বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১১

৩। মানুষ সৃষ্টি

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থগুলি ও বিজ্ঞান একমত যে মানুষ সৃষ্টির বহু আগে স্রষ্টা এই বিপুল বিশ্ব-জগত সৃষ্টি কোরেছেন। এই বিশাল সৃষ্টিকে তিনি প্রশাসনও পরিচালনা কোরতেন এবং করেন তার অসংখ্য মালায়েকদের দিয়ে যাদের আমরা বলি ফেরেশতা- ফারসি ভাষায়, ইংরাজীতে Angel। ভারতীয়, রোমান এবং গ্রীকরা যে দেব-দেবী gods, goddess বিশ্বাস করেন সেগুলো এবং মালায়েক বা ফেরেশতা একই জিনিষ। সংখ্যায় এরা অগন্য এবং এরা আসলে প্রাকৃতিক শক্তি- যে শক্তি দিয়ে আল্লাহ(Allah) তার সমস্ত সৃষ্টিকে শৃংখলার মধ্য দিয়ে পরিচালনা করেন এবং এদের কোন ইচ্ছাশক্তি নেই। আল্লাহ(Allah) যাকে যে নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, যাকে যে কর্তব্য নির্দ্ধারণ কোরে দিয়েছেন; সে ফেরেশতা সামান্যতম বিচ্যুতি না কোরে তা যথাযথ কোরে যাচ্ছেন। আসলে কোন বিচ্যুতি হোতে পারে না- কারণ প্রাকৃতিক শক্তিগুলির কোন স্বাধীন ইচ্ছাই নেই। যেমন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একটি মালায়েক। এর উপর স্রষ্টা কর্তব্য নিধারণ করে দিয়েছেন সমস্ত কিছুকে আকর্ষণ কোরে ধোরে রাখার। সৃষ্টির প্রথম থেকে এই ফেরেশতা তার কর্তব্য কোরে যাচ্ছেন এবং শেষ পর্য্যন্ত কোরে যাবেন। তার এতটুকু ইচ্ছা শক্তি নেই যে, এক মুহূর্তের এক ভগ্নাংশের জন্যও তিনি এই কাজের বিরতি দেন, সে ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ(Allah) তাকে দেননি। এমনি আগুন, বাতাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তিগুলি- ফেরেশতা, দেব-দেবী, অন্যান্য ধর্মে যেমন দেব-দেবীরা কোন না কোন প্রাকৃতিক শক্তির ভারপ্রাপ্ত, যেমন হিন্দু শাস্ত্রে বরুন বাতাসের দেবতা, সূর্য্য একটি দেবতা- সূর্য্যদেব, গ্রীকদের নেপচুন সমুদ্রের, পানির দেবতা, রোমানদের ভালকান হচ্ছেন আগুনের দেবতা, তেমনি ইসলাম(Islam) ধর্মেও আগুনের. বাতাসের ইত্যাদির ফেরেশতা আছেন। আরও ব্যাপারে মিল আছে। সব ধর্ম মতেই এরা সংখ্যায় বিশাল-স্বভাবতঃই কারণ এই অসীম সৃষ্টিতে প্রাকৃতিক শক্তিও অসংখ্য।

ভারতীয় ধর্মগুলিতে এদের সংখ্যা ধরা হয় তেত্রিশ কোটি। খ্রীস্টানরাও এদের সংখ্যা বলেন কোটির অংকে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর যাজক পণ্ডিত এ্যালবার্টাস ম্যাগনাস (Albertus Magnus) তো হিসাব কোরে (কেমন কোরে হিসাব কোরলেন আল্লাহ(Allah)ই জানেন) বের কোরেই ফেললেন যে Angel অর্থাৎ ফেরেশতার সঠিক সংখ্যা হচ্ছে ঊনচল্লিশ কোটি, নিরানব্বই লক্ষ, বিশ হাজার চার জন- হিন্দুদের চেয়ে সাত কোটির মত বেশী। জাপানের শিনটো ধর্মে দেব-দেবীর সংখ্যা আশী লক্ষ। মেরাজে যেয়ে বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দঃ) দেখেছিলেন যে বায়তুল মামুর সমজিদে হাজার হাজার ফেরেশতারা একদিক দিয়ে ঢুকছেন, সালাত পড়ে আরেক দিক দিয়ে বের হোয়ে যাচ্ছেন। তাদের সংখ্যা সম্বন্ধে বোলতে যেয়ে তিনি বোলেছেন একবার যারা নামায পড়ে বের হোয়ে যাচ্ছে তাদের আর দ্বিতীয় বার নামায পড়ার সুযোগ আসবে না- অর্থাৎ অসংখ্য (হাদীস- আনাস (রাঃ) থেকে সাবেত আল বুতানী, মুসলিম(Muslim), মেশকাত)। অসীম সময় থেকে আল্লাহ(Allah) তার বিশাল সৃষ্টিকে তার অসংখ্য মালায়েকদের দিয়ে সুশৃংখলভাবে প্রশাসন ও পরিচালনা কোরে আসছিলেন। তারপর এক সময়ে তার ইচ্ছা হোল মানুষ সৃষ্টির। তার এই ইচ্ছা কেন তা আমার জানা নেই। কারু জানা আছে কিনা তাও জানা নেই। তার বাণীতে তিনি কিছু আভাষ মাত্র দিয়েছেন। একবার বোলেছেন- এ সৃষ্টি আমি সময় কাটাবার জন্য কোরেনি (কোরান- সূরা আল মুল্ক ২)।

অবশ্যই- কারণ সময়ই যার সৃষ্টি তার আবার তা কাটাবার প্রশ্ন কোথায়? আবার বোলেছেন- তিনি পরীক্ষা কোরে দেখতে চান তোমাদের মধ্যে কারা ভাল কাজ করে (কোরান- সূরা আল মুল্ক ২)। মোট কথা একমাত্র তিনিই জানেন, কেন তিনি এই বিশ্বজগত ও বিশেষ কোরে একাধারে তার শ্রেষ্ঠ ও সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি মানুষ সৃষ্টি কোরলেন (কোরান- সূরা আত্ ত্বীন ৪-৫)। কিন্তু এ সত্য এড়াবার উপায় নেই যে সৃষ্টি তিনি কোরেছেন। ঐ সময়টার কথা বোলতে যেয়ে তিনি কোরানে আমাদের যা বোলেছেন তা এইযে- যখন আল্লাহ(Allah) তার মালায়েক অর্থাৎ ফেরেশতাদের বোললেন যে আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি কোরতে ইচ্ছা কোরেছি তখন তারা বোললেন- কী দরকার তোমার প্রতিভু সৃষ্টি করার? ওরাতো পৃথিবীতে ফ্যাসাদ, অশান্তি আর রক্তপাত কোরবে (কোরান- সূরা আল বাকারা ৩০)। মালায়েকদের এই উত্তরের মধ্যে নিহীত রোয়েছে সৃষ্টি রহস্যের একটা বড় অংশ। কাজেই এখানে একটু থেমে এই অতি প্রয়োজনীয় বিষয়টি ভাল কোরে বুঝে নেয়া যাক।

ইসলাম(Islam), জুডিয় ও খ্রীস্টান ধর্মমতে আদমের (আঃ) এক ছেলে আরেক ছেলেকে হত্যা কোরেছিলো। ঐ প্রথম রক্তপাত থেকে যে রক্তপাত মানুষ জাতির মধ্যে শুরু হোল তা আজ পর্য্যন্ত থামেনি। এবং এই অশান্তি ও রক্তপাত আজ পর্য্যন্ত মানুষজাতির জন্য সর্বপ্রধান সমস্যা হোয়ে আছে। ফেরেশতারা যে দু'টি শব্দ মানুষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে ব্যবহার কোরেছিলেন তার একটা ফ্যাসাদ, যার অর্থ অবিচার, অশান্তি, অন্যায় ইত্যাদি। অন্যটি রক্তপাত। দুটো মিলিয়ে অর্থ দাঁড়ায় মানুষ অন্যায়, অশান্তি আর রক্তপাত কোরবে। সত্যই তাই হোয়েছে- আদমের (আঃ) ছেলে থেকে আজ পর্য্যন্ত শুধু ঐ রক্তপাতই নয়, অশান্তি, অন্যায়, অবিচারও বন্ধ হয়নি, এবং তখন থেকে আজ পর্য্যন্ত মানব জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা এই অন্যায়, অশান্তি, অবিচার আর রক্তপাত, যুদ্ধ-মানুষ শত চেষ্টা কোরেও বন্ধ কোরতে পারেনি। শুধু তাই নয়, এই সমস্যাই মানুষ জাতিকে এমন পর্য্যায়ে নিয়ে এসেছে যে আজ তার অস্থিত্বই প্রশ্ন হোয়ে দাঁড়িয়েছে।

মানুষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে যুক্তি হিসাবে মালায়েকরা এ কথা বলেননি যে মানুষ মন্দিরে, মসজিদে, গীর্জায়, প্যাগোডায়, সিনাগগে যেয়ে তোমার উপাসনা কোরবে না, উপবাস কোরবে না। তারা এসবের একটাও বলেননি। বোলেছেন অশান্তি, অন্যায়, ঝগড়া আর রক্তপাত কোরবে। অর্থাৎ আসল সমস্যা ওটা নয়, এইটা। আল্লাহ(Allah) কি বোঝেননি মালায়েকরা কি বোলেছিলেন? তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন এবং তা সত্ত্বেও তাদের আপত্তি অগ্রাহ্য কোরে মানুষ বানালেন। তার প্রতিনিধি সৃষ্টির ব্যাপারে স্রষ্টা নিজে আমাদের যে সব তথ্য জানাচ্ছেন তা থেকে আমরা কয়েকটি বুনিয়াদি কথা জানতে পারছি। একটি - তার এই নতুন সৃষ্টিটির গুরুত্ব ও মর্য্যাদা কত বেশী এবং এর ওপর তার স্নেহ কতখানি তা বুঝা যায় এথেকে যে- যেখানে মালায়েকসহ এই বিশাল সৃষ্টি তিনি কোরলেন শুধু তার মুখের আদেশ দিয়ে- হও! আর সব হোয়ে গোলো (কোরান- সুরা আল বাকারা ১১৯, সূরা আন নাহল ৪০, সূরা ইয়াসিন ৮২)। সেখানে মানুষকে অর্থাৎ আদমকে (আঃ) তৈরী কোরলেন তার নিজ হাতে (কোরান সূরা সা'দ ৭৫)। এবং তার দেহের মধ্যে তার নিজের আত্মা থেকে ফুঁকে দিলেন (কোরান- সূরা আল হিজর ২৯)। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা, শব্দ ব্যবহার কোরেছেন আমার আত্মা, স্বয়ং স্রষ্টার আত্মা। অর্থাৎ আল্লাহ(Allah)র যত রকম গুণাবলী, সিফত আছে সব মানুষের মধ্যে চলে এলো। এমনকি তার যে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি এটাও ঐ আত্মার সঙ্গে মানুষের মধ্যে চলে এলো। এইটা সম্বন্ধেই আল্লাহ(Allah) বোলেছেন- মানুষকে আমি আমার আমানত দিয়েছি (কোরান- সূরা আহযাব- ৭২)। আল্লাহ(Allah)র এই গুণ, এই শক্তিগুলি সৃষ্টির আর কারু নাই- ফেরেশতা, মালায়েকদেরও নেই- সব তার বেধে দেওয়া আইন, নিয়ম মেনে চলছে। এইগুলিকেই আমরা বলি প্রাকৃতিক নিয়ম। কারু সাধ্য নেই এই নিয়ম থেকে এক চুল পরিমাণও ব্যতিক্রম করে। কারণ তা করার ইচ্ছা শক্তিই তাদের দেয়া হয়নি। ইচ্ছা হোলে কোরব, ইচ্ছা না হোলে কোরব না, এ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি একমাত্র আল্লাহ(Allah)র। মানুষের মধ্যে যখন তিনি তার আত্মা ফুঁকে দিলেন তখন তার মধ্যে স্রষ্টার সমস্ত গুণাবলীর ও শক্তির সঙ্গে ঐ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিও চলে এলো। এটাই হলো তার দেয়া আমানত যা অন্য কোন সৃষ্টি গ্রহণ কোরতে ভয় পেলো। কিন্তু মানুষ এটা নিয়ে নিজেকে অন্যায়কারী ও জ্ঞানহীন প্রমাণ করলো (কোরান- সূরা আল আহযাব ৭২)। আল্লাহ(Allah) তার নিজের আত্মা মানুষের মধ্যে ফুঁকে দেয়ার আগে পর্য্যন্ত মানুষ লক্ষ কোটি সৃষ্টির আরেকটি মাত্র ছিলো। কিন্তু স্রষ্টার আত্মা তার মধ্যে ফুঁকে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে এক অনন্য সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হোয়ে গেলো। সে হোয়ে গেলো স্রষ্টার, আল্লাহ(Allah)র প্রতিনিধি যার মধ্যে রোয়েছে সেই মহান স্রষ্টার প্রত্যেকটি গুণ- শুধুমাত্র গুণ নয় প্রত্যেকটি শক্তি। শুধু তফাৎ, এই যে অতি সামান্য পরিমাণে। ব্যাখ্যা কোরতে গেলে বোলতে হয়- মহাসমুদ্র থেকে এক ফোটা পানি তুলে এনে তার যদি রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা যায় তবে ঐ এক ফোটা পানির মধ্যে সেই মহাসমুদ্রের পানির প্রত্যেকটি গুণ পাওয়া যাবে, মহাসমুদ্রের মধ্যে যত পদার্থ আছে তার প্রত্যেকটি পাওয়া যাবে। কিন্তু তবু ঐ এক ফোটা পানি মহাসমুদ্র নয়- সে প্রলয়ংকর ঝড় তুলতে পারবে না, জাহাজ ডোবাতে পারবে না। সূর্য্যের আগুন থেকে একটা মোমবাতি জ্বলিয়ে আনলে সেই মোমবাতির শিখায় সূর্য্যের আগুনের সমস্ত গুণ থাকবে। সেও জ্বালাতে পারবে, আলো দিতে পারবে কিন্তু সে সূর্য্যের মত গ্রহে গ্রহে আলো আর তাপ ছড়াতে পারবে না। তবুও ঐ মোমবাতির শিখা সেই সূর্য্য থেকেই আনা আগুন- একই জিনিষ।

দ্বিতীয় - স্রষ্টা তার এই নতুন সৃষ্টিটাকে সব জিনিষের নাম শেখালেন (কোরান- আল বাকারা ৩১)। এর অর্থ হলো তিনি যা সৃষ্টি কোরেছেন সেই সব জিনিষের ধর্ম (Property), কোন জিনিষের কি কাজ, কেমন কোরে সে জিনিষ কাজ কোরে ইত্যাদি, এক কথায় বিজ্ঞান, যে বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি কোরে তিনি তার বিশাল সৃষ্টি কোরেছেন, মানুষকে সেই বিজ্ঞান শেখালেন। এই কথা বোলে তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন যে মানুষ জাতি সৃষ্টির প্রত্যেক জিনিষ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ কোরবে। আজ থেকে হাজার বছর আগে মানুষ যে সব জিনিসের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ কোরেছিল অর্থাৎ নাম জেনেছিলো, আজ তার চেয়ে বহু বেশী জিনিষের সম্বন্ধে জানে- আজ থেকে বহু বছর পর সে আরো বহু জিনিষ সম্বন্ধে জানবে। মানুষকে বিজ্ঞান শেখাবার পর তিনি তার মালায়েকদের ডেকে সব জিনিষের নাম জিজ্ঞাসা কোরলেন- তারা বোলতে পারলেন না (কোরান- আল বাকারা ৩২)। কারণ আগেই বোলেছি, মালায়েকরা প্রাকৃতিক শক্তিমাত্র। তাদের যার ওপর যে কাজের ভার দেয়া আছে তার বাইরের কোন জ্ঞান তাদের নেই- ইচ্ছাশক্তিও নেই। তৃতীয় হলো- আল্লাহ(Allah) তার মালায়েকদের ডেকে হুকুম কোরলেন তার এই নতুন সৃষ্টি আদম অর্থাৎ মানুষকে সাজদা কোরতে। ইবলিস ছাড়া আর সমস্ত মালায়েক মানুষকে সাজদা কোরলেন (কোরান- আল বাকারা ৩৪)। এর অর্থ কি? এর অর্থ প্রথমতঃ ফেরেশতারা মানুষকে তাদের চেয়ে বড়, বেশী উচ্চ বোলে মেনে নিলেন, কারণ তার মধ্যে আল্লাহ(Allah)র আত্মা আছে যা তাদের মধ্যে নেই। দ্বিতীয়তঃ প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে আল্লাহ(Allah) মানুষের খেদমতে নিযুক্ত কোরে দিলেন। আগুন, পানি, বাতাস, বিদ্যুত, চুম্বক, মাটি ইত্যাদি লক্ষ কোটি মালায়েক তাই মানুষের সেবায় নিয়োজিত। একমাত্র ইবলিস আল্লাহ(Allah)র হুকুম অমান্য কোরে আদমকে (আঃ) সাজদা করলোনা।

এখানে একটি প্রশ্ন হোতে পারে- মালায়েকরাতো প্রাকৃতিক শক্তি, তাহোলে ইবলিস তাদেরই একজন হোয়ে, ইচ্ছাশক্তিহীন হোয়ে, আল্লাহ(Allah)র আদেশ কেমন কোরে অমান্য করলো। এর জবাব হোচ্ছে- মালায়েকরা সব আলোর তৈরী, একমাত্র ইবলিসই ছিলো আগুনের তৈরী। কারণ মূলতঃ ইবলিশ ছিলো একজন জ্বীন- মালায়েক নয়। কঠিন এবাদত ও রেয়াযত কোরে পরে সে মালায়েকের স্তরে উন্নীত হয়। আগুনের তৈরী বোলে তার মধ্যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি না থাকলেও অহঙ্কার তখনো বজায় ছিলো, যা সে অত সাধনা কোরেও নিশ্চিহ্ন কোরতে পারেনি। মাটির তৈরী আদমকে সাজদা কোরতে বলায় তার ঐ অহঙ্কার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো বোলেই সে আল্লাহ(Allah)কে চ্যালেঞ্জ দিলো যে তুমি যদি আমাকে এই শক্তি দাও যে আমি মাটির তৈরী তোমার ঐ সৃষ্টিটার দেহের, মনের ভেতর প্রবেশ কোরতে পারি তবে আমি প্রমাণ কোরে দেখাবো যে ঐ সৃষ্টি তোমাকে অস্বীকার কোরবে। আমি যেমন এতদিন তোমাকে প্রভু স্বীকার কোরে তোমার আদেশ মত চলেছি, এ তা চলবে না। আল্লাহ(Allah) ইবলিসের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ কোরলেন। তাকে আদমের দেহ, মন, মস্তিষ্কে প্রবেশ কোরে আল্লাহ(Allah)কে অস্বীকার করার তার অবাধ্য হবার প্ররোচনা দেবার শক্তি দিলেন (কোরান- সূরা আল বাকারা ৩৬, সূরা আন নিসা ১১৯)।

এর পরের ঘটনাগুলো অতি সংক্ষেপে এই যে আল্লাহ(Allah) তার প্রতিভু আদমের জন্য তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি কোরলেন, তাদের জান্নাতে বাস কোরতে দিলেন একটি মাত্র নিষেধ আরোপ কোরে। আল্লাহ(Allah)র অনুমতি পেয়ে ইবলিশ আদমও হাওয়ার মধ্যে প্রবেশ কোরে তাদের প্ররোচনা দিয়ে ঐ একটিমাত্র নিষেধকেই অমান্য করালো, যার ফলে আল্লাহ(Allah) তাদের জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নির্বাসন দিলেন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য (কোরান- সূরা আল বাকারা ৩৬) -অর্থাৎ কেয়ামত পর্য্যন্ত। আর বোললেন- নিশ্চয়ই আমি তোমাদের জন্য পথ-প্রদর্শক পাঠাবো (কোরান- সূরা আল বাকারা ৩৮)।

প্রশ্ন হোতে পারে- যে মানুষের মধ্যে তিনি তার নিজের আত্মা ফুকে দিয়েছেন তাকে পথ-প্রদর্শন কোরতে হবে কেন? এই জন্য হবে যে যদিও মানুষের মধ্যে স্রষ্টার সমস্ত গুণ ও শক্তিই আছে, কিন্তু তা অতি সামান্য পরিমাণে (কোরান- সূরা বনি ইসরাইল ৮৫)। মানুষ নিজে তার পথ খুঁজে নিজের জন্য একটি জীবন ব্যবস্থা তৈরী কোরে নিতে পারতো যদি কি কি প্রাকৃতিক নিয়মে এই সৃষ্টি হোয়েছে, চলছে তার সবই যদি সে জানতো। কিন্তু তা সে জানেনা। দ্বিতীয়তঃ ইবলিস তো তার মধ্যে বোসে নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাকে প্ররোচনা দিয়ে চলেছেই। তার চেয়ে বড় কারণ, ঐ ইবলিসের চ্যালেঞ্জ- মানুষকে দিয়ে আল্লাহ(Allah)কে অস্বীকার করিয়ে, আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন পথকে বর্জন করিয়ে নিজেদের জন্য জীবন-ব্যবস্থা তৈরী করিয়ে তাই মেনে চলা- যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অন্যায়, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত। আল্লাহ(Allah) তার নবীদের মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষের জন্য জীবন ব্যবস্থা পাঠিয়ে বোলছেন আমাকে একমাত্র প্রভু, একমাত্র বিধানদাতা বোলে বিশ্বাস কোরে, এই জীবন ব্যবস্থা মত তোমাদের জাতীয়, পারিবারিক ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনা কর, তাহলে তোমাদের ভয় নেই (কারান- সূরা আল বাকারা ৩৮)। কিসের ভয় নেই? ঐ ফ্যাসাদ, অশান্তি, রক্তপাতের এবং পরবর্তীতে জাহান্নামের ভয় নেই। যে জীবন-ব্যবস্থা দ্বীন আল্লাহ(Allah) নবীদের মাধ্যমে বার বার পাঠালেন- এর নাম, স্রষ্টা নিজে রাখলেন শান্তি, আরবী ভাষায় ইসলাম(Islam)। অর্থ হোল- এই দ্বীন জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা কোরলে তার ফল শান্তি, জাতীয়, পারিবারিক, ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি, ইসলাম(Islam)। না কোরলে অশান্তি, অন্যায়, অবিচার মানুষে মানুষে যুদ্ধ, রক্তপাত- মানুষ তৈরীর বিরুদ্ধে মালায়েকরা যে কারণ পেশ কোরেছিলেন আল্লাহ(Allah)র কাছে। তাই সেই আদম (আঃ) থেকে শেষ নবী মোহাম্মদ (দঃ) পর্য্যন্ত যতবার নবীর মাধ্যমে এই জীবন-ব্যবস্থা তিনি পাঠালেন, সবগুলির ঐ একই নাম-ইসলাম(Islam)-শান্তি।

এই হোল সমস্ত ব্যাপারের মূল কথা। দ্বীনের আর বাকি যেটুকু আছে, নামায, রোযা, ইত্যাদি হাজারো কাজ, সব আনুষঙ্গিক, গৌণ। তার প্রমান - আজ পৃথিবীময় ঐ আনুষঙ্গিক কাজগুলো প্রতি ধর্মে অতি নিষ্ঠার সাথে গভীর আন্তরিকতার সাথে কোরে যাওয়া হোচ্ছে, কিন্তু পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন তো দূরের কথা- অশান্তি, মারামারি, হানাহানি আর রক্তপাত অবিশ্রান্তভাবে বেড়ে চলছে। শুধু তাই নয়, এমন প্রচণ্ড অস্ত্র তৈরী হোয়েছে যে আজ মানুষ জাতিটাই ধ্বংশ হবার পথে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ যদি প্রতি ধর্মের প্রতিটি মানুষ তাদের যার যার ধর্মের ঐ উপাসনা, অনুষ্ঠান ইত্যাদি পরিপূর্ণভাবে পালন করেন তা হোলেও পৃথিবীতে অশান্তি, অন্যায়, রক্তপাত বন্ধ তো হবেই না, আজ যেমন বাড়ছে তেমনি বেড়েই চলবে। কারণ আল্লাহ(Allah) যে জীবন-ব্যবস্থা মানুষের জন্য তার নবীদের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন তা প্রত্যেক ধর্মের লোকেরাই অস্বীকার কোরে মানুষের তৈরী রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা তাদের জাতীয় জীবনে প্রয়োগ কোরেছে- মূলকে ছেড়ে গৌণকে ধোরে রেখেছে। এই জন্যই স্রষ্টা যখন তার প্রধিনিধি মানুষ তৈরীর কথা মালায়েকদের বোলেছিলেন তখন তারা এ কথা বলেননি যে তোমার এই সৃষ্টি উপাসনালয়ে যেয়ে তোমার উপাসনা কোরবে না, উপবাস কোরবে না, আনুষ্ঠানিকতা কোরবে না। বোলেছিলেন নিজেদের মধ্যে অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, আর রক্তপাত কোরবে। অর্থাৎ মুল সমস্যা মানুষের শান্তিতে ইসলামে(Islam) পৃথিবীতে বসবাস, উপাসনার আনুসঙ্গীতা নয়। তাই বোলেছিলাম- মালায়েকদের মানুষ সৃষ্টির বিরুদ্ধে যুক্তিটা ভালো কোরে বুঝে নেয়া দরকার- নইলে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও মানব জীবনের অর্থ বোঝা যাবে না।

আল্লাহ(Allah) তার প্রতিভূ আদমকে (আঃ) সৃষ্টি কোরে তার স্ত্রীসহ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। বোলে দিলেন- যাও, ওখানে বংশ বৃদ্ধি কর। তোমরা ওখানে তোমাদের সামগ্রিক জীবন কেমন কোরে পরিচলিত কোরলে অন্যায়-অবিচার, রক্তপাতহীন অবস্থায় বাঁচতে পারবে যে পথ প্রদর্শন আমি নিশ্চয়ই পাঠিয়ে দেব (কোরান- সূরা আল বাকারা ৩৮)। অর্থাৎ মানুষকে শান্তিতে থাকতে হোলে যে রকম জীবন-ব্যবস্থায় থাকতে হবে সে ব্যবস্থা প্রণয়নের ভার তিনি নিজে নিলেন। স্রষ্টা যে কাজের দায়িত্ব নিলেন তাতে যে তিনি ব্যর্থ হবেন না, তা স্বাভাবিক। পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেবার পর তার প্রথম সৃষ্টি আদমকে (আঃ) দিলেন তার জীবন-ব্যবস্থা। আমরা ধোরে নিতে পারি, এ ব্যবস্থা ছিলো ছোট, সংক্ষিপ্ত- কারণ তখন অল্প সংখ্যক নর-নারীর জন্যই ব্যবস্থা দিতে হয়েছিলো। আদম (আঃ) এবং তার পুত্র কন্যা ও নাতি-নাতনিদের জন্য এবং সমস্যাও নিশ্চয়ই ছিলো সীমিত। কিন্তু তারপর আল্লাহ(Allah)র হুকুম মোতাবেক বংশ বৃদ্ধি চললো। সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে আদমের (আঃ) সন্তানরা ক্রমে ক্রমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লো, ফলে একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন হোয়ে পড়লো। স্রষ্টা কিন্তু তার দায়িত্ব ভুলেননি। বনি-আদমের বিভিন্ন, বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীতে তিনি তার প্রেরিত পাঠিয়ে তাদের জন্য জীবন-ব্যবস্থা পাঠাতে থাকলেন- যে ব্যবস্থা অনুসরণ কোরলে তারা নিজেদের মধ্যে অশান্তি, ফাসাদ, রক্তপাত না কোরে শান্তিতে, ইসলামে(Islam), বাস কোরতে পারে। এদিকে ইবলিস অর্থাৎ শয়তানও ভুললোনা তার প্রতিশ্রুত কাজ। সেও প্রতিটি বনি-আদমের দেহ-মনের মধ্যে বোসে তাকে নানা রকম বুদ্ধি পরামর্শ দিতে থাকলো, নতুন নতুন উপায় বাতলাতে থাকলো যাতে মানুষ আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন-ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে, অন্ততঃ পক্ষে বিকৃত করে; এবং ফলে সেই অন্যায়, ফাসাদ আর রক্তারক্তিতে জড়িত হোয়ে পড়ে। যখনই ইবলিস কোন জন সমাজে সফল হোয়েছে তখনই আল্লাহ(Allah) সেখানে নতুন একজন প্রেরিত পাঠিয়েছেন সেটাকে সংশোধন কোরতে (কোরান- সূরা আন নহল ৩৬)।

এখন দেখা দরকার যে, বিভিন্ন নবীদের মাধ্যমে, পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য আল্লাহ(Allah) যে জীবন-ব্যবস্থা পাঠালেন সেটা মূলতঃ কি? পর্যবেক্ষণ কোরলে দেখা যায় এর মূল ভিক্তি হোচ্ছে- স্রষ্টাকে, আল্লাহ(Allah)কে একমাত্র প্রভু, শুধু একমাত্র প্রভু নয়, সর্বময় প্রভূ বোলে স্বীকার ও বিশ্বাস করা। এই ব্যাপারে তিনি নিজের সম্বন্ধে যে শব্দটি ব্যবহার কোরেছেন সেটা হলো 'ইলাহ'। বর্তমানে এর অনুবাদ করা হয় ‘উপাস্য' শব্দ দিয়ে। এই উপাস্য শব্দ দিয়ে এর অনুবাদ হয় না। কারণ হোচ্ছে এই যে বর্তমানে পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিকৃত হোয়ে গেছে। যার একটা বিকৃতি হলো আল্লাহ(Allah)র দেয়া বিধান থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি জাতীয় ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে শুধু ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলিতে সীমাবদ্ধ কোরে রাখা; এবং আনুষ্ঠানিক উপাসনা তার অন্যতম। কিন্তু ‘এলাহ' শব্দ আল্লাহ(Allah) এ অর্থে ব্যবহার করেননি। তিনি যে অর্থে ব্যবহার কোরেছেন তার অর্থ হল- যার বিধান এবং নির্দেশ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতি ব্যাপারে অলংঘনীয়। আদম (আঃ) থেকে মোহাম্মদ (দঃ) পর্য্যন্ত প্রত্যেক নবীর সময় এই বিশ্বাসের মূলমন্ত্র রাখা হোয়েছে-একমাত্র আল্লাহ(Allah) ছাড়া আর কোন এলাহ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)- এবং পরে যোগ হোয়েছে তদানিন্তন নবীর নাম। এই কলেমায় মূলমন্ত্রে কখনো এই এলাহ শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ স্রষ্টা ব্যবহার করেননি। কখনো কোন নবীর সময় লা রব্ব ইল্লাল্লাহ বা লা মালেক ইল্লাল্লাহ বা তার নিরানব্বই নামের যে কোনটা হোতে পারতো। কিন্তু তিনি তার লক্ষাধিক নবীর- কোন নবীর সময়ের কালেমাতেই ঐ এলাহ ছাড়া অন্য কোন নাম ব্যবহার করেননি। কেন? এই জন্য যে তিনি ‘একমাত্র' যার আদেশ নিষেধ ছাড়া আর কারো আদেশ নিষেধ গ্রাহ্য নয়। অর্থাৎ কেউ যদি কতগুলি আদেশ নির্দেশ মেনে নিলো কিন্তু অন্য কতকগুলি অস্বীকার করলো, তবে তিনি আর তার এলাহ রোইলেন না। এটা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। কারণ যে রকম জীবন-ব্যবস্থা অনুসরণ কোরলে মানুষ পৃথিবীতে গোলমাল, অশান্তি, অবিচার, অন্যায়, যুদ্ধ ও রক্তপাত করা থেকে অব্যাহতি পাবে সে রকম জীবন-ব্যবস্থায় রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাই যে মূখ্য ও প্রধান হবে এ কথা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায়। তাই আল্লাহ(Allah) নবীদের মাধ্যমে মানুষের জন্য যে জীবন-ব্যবস্থা পাঠালেন তার কালেমা, মূলমন্ত্র স্থির কোরে দিলেন- তাকে একমাত্র বিধানদাতা বোলে স্বীকার করার ভিত্তিতে।

জীবন-বিধানের এই ভিত্তিটাকে অর্থাৎ একেশ্বরবাদ, তাওহীদকে স্রষ্টা এত গুরুত্ব দিয়েছেন যে, সেই আদম (আঃ) থেকে শুরু কোরে তার শেষনবী মোহাম্মদ (দঃ) পর্য্যন্ত প্রত্যেককে পাঠানো হোয়েছে ঐ এক দাবী দিয়ে- আমাকে ছাড়া কাউকে প্রভু বোলে, এলাহ বোলে মানবে না। অন্য কারো দেয়া বিধান, আদেশ-নিষেধ মানবে না। মানলে তাদের আমি কিছুতেই মাফ করবো না। কিন্তু ঐ একটি মাত্র দাবী মেনে নিলে আর কোন গোনাহ পাপের জন্য শাস্তি দেব না (কোরান- সূরা আন নিসা ৪৮, ১১০, ১১৬)। আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয় এ যেন এক উন্নাসিক, অহংকারী, একনায়কের তোষামুদির দাবী। কিন্তু তাই কি? যদি তার এই মহাকাশ, মহাসৃষ্টির দিকে তাকাই তখন দেখি কী অসম্ভব বিরাট এই সৃষ্টি। শুধু যে ছায়া পথের (Milky way অর্থাৎ Galaxy) মধ্যে আমাদের এই সৌরজগত, এইটাই এত বড় যে এর ঠিক কোনখানটায় আমরা আছি তা সঠিক কোরে নির্দ্ধারণ আজ পর্য্যন্ত বিজ্ঞানীরা কোরতে পারেননি। অথচ এই Galaxy আরো কত কোটি কোটি আছে যার সংখ্যা করা অসম্ভব। আজ পর্য্যন্ত এই মহাসৃষ্টির সীমা পাওয়া যায়নি। মানুষ এ পর্য্যন্ত সবচেয়ে দূরের যে জিনিষটির সন্ধান পেয়েছে তা দু'হাজার কোটি আলোক বর্ষ দূরের একটি কোয়াসার (Quasar)। কিছুদিন আগে অষ্ট্রেলিয়ার একটি মান-মন্দিরে এর অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। কোন কিছু সেকেণ্ডে এক লক্ষ ছিয়াশী হাজার চারশ' মাইল বেগে চলতে থাকলে তা দুই হাজার কোটি বছর পরে ঐ কোয়াসারে যেয়ে পৌঁছতে পারবে। কি অসম্ভব দূরত্ব, কল্পনা করা যায় না, ধারণা করা যায় না। ঐ কোয়াসারের পরেও আরও কত সৃষ্টি আছে কেউ জানে না। এই অচিন্তনীয় বিশাল সৃষ্টির মধ্যে আমাদের পৃথিবী তো দূরের কথা, এই সৌরজগত যেটার মধ্যে আমরা আছি এর অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। এই সৃষ্টির যিনি স্রষ্টা তার কী এত প্রয়োজন পড়লো আমাদের মত কীটানুকীটের কাছ থেকে তার প্রভূত্বের স্বীকৃতি নেবার? আমরা তাকে অস্বীকার কোরে অন্য যাকে খুশী এলাহ বোলে মেনে নেই, তাতে তার কী আসবে- যাবে? তার দেয়া পথ বর্জন কোরে নিজেরাই যদি পথ তৈরী কোরে নেই, তাতেই বা তার কী ক্ষতি বৃদ্ধি হবে?

আসল কথা হলো- তার কিছুই হবে না, তার কিছুই আসে যাবে না। তিনি জানেন তার পাঠানো জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ না কোরে, নিজেরা তা তৈরী কোরে তা মেনে চললে তার নিজের হাতের গড়া, তার অতি স্নেহের সৃষ্টি মানুষ অশান্তি আর রক্তপাতে ডুবে থাকবে। তাই তিনি চান মানুষ তার দেয়া জীবন-ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করুক এবং পরিণামে শান্তিতে পৃথিবীতে বসবাস করুক। যেহেতু তাকে একমাত্র প্রভু, এলাহ বোলে স্বীকার ও বিশ্বাস না কোরে নিলে তার পাঠানো জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা ওঠেনা তাই ওর ওপর, তওহীদ, একেশ্বরবাদের ওপর এত কড়াকড়ি। এ কড়াকড়ি আমাদের অশান্তি, অত্যাচার, রক্তারক্তি থেকে বাঁচাবার জন্য ভালবাসার কড়াকড়ি। আল্লাহ(Allah)কে একমাত্র বিধান দাতা বোলে স্বীকার ও বিশ্বাস কোরে নেয়াই হোল আদম (আঃ) থেকে মোহাম্মদ (দঃ) পর্য্যন্ত সমস্ত দ্বীনের, ধর্মের ভিত্তি। এই হোচ্ছে দীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম, সেরাতুল মুস্তাকীম। এটা স্বতঃস্ফুর্ত যে তাকে একমাত্র জীবন-বিধাতা বোলে মেনে নেয়ার পর আর অন্য কারো তৈরী বিধান গ্রহণযোগ্য হোতে পারে না। এবং শুধু এইটুকুই তিনি চান আমাদের কাছে।

এখন দেখা যাক এই যে জীবন-ব্যবস্থা স্রষ্টা যুগে যুগে পাঠিয়েছেন এটা কি? লক্ষ্য কোরলে দেখা যায় এর ভিত্তি ঐ একত্ববাদ তাওহীদ যা চিরস্থায়ী। অন্যভাগ আদেশ-নিষেধ যেগুলি মেনে চললে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমষ্টিগতভাবে মানুষ পরিপূর্ণ শান্তিতে, প্রগতিতে বাস কোরতে পারে। এই দ্বিতীয় ভাগটি চিরস্থায়ী, সনাতন নয়, এটি স্থান ও কালের উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সময়ে তিনি তার নবী পাঠিয়ে যে জীবন-ব্যবস্থা দিয়েছেন তাতে স্বভাবতঃই স্থান, কাল, পাত্র ও সমস্যাভেদে বিভিন্ন নির্দেশ থেকেছে।আরও দু'টি ভাগ এতে সব সময় থেকেছে- সেটা উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়ার ভাগ। উদ্দেশ্য সব সময়ই একই থেকেছে-শান্তিতে সুবিচারে বসবাস এবং এ উদ্দেশ্য অর্জন কোরতে যে সমস্ত প্রক্রিয়া অবশ্য কর্তব্য। এই প্রধান চারটি ভাগকে একত্র কোরে দেখলে পরিস্ফুট হোয়ে উঠবে যে, আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন-ব্যবস্থা মানুষের সমগ্র জীবনের প্রতিটি বিষয়বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ কোরবে। তা যদি না হতো তবে তা মানুষের জন্য জীবন-বিধান হোতে পারতো না, হোলেও অসম্পূর্ণ ও আংশিক হোত। অর্থাৎ আল্লাহ(Allah)কে একমাত্র জীবন-বিধাতা স্বীকার ও গ্রহণ করার পর জীবনের কোন অঙ্গনে (Facet) অন্য কোন বিধান অর্থাৎ আইন স্বীকার করার অর্থ হলো তাকে ছাড়াও অন্য বিধাতা স্বীকার কোরে নেওয়া- শেরক।

এই যে যুগে যুগে প্রভু আল্লাহ(Allah) আমাদের জন্য জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন তা তিনি পাঠিয়েছেন তার নবীদের মাধ্যমে- যারা আমাদেরই মত মানুষ। এখানে একটা সমস্যা এসে দাঁড়ায়। যেহেতু ঐ প্রেরিতরা আমাদের মতই মানুষ কাজেই যখন তারা ঘোষণা কোরেছেন যে তাকে জীবন-বিধান দিয়ে পাঠানো হোয়েছে তখন তার কথা সত্য কি মিথ্যা তা স্বভাবতঃই প্রশ্নের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ যদি এ কথা প্রশ্ন কোরে যে, এই লোকটি তার কোন ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারের জন্য, নেতৃত্ব লাভের জন্য, বা তার মনগড়া কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য স্রষ্টার দোহাই দিচ্ছে না তার প্রমাণ কি? এ প্রশ্ন অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ নেই। কাজেই আল্লাহ(Allah) এ ব্যাপারেও তার নিজের সম্বন্ধে যে রকমের ব্যবস্থা নিয়েছেন তার প্রেরিতদের সম্বন্ধেও সেই রকম ব্যবস্থা নিলেন। অর্থাৎ চিহ্ন। তিনি তার প্রেরিতদের মধ্যে, তাদের কাজের মধ্যে এমন সব চিহ্ন দিয়ে দিলেন যা যে কোন যুক্তিসম্পন্ন মানুষের সন্দেহ নিরসন করার জন্য যথেষ্ঠ। সংগত কারণে তিনি তার প্রতিটি নবীকেই অলৌকিক শক্তি দিলেন যা সাধারণ মানুষের থাকে না। এগুলোর নাম তিনি দিলেন চিহ্ন- আয়াত। আমরা এখন বলি মো'জেজা, অলৌকিক ঘটনা। যাদের জন্য এই নবীরা জীবন-ব্যবস্থা, দ্বীন নিয়ে এসেছেন তারা তার কথায় সন্দেহ বা অবিশ্বাস কোরলে তিনি ঐ অলৌকিক কাজ কোরে তাদের সন্দেহ অপনোদন কোরেছেন।

এমনি কোরে যুগে যুগে, যখনই জাতি জনগোষ্ঠী আল্লাহ(Allah)র দেয়া ব্যবস্থা হয় ত্যাগ কোরেছে না হয় তাকে এমন বিকৃত কোরে ফেলেছে যে তা আর তাদের শান্তি, ইসলাম(Islam) দিতে পারেনি, তখনই স্রষ্টা তার করুনায় আরেক নবী পাঠিয়েছেন (হাদীস- ইবনে মাসুদ (রাঃ) থেকে মুসলিম(Muslim), মেশকাত )। তিনি এসে বোলেছেন- তোমরা আমার পূর্ববর্ত্তি নবীর আনা জীবন-বিধান বিকৃত কোরে ফেলেছো। তাই আমাকে পাঠানো হয়েছে তোমাদের জন্য নতুন বিধান দিয়ে। শুভ-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ এই নতুন প্রেরিতের কথায়, কাজে তার জীবন-ধারায় ও তার অলৌকিক কাজ করার শক্তি দেখে তাকে বিশ্বাস কোরে এই নতুন জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ কোরেছে। আর কিছু লোক শয়তানের প্ররোচনায় তাকে অস্বীকার করে আগের বিকৃত দ্বীনকে আকড়ে ধোরে রেখেছে। পৃথিবীতে আরেকটি দ্বীন, জীবন-ব্যবস্থার জন্ম হোয়েছে। তারপর কালে ইবলিসের-প্ররোচনায় এই নতুন দ্বীনেও বিকৃতি এসেছে এবং এতখানি বিকৃতি এসেছে যে ওটাও আর মানুষকে সেই চির আকাংখিত শান্তি দিতে পারেনি। তখন আল্লাহ(Allah) আবার এক নতুন রসুল পাঠিয়েছেন- আগের মত কোরে আবার এক দ্বীন, ধর্ম পৃথিবীতে সংযোজন হয়েছে। এমনি কোরে মানব জাতির শান্তির জন্য আল্লাহ(Allah) লক্ষাধিক প্রেরিত পাঠিয়েছেন। উদ্দেশ্য- সেই এক। মানুষ নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি না কোরে, অবিচার না কোরে, যুদ্ধ, রক্তপাত না কোরে পূর্ণ শান্তিতে পৃথিবীতে বসবাস করে। যখনই কোন জনগোষ্ঠী, জাতি কোন প্রেরিতকে বিশ্বাস কোরে আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ কোরে তা তাদের জাতীয়, পারিবারিক, ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা কোরেছে তখন তাদের মধ্যকার সমস্ত অশান্তি, অবিচার, মারামারি, রক্তপাত বন্ধ হোয়ে গেছে। তারা অনাবিল সুখ ও শান্তিতে, ইসলামে(Islam) বাস কোরতে লেগেছে। কিন্তু এই শান্তি চিরস্থায়ী হয়নি, কারণ শয়তানও বোসে ছিল না এবং বোসে নেই। সে অবিশ্রান্তভাবে মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে চলেছে ঐ জীবন-ব্যবস্থাকে বিকৃত কোরে, অচল কোরে দিয়ে পরিণতিতে মানুষকে আবার ঐ ফাসাদ আর রক্তপাতে জড়িত কোরতে এবং কোরেছেও।

অতীতের দিকে ফিরে চাইলে আমরা দেখি যে মূল ভিত্তি আল্লাহ(Allah)র একত্ব ও প্রভুত্ব ঠিক রেখে যুগে যুগে যে ইসলাম(Islam) পৃথিবীতে এসেছে তার রূপ কিছু কিছু বিভিন্ন হোয়েছে- এবং যে সব ব্যাপারে বিভিন্ন হোয়েছে তা সবই স্থান, কাল ও পাত্রের অধীন। উদারহরণ রূপে আদমের (আঃ) ওপর যে ইসলাম(Islam) দেয়া হোয়েছিলো তাতে বিধান ছিলো ভাই-বোনদের মধ্যে বিয়ে। স্বভাবতঃই কারণ তখন তারা ছাড়া পৃথিবীতে আর মানুষ ছিলো না। কিন্তু পরে যখন মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলো, তারা নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়লো, তখন আর সে প্রয়োজন রোইলো না এবং পরবর্তী যে সব নবীরা এলেন তাদের ওপর বিধানগুলিতে ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ কোরে দেয়া হলো। অনুরূপভাবে আস্তে আস্তে যেমন মানুষ নতুন ব্যাপারে জ্ঞান লাভ কোরতে লাগলো, নতুন নতুন আবিষ্কার কোরতে লাগলো, এক কথায় মানুষের যুক্তি, বুদ্ধি উন্নতি কোরতে লাগলো- তেমনি আল্লাহ(Allah)র দেওয়া জীবন-ব্যবস্থাতেও সেগুলির প্রতি লক্ষ্য রেখেই বিধান দেয়া হোতে লাগলো। প্রতিবার যেখানেই নবীরা এসেছেন এবং যেখানকার মানুষ তাদের আনা জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ কোরেছে সেখানে সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে। আর যেখানে মানুষ নবীদের প্রত্যাখ্যান কোরেছে সেখানে তারা অশান্তি, অবিচারে রক্তপাতে ডুবে থেকেছে এবং কালে ধ্বংস হোয়ে গেছে।

একজন নবী একটা জনসম্প্রদায়ে বা জাতিতে যখন প্রেরিত হোয়েছেন তখন তাকে সম্মুখীন হোতে হোয়েছে তার পূর্ববর্তী নবীর বিকৃত ব্যবস্থার অনুসারীদের। পূর্ববর্তী দ্বীনকে বিকৃত করা না হোলে হয়তো তখন তাকে পাঠানোর প্রয়োজনই হতো না। এই দ্বীনগুলি কেমন কোরে বিকৃত হোয়েছে সে সম্বন্ধে একটা ধারণার প্রয়োজন। যখন কোন একজন নবী তার কাজে সফল হোয়েছেন অর্থাৎ তার আনা জীবন-ব্যবস্থা তার সম্প্রদায় বা জাতি গ্রহণ কোরেছে, প্রতিষ্ঠা কোরেছে, তখন তার ফলে সে জাতিতে শান্তি, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে। তিনি পৃথিবী থেকে বিদায়ের পর শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ ঐ ব্যবস্থা বিকৃত কোরতে শুরু কোরেছে। এই বিকৃতিগুলোকে শ্রেণী বিন্যাস কোরলে প্রধান প্রধানগুলো হলো-

ক) নবীর ব্যক্তিত্বে, চরিত্রের মাধুর্যে মুগ্ধ, তার অলৌকিক শক্তিতে অভিভূত তার জাতি, উম্মাহ তাকে অশেষ ভক্তিশ্রদ্ধা কোরেছে। তাদের মধ্যে অনেকে তাকে প্রাণ ভরে ভালও বেসেছে। তার ওফাতের পর ক্রমে ক্রমে এই ভক্তি শ্রদ্ধা ভালবাসা তাকে আরও উপরের আসনে বসাতে চেয়েছে। এটা একটা স্বাভাবিক মানবিক মানসিক বৃত্তি- যে যাকে যত ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে সে তাকে তত বড় কোরে দেখতে চায়, দেখাতে চায়। যদিও রসুল তার জীবিতকালে নিঃসন্দেহে বার বার পরিষ্কার কোরে বোলে গেছেন যে আমি তোমাদের মতই মানুষ, শুধু আমাকে পাঠানো হোয়েছে তোমাদের জন্য জীবন-বিধান দিয়ে, কিছু অলৌকিক শক্তি দিয়ে। কাজেই আমি যা, অর্থাৎ রসুল, এর বেশী আমাকে অন্য কিছু মনে কোরোনা, কোরলে মহা অন্যায় হবে। কিন্তু অতি ভক্তি আর শয়তানের প্ররোচনায় যতই দিন গেছে ততই তাদের নবীকে উপরের দিকে ওঠাতে ওঠাতে শেষ পর্য্যন্ত কোন নবীকে আল্লাহ(Allah)র ছেলে, কোন নবীকে একেবারে আল্লাহ(Allah)র আসনেই বসিয়েছে।

খ) নবীরা চলে যাবার পর তার জাতি, উম্মাহ, তাদের জীবনের ব্যবস্থাটাকে নিয়ে অতি বিশ্লেষণ কোরতে শুরু কোরেছে। যে কোন জিনিষেরই অতি বিশ্লেষণ সে জিনিষটাকে নষ্ট, ধ্বংস কোরে দেয়। তাদের বেলাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অতি বিশ্লেষণের ফলে বিভিন্ন রকমের মতামত গড়ে উঠেছে, সেই মতামতের অনুসারী জুটেছে, জাতি নানা মতে বিভক্ত হোয়ে গেছে। তারপর অবশ্যম্ভাবীরূপে সেই বিভক্ত অর্থাৎ মযহাব ও ফেরকাগুলির মধ্যে সংঘাত ও ফলে ধ্বংস হোয়ে গেছে।

গ) এই অতি বিশ্লেষণের অবশ্যম্ভাবী ফল আরও হোয়েছে। তার একটা হলো জীবন-বিধানের আদেশ-নিষেধগুলির গুরুত্বের ওলট-পালট হোয়ে যাওয়া- অর্থাৎ কোন্‌টা অতি প্রয়োজনীয়, কোনটা তার চেয়ে কম প্রয়োজনীয়, কোনটা বিশেষ প্রয়োজনীয় নয়, এগুলির উল্টা-পাল্টা কোরে ফেলা- যদিও সবগুলিই জীবন-ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত। এক কথায় অগ্রাধিকার (Priority) কোনটা আগে কোনটা পরে। অতি বিশ্লেষণের ফলে জীবন-ব্যবস্থাগুলির যে সব অনুশাসন অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, যার ওপর সমগ্র ব্যবস্থাটার জীবন-মরণ নির্ভর করতো সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় স্থলে নামিয়ে দিয়ে অতি অপ্রয়োজনীয় নির্দেশগুলিকে মহা গুরুত্ব দিয়ে তাই নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হোয়েছে।

ঘ) অতি বিশ্লেষণের আরও এক আত্মঘাতি ফল এই হোয়েছে ঐ জীবন-ব্যবস্থাগুলি যা জাতির সর্বস্তরের মানুষের জন্য এসেছিলো তার ব্যাখ্যা, ইত্যাদি করার অধিকার একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে সীমাবদ্ধ হোয়ে পড়েছে। স্বভাবতঃই- কারণ যে আদেশ নিষেধগুলি জাতির সবার জন্যই অবতীর্ণ হোয়েছে তা সবারই বোধগম্য ছিলো- কিন্তু ওগুলিকে বিশ্লেষণ, অতি-বিশ্লেষণ কোরে জন সাধারণের বোঝার বাইরে নিয়ে যাওয়া হোয়েছে- ফলে ঐ বিশ্লেষণ নিয়ে ঘাটাঘাটি করায় ব্যস্ত ঐ শ্রেণীটির মধ্যে তা আবদ্ধ হোয়ে পড়েছে এবং পরবর্তীতে জীবন-বিধানের সব রকম ব্যাপারে তাদের মতামত হোয়ে দাঁড়িয়েছে চূড়ান্ত।এই হলো পুরোহিত শ্রেণী এবং এমনি কোরেই প্রতি জীবন-বিধানে, প্রতি ধর্মে এরা নিজেরা নিজেদের সৃষ্টি কোরেছেন এবং জীবন-বিধানের মুল লক্ষ্যই বিনষ্ট হোয়ে গেছে। জাতির জনসাধারণ অতি প্রয়োজনীয় উদ্দেশ্য ভুলে যেয়ে পুরোহিতদের কাছে প্রক্রিয়ায় ছোট খাট ব্যাপারগুলি সম্বন্ধে বিধান (ফতোয়া) জানতে চেয়েছে আর পুরোহিতরা অতি উৎসাহে নতুন নতুন দুর্বোধ্য বিধান তৈরী করেছেন আর তা তাদের দিয়েছেন।

ঙ) আরেক রকমের বিকৃতি এসেছে কায়েমী স্বার্থের (Vested Interest) কারণে। প্রথমে নতুন প্রেরিতের ধর্মকে মেনে নিলেও পরে তারা দেখেছে যে তা তাদের কায়েমী স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হোয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন তারা ছলে-বলে, বিধান বিশ্লেষণকারীদের (মুফতি) হাত কোরে ঐ স্বার্থ বিরোধী নির্দেশগুলির পরিবর্তন কোরেছে। ক্রমশঃ সমস্ত জীবন-ব্যবস্থার মুল উদ্দেশ্যই ভুলে যেয়ে ওর খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি পালন করাই একমাত্র কর্তব্য হোয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিটি জীবন ব্যবস্থা ঐসবগুলি কারণের একত্রিত, সম্মিলিত প্রভাবে সম্পূর্ণভাবে বিকৃত হোয়ে গেছে। স্রষ্টা দিয়েছেন মানুষকে একটা প্রাণবন্ত, বেগবান (Dynamic) জীবন ধর্ম। শয়তানের প্ররোচনায়, সেটাকে একটা উদ্দেশ্য-বিহীন, স্থবির, প্রাণহীন, অনুষ্ঠান সর্বস্ব ব্যাপারে পরিণত কোরেছে। ফলে আবার মানুষ অনিবার্যভাবে সেই অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার আর রক্তারক্তির মধ্যে পতিত হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু আল্লাহ(Allah) আবার তার রসুল পাঠিয়েছেন মানুষকে সত্য, ন্যায় পথে ফিরিয়ে আনতে।

উপরোক্ত বিকৃতিগুলি ছাড়াও আরও একটি বিশেষ কারণ হোয়েছে নতুন নবী পাঠানোর। সেটা হলো মানুষ জাতির বিবর্তন। এক নবী থেকে তার পরবর্তী নবী পর্য্যন্ত যে সময় অতীত হোয়েছে, সেই সময়ে মানুষ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে কিছুটা এগিয়ে গেছে। পারিপার্শ্বিকতায় খানিকটা প্রভেদ এসেছে, নতুন সমস্যাও দেখা দিয়েছে। কাজেই পরবর্তী রসুল যে ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন তাতে স্বাভাবিকভাবেই পুর্বের ব্যবস্থা থেকে কিছু ভিন্নতা থেকেছেই, যদিও মৌলিক সত্য, আল্লাহ(Allah)র একত্ব ও সার্বভৌমত্ব, দ্বীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম, সেরাতুল মুস্তাকীম একই থেকেছে। বিভিন্নতাগুলি শুধুমাত্র কম প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলোয় যেগুলি স্থান এবং কালের প্রভাবাধীন।

যখনই কোন নতুন নবী , প্রেরিত এসেছেন তিনি তার জাতিকে যা বোলেছেন তার সারমর্ম, স্থান, কাল, পাত্র ভেদে কিছু এদিক ওদিক ছাড়া- এই যে-

ক) আমার পূর্ববর্তী আল্লাহ(Allah)র রসুল তোমাদের যে দ্বীন, জীবন-ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন, তোমরা সেটাকে নানাভাবে অর্থহীন, অকেজো কোরে দিয়েছে। তোমরা আল্লাহ(Allah)র বইয়ে হাত ঘুরিয়েছো, তোমাদের ইচ্ছামত নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার অর্থ বিকৃত কোরেছো। গুরুত্ব বদলিয়ে অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি কোরেছো। এমন কি একমাত্র প্রভুর সার্বভৌমত্ব নষ্ট কোরে বহুত্ববাদে নিমজ্জিত হোয়েছো। পরম করুণাময় তাই আমায় পাঠিয়েছেন তোমাদের এই বোলতে যে-

খ) তোমরা যাকে অনুসরণ কর বোলে দাবী কর তিনিও তার মাধ্যমে প্রেরিত বইকে আমি স্বীকার কোরেছি (কোরান- সূরা আলে ইমরান ৩, সূরা আল আনাম ৯২, ৯৩)।

গ) কিন্তু তোমরা ওটা এত বিকৃত কোরে ফেলেছো যে তা এখন বাতিল ঘোষণা করছি।

ঘ) এখন থেকে আমি যে বই এবং জীবন-ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি এইটা কার্যকরী হবে।

ঙ) আমি যে সত্যই স্রষ্টার প্রেরিত তা তোমাদের কাছে প্রমান করার জন্য আমাকে কতকগুলি চিহ্ন, আয়াত, মো'জেজা দেয়া হোয়েছে, সেগুলো তোমরা দেখে নাও এবং

চ) আমাকে প্রেরিত, রসুল বোলে স্বীকার কোরে নাও এবং পূর্বের বিকৃত ব্যবস্থা বাদ দিয়ে আমার মাধ্যমে প্রেরিত স্রষ্টার দেয়া এই নতুন জীবন-বিধান গ্রহণ কর।

তার এ ঘোষণার ফল কি হোয়েছে? বিভিন্ন প্রেরিতের জীবনীতে আমরা বিভিন্ন ফল দেখি। কোন রসুলের ডাকে কিছু লোক তাকে বিশ্বাস কোরে তার ধর্ম গ্রহণ কোরেছে, আর কিছু লোক তাকে অবিশ্বাস বা অস্বীকার কোরে আগের সেই অচল ব্যবস্থাকেই আকড়ে ধোরে রেখেছে। কোন নবীর ডাকে অল্প কয়েকজন সাড়া দিয়েছে, বাকিরা আগের বাতিল অনুষ্ঠানগুলিকেই চালু রেখেছে। কোন কোন নবীকে পূর্ববর্তী নবীর অনুসারীরা হত্যা পর্য্যন্ত কোরে ফেলেছে (কোরান- আলে ইমরান ১৮১, ১৮৩)। আবার এমনও হোয়েছে যে কোন নবীকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হোয়েছে এবং হত্যা করা হোয়েছে, কিন্তু তার ওফাতের পর বহু মানুষ তাকে স্বীকার ও বিশ্বাস কোরে তার আনা জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত কোরেছে।

প্রতি নবীর সময় অধিকাংশ মানুষ তাদের হৃদয়ের ভেতরে বুঝতে পেরেছে যে এই লোক সত্যই স্রষ্টার প্রেরিত-রসুল। কারণ তার ব্যক্তিত্বে, চারিত্রিক শক্তিতে প্রবল অসাধারণত্ব তো ছিলোই, তার ওপর চূড়ান্ত প্রমাণ হিসাবে ছিলো, অলৌকিক কাজ কোরে দেখাবার ক্ষমতা, আয়াত, মো'জেজা। কিন্তু তা সত্বেও একদল লোক তাকে স্বীকার কোরে নতুন ইসলাম(Islam)কে গ্রহণ কোরেছে, আরেক দল করেনি।

বিচার কোরলে আমরা দেখতে পাই- যারা স্বীকার কোরেছে তাদের কারণ;

ক) পূববর্তী বিকৃত ইসলামে(Islam) থেকেও যারা তাদের আত্মাকে ইসলিসের প্রভাব থেকে ব্যক্তিগতভাবে কমবেশী মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন এবং যার ফলে দ্বীনের অবনতি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য কোরছিলেন, কিন্তু কিছু করার শক্তি ছিলোনা।

খ) সাধারণ লোক, যারা বিকৃত ব্যবস্থায় নির্য্যাতিত হোয়েও অসহায় অবস্থায় পড়ে ছিলো,

গ) রসুলের ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন ইসলাম(Islam) গ্রহণ কোরলে যে নির্যাতন অবশ্যম্ভাবী তাকে যারা ভয় করেনি আর যারা অস্বীকার কোরেছে তাদের কারন-

ক) পূর্ববর্তী ইসলামে(Islam)র পুরোহিত শ্রেণী, যারা সেই দ্বীনের ধারক, বাহক বোলে নিজেদের মনে কোরতেন। এই শ্রেণীর মনে চিরদিন তাদের জ্ঞানের অহঙ্কার বিদ্যমান ছিলো। স্বভাবতঃই- কারণ তারা সমাজের, জাতির দেয়া চাঁদা, দান ইত্যাদির ওপরই বেঁচে থাকতেন এবং নিরলসভাবে ধর্মের বিধান, নিয়ম, ইত্যাদির বিশ্লেষণ, অতি-বিশ্লেষণ কোরতেন এবং জনসাধারণকে বিধান (ফতোয়া) দিতেন। কঠোর পরিশ্রম কোরে নতুন বিধান সৃষ্টি কোরতেন যাতে অন্যান্য পুরোহিতদের চেয়ে তার জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ হয়। এই পুরোহিত শ্রেণীর মধ্যে বিধান-ব্যবস্থা ইত্যাদি (ফতোয়া) নিয়ে তিক্ত মতভেদ থাকলেও নতুন নবীর ব্যপারে তারা ছিলেন একত্র। কারণ নতুন ইসলাম(Islam)কে মেনে নিলে তাদের ঐ মহা সম্মানিত স্থান থেকে তাদের পতন হবে এ কথা সবার চেতন, অবচেতন উভয় মনই জানতো। যে জ্ঞানের অহংকারের জন্য তাদের মধ্যে অবিশ্রান্ত তর্কাতর্কি, বহাস লেগে থাকতো, সেই অহঙ্কারই তাদের শ্রেণীকে নতুন নবীর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ কোরতো। প্রত্যেকটি নবী সব চেয়ে প্রচণ্ড বাধা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হোয়েছেন এই শ্রেণীটির কাছ থেকে।

খ) যারা পুরোহিত শ্রেণীভুক্ত না হোয়েও অতি নিষ্ঠার সাথে ধর্ম পালন কোরতেন, ঐ পুরোহিত শ্রেণীর সৃষ্ট বিভিন্ন দল বা ফেরকার কোনটি চুলচেড়াভাবে পালন কোরতেন।

গ) আর অস্বীকার কোরছে সাধারণ মানুষদের মধ্যে যারা ঐ পুরোহিত শ্রেণীর আদেশ-নিষেধ মানতে এমন অভ্যস্ত হোয়ে গিয়েছিলো যে ঐ পুরোহিতদের ছাড়া অন্য কারো কথা শোনার সময় ও ইচ্ছা তাদের ছিলো না। এদের মধ্যে অনেকে যদিও বুঝতে পেরেছে যে এই মানুষটি সত্যই নবী, কিন্তু তবুও তাকে স্বীকার ও গ্রহণ কোরলে সমাজে যারা পুরোনো ব্যবস্থা আকড়ে আছে তাদের বিদ্রুপ, নির্যাতন, এমন কি নিজ পরিবারের মধ্যে অশান্তির ভয়ে তারা প্রকাশ্যে নবীকে অস্বীকার কোরেছে।

ঘ) আরো এক ধরনের মানুষ রসুলদের স্বীকার ও গ্রহণ করেনি। এরা হলো তারা যারা প্রথম দিকে বিরোধিতা কোরেছে সত্যই তাকে মিথ্যা মনে কোরে। কিন্তু পরে যখন তার চরিত্র, চিহ্ন-নিদর্শন, অলৌকিক কাজ দেখে বুঝতে পেরেছে যে, আমি তো ভুল কোরেছি- তখন কিন্তু তার প্রবৃত্তি, নফস, রিপু যাই বলুন, তাকে বাঁধা দিয়েছেন। বোলেছে- তুমি যাকে এতদিন, ভণ্ড, মিথ্যাবাদী বোলে লোকজনকে তাকে স্বীকার করা থেকে বাধা দিয়েছো! আজ তার কাছে নত হোলে লোকে হাসবে না? এই যে আপাত দৃষ্টিতে নিজেকে ছোট করা (Loss of face) এ কোরতে না পেরে বহু লোক সত্য জেনেও রসুলের বিরোধিতা কোরেছে- রসুলকে ও তার আনা নতুন ইসলাম(Islam)কে স্বীকার করেনি।

যদিও সত্য নবীকে স্বীকার ও গ্রহণ না করার কয়েকটি বিভিন্ন কারণ উপস্থাপন কোরলাম। কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যায় আসলে সবগুলির মূল কারণ অহঙ্কার-(Pride, Vanity)। এই কারণেই প্রতি ধর্মে বারবার বলা হোয়েছে যে যার মধ্যে বিন্দুমাত্র অহঙ্কার থাকবে সে মুক্তি পাবে না। মানুষের মধ্যে যে ষড়রিপুর কথা বলা হয়, তার একটা অহংকার। আশ্চর্য কি- এই ষড়রিপু, অর্থাৎ ছয়টা প্রবৃত্তির মধ্যে পাঁচটা আল্লাহ(Allah)র মধ্যে নেই, শুধু মানুষের মধ্যে আছে। আর ষষ্ঠটা অর্থাৎ অহঙ্কার স্বয়ং আল্লাহ(Allah)র মধ্যে আছে এবং এটা শুধু তারই সাজে, মানুষের নয়। তাই অহঙ্কারের শাস্তি অতি দ্রুত এবং এ জীবনেই। আমার মনে হয় দিনের আলোর মত প্রোজ্জল সত্যকেও অস্বীকার করাবার জন্য অহংকারের মত শক্তিশালী শয়তানী শক্তি আর নেই।

যুগ যুগ ধোরে একটার পর একটা দ্বীন নিয়ে নবীরা কেন অবতীর্ণ হোয়েছেন তা আমরা আলোচনা কোরলাম। কিন্তু সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, বিভিন্ন মনে হোলেও আসলেই সবগুলিই সেই ইসলাম(Islam), দ্বীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতুল মোস্তাকীম, সহজ, সরল, অতি সহজে বোধগম্য, চিরন্তন জীবন-ব্যবস্থা, যা গ্রহণ ও সমষ্টি ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা কোরলে অবশ্যম্ভাবী ফল মানুষের মধ্যে শান্তি, নিরাপত্তা, যা আল্লাহ(Allah) আমাদের জন্য চান।

বর্তমানে ইসলাম(Islam) সম্বন্ধে দু'টি ভুল ধারনা প্রচলিত। একটি হলো মুসলিম(Muslim) বোলে পরিচিত জাতিটি যে ধর্মে বিশ্বাস করে এটিকে বলা হয় ইসলাম(Islam) এবং অন্যান্য ধর্মকে অন্য বিভিন্ন নাম দেয়া হোয়েছে। কিন্তু আসলে আল্লাহ(Allah) আদম (আঃ) থেকে শুরু কোরে শেষ নবী (দঃ) পর্য্যন্ত যতবার যতভাবে জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন সবগুলোরই ঐ একই নাম ইসলাম(Islam), শান্তি অর্থাৎ যে জীবন-বিধান অনুসরণ কোরে চললে মানুষ শান্তিতে সুখে বাস কোরতে পারবে আর অস্বীকার কোরলে তার অবধারিত পরিণতি অশান্তি, রক্তারক্তি, অবিচার। রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক অবিচার- যা মালায়েকরা বোলেছিলেন।

দ্বিতীয়টি হলো এই ধারণা (আকীদা) যে, আল্লাহ(Allah)র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম(Islam)। এটাও ভুল। কারণ আল্লাহ(Allah) ইচ্ছা কোরলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তাকে বিশ্বাস কোরবে। কোন অবিশ্বাসী, কোন সন্দেহকারী, কোন মোশরেক বা মোনাফেক থাকবে না (কোরান- সূরা আল আনা'ম ৩৫, সূরা ইউনুস ১০০)। কাজেই তা নয়। আল্লাহ(Allah) মানুষের মধ্যে তার নিজের আত্মা ফুকে দিয়েছেন অর্থ মানুষের মধ্যে যুক্তির শক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান ও সর্বোপরি স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন, দিয়ে নবী পাঠিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন যে পথে চোললে সে নিজেদের মধ্যে মারামারি, রক্তারক্তি না কোরে শান্তিতে থাকে। এরপর তিনি দেখবেন কে বা কারা তার দেখানো পথে চোলবে আর কে বা কারা তা চোলবে না।

কাজেই আল্লাহ(Allah)র ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম(Islam) নয়। তার দেয়া জীবন-ব্যবস্থাকে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করার ফল হিসাবে যে শান্তি সেই শান্তির নাম ইসলাম(Islam)। মানুষ যদি যেসব নিয়ম, আইনের মধ্যে এই সৃষ্টি হোয়েছে ও চোলছে তা সব জানতো তবে হয়তো মানুষই নিজেদের জন্য এমন জীবন-ব্যবস্থা, ধর্ম তৈরী কোরে নিতে পারতো যা মেনে চোললেও ঐ শান্তি ইসলাম(Islam) আসতে পারতো। কিন্তু মানুষ তা জানে না- তাকে আল্লাহ(Allah) অতখানি জ্ঞান দেননি। তাই স্রষ্টা তাকে বোলে দিয়েছেন কোন পথে চোললে, কেমন জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ কোরলে ঐ অভিষ্ট শান্তি, ইসলাম(Islam) আসবে। বোলে দিয়েছেন তার নবীদের মাধ্যমে। মনুর (আঃ), কৃষ্ণের (আঃ), যুধিষ্ঠিরের (আঃ), ইব্রাহীমের (আঃ), মুসার (আঃ), ঈসার (আঃ) এবং আরও অনেক অনেক নবীদের মাধ্যমে এবং সর্বশেষে মোহম্মদের (দঃ) মাধ্যমে [মনু (নুহ আঃ) কৃষ্ণ (আঃ), যুধিষ্ঠির (ইদরীস আঃ) এরা যে নবী ছিলেন তা আমার গবেষণার ফল, ব্যক্তিগত অভিমত। এ অভিমত আমি অন্য কাউকে গ্রহণ কোরতে জোর কোরছি না ]। কোন প্রাণী হত্যা কোরবনা, কেউ আমার কোট চুরি কোরলে তাকে জোব্বাটাও দিয়ে দিবো, এ অর্থে এ ইসলাম(Islam) নয়। যে ধর্ম ঐ শিক্ষা প্রচার করে তারা সংখ্যায় পৃথিবীতে অন্য সব ধর্মের চেয়ে বেশী- কিন্তু সমস্ত পৃথিবী আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী অশান্তি আর রক্তারক্তিতে লিপ্ত। শুধু তাই নয় ঐ মতে বিশ্বাসীরা এই শতাব্দীতেই দু'বার নিজেদের মধ্যে মহাযুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রায় পনের কোটি মানুষ হত্যা কোরেছে, হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দু'টি কয়েক লক্ষ মানুষসহ ধ্বংস কোরেছে এবং আজ পারামাণবিক অস্ত্র দিয়ে সম্পূর্ণ মানব জাতিটাকেই ধ্বংস করার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।

মানুষকে নিজেদের মধ্যে অশান্তি, অবিচার, মারামারি না কোরে শান্তিতে, ইসলামে(Islam) থাকার জন্য জীবন বিধান দিয়ে আল্লাহ(Allah) যুগে যুগে পৃথিবীর প্রতি স্থানে, প্রতি জনপদে, প্রতি জাতিতে তার প্রেরিতