ্বাস কোরে নিলো- কিন্তু যেটা আছে (মধ্যাকর্ষণ) সেটাকে মানুষ হাজার হাজার বছরেও আবিষ্কার করতে পারলো না- এ কেমন কথা? এর জবাব হোচ্ছে- স্রষ্টা তার প্রেরিতদের দিয়ে সেই প্রথম মানুষটি থেকেই তার অস্তিত্ব ও গুণাবলী অর্থাৎ তিনি কেমন তা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন বোলেই মানুষ তার সম্পর্কে জানে, আর মধ্যাকর্ষণ সম্বন্ধে নিউটনের আগে কাউকে জানাননি বোলেই মানুষ তা জানতে পারেনি । স্রষ্টা যদি মানুষ সৃষ্টি কোরে, তাকে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হোতেন, প্রেরিতদের দিয়ে নিজের সম্বন্ধে কিছু না জানাতেন তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মানুষ আজও তার সম্বন্ধে কিছু জানতো না- কিম্বা স্রষ্টা কেউ একজন হোতে পারেন ভাবলেও তার গুণাবলী, সিফত (Attributes) সম্বন্ধে কোন ধারণা কোরতে পারতো না । নাস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্বের যে প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুস প্রমান চান ও রকমের প্রমাণহীন বহু লক্ষ জিনিষকে, ব্যাপারকে তারা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন । তারা যার যার বাপকে বাপ বোলে বিশ্বাস করেন, কিন্তু এর কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই- প্রতিবেশীর ছেলের চেহারা বাপের মত, শুধু এইটুকুর ওপর নির্ভর কোরেই তারা তাদের সত্যই বাপ ও ছেলে বোলে বিশ্বাস করেন । এ বিশ্বাসগুলো সব অবস্থাগত, আনুষঙ্গিক (inferential)। কিন্তু স্রষ্টার প্রমাণ তারা চান প্রত্যক্ষ, চাক্ষুস ।

আসল কথা হোল- স্রষ্টা আছেন কিন্তু তিনি আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবেন না বা তার ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগ কোরে মানুষকে তার প্রতি বিশ্বাস এনে দেবেন না । কারণ তা কোরলে মানুষকে বিচার কোরে শাস্তি বা পুরস্কর দেবার আর কোন অর্থ থাকবে না । মানুষ তা হোলে গাছ-পাথর, পাহাড়-পর্বতের মত তার আরেকটি সৃষ্টি মাত্র হতো, তার নিজের হাতের তৈরী যুক্তি, বুদ্ধিসহ সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টি হতো না ।

স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার কোরে নেওয়া হলো । প্রশ্ন হোচ্ছে আমরা কি তাকে ধারণা কোরতে পারি ? তিনি নিজে বোলেছেন- না, তোমরা পারনা (কোরান- সূরা আল-আনা'ম ১০৩)। কেন পারি না? পারি না- কারণ আমরা সৃষ্ট, আমাদের সমস্ত শক্তি সীমিত । ধারণার শক্তিও সীমিত; স্রষ্টা অসীম । স্রষ্টাকে কেন, এই মহাসৃষ্টির একটা সামান্য অংশকেও আমরা ধারণায় আনতে পারি না । স্থান (Space) ধারণা কোরতে চেষ্টা কোরলে মোটামুটি আমরা কয়েক মাইলের দুরত্ব ধারণা কোরতে পারি । আমাদের পৃথিবীরই এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশের দূরত্ব চিন্তা কোরতে গেলে মাথা গুলিয়ে যেতে চায় । আর এই সৌর জগত, তারপর Galaxy তারপর মহাশূণ্যের অগণ্য আলোক-বর্ষের (Light year) দূরত্ব ধারণা করা মানুষের অসাধ্য । ঠিক তেমনি সময় (Time) সম্বন্ধে ধারণা কোরতে চেষ্টা করলে আমরা কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিনের সময় আমাদের ধারণার মধ্যে আনতে পারি । একটা সম্পূর্ণ মাসের সময়টাও আমার মনে হয় কেউ সম্যকভাবে ধারণার ভেতর আনতে পারবে না । বিগত এবং ভবিষ্যতের কোটি কোটি বৎসরের সময় ধারণার মধ্যে আনা অসম্ভব । যদি সৃষ্টির একটা অতি, অতি ক্ষুদ্র অংশই মানুষের ধারণা করার শক্তি না থাকে তবে সেই সৃষ্টির স্রষ্টাকে ধারণা করা যে যাবে না তা অতি পরিষ্কার ।

তাহলে পৃথিবীতে মানব জাতির যে চিরন্তন সমস্যা- অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তারক্তি, না কোরে শান্তিতে বসবাস করার পথ খুঁজে বার কোরতে যেয়ে প্রথম যে প্রশ্নের সমাধান অর্থাৎ স্রষ্টা আছেন কিনা, এর জবাব আমরা এখন নিশ্চয়ই ধোরে নিতে পারি যে- স্রষ্টা আল্লাহ(Allah), আছেন । এখন থেকে এ কথাটা সর্বক্ষণ মনে রাখতে হবে যে স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং তার গুণাবলী, সিফতসমূহ হবে এরপর থেকে সমস্ত চিন্তাধারার ভিত্তি, সিদ্ধান্ত সূত্র । এই সিদ্ধান্ত-সূত্র থেকে যেখানেই পদস্খলন হবে সেখানেই সিদ্ধান্ত ভুল হবে । চিন্তা-ধারার মধ্যে যেখানেই এই ভিত্তিকে ভুলে যাব সেখানেই পথ হারিয়ে যাব এবং ভুল সিদ্ধান্তে যেয়ে পৌঁছব। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যাক, আজ-কালকার মহাশূন্য গবেষণা বা যাত্রা (Space travel)। যে সব অংক কোষে মানুষ ঠিকমত চাঁদে গেছে, সেখান থেকে ফিরেও এসেছে- সে সব হিসাবপত্রের মূল ভিত্তি, সিদ্ধান্ত-সূত্র হলো এলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব (Einsteins Theory Relativity)। যে কোন মহাশুন্য বিজ্ঞানীকে প্রশ্ন কোরে দেখুন যে এই আপেক্ষিক তত্বকে বাদ দিয়ে হিসাব কোরলে কি ফল হবে? তার সোজা জবাব হবে- সমস্ত বিপর্যস্ত হোয়ে যাবে । এই যে প্রায় কয়েক হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ (Satellite) পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই যে রকেটগুলো মঙ্গলগ্রহ, শুত্রুগ্রহ পর্য্যন্ত ঠিকমত পৌঁছে পৃথিবীতে নানারকম বৈজ্ঞানিক তথ্য পাঠাচ্ছে- এর কোন কিছুই সম্ভব হোত না যদি আইনস্টাইনের E=MC2 কে ভিত্তি হিসাবে না নেয়া হোত । অর্থাৎ যে কোন হিসাবপত্র বা চিন্তাধারাতে আসল ভিত্তি সিদ্ধান্ত সূত্র (Basic বা Premiss) কে যখনই ভুলে যাওয়া বা অগ্রাহ্য করা হবে, তখনই হিসাবে বা চিন্তাধারাতে ভুল হোতে বাধ্য । আপেক্ষিক তত্বের উপর নির্ভর না কোরে হিসাব কোরে চাঁদ অভিমুখে রকেটে চড়ে রওনা হোলে যেমন মানুষ চাঁদে না পৌঁছে মহাশূণ্যে হারিয়ে যাবে, তেমনি স্রষ্টার অস্তিত্বকে হিসাবে না রেখে মানুষ তার জীবন ব্যবস্থা নির্দ্ধারণ বা তৈরী কোরে নিলে সে অবশ্যম্ভাবীরূপে বিপর্যস্ত হবে- যেমন আজ হোচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই: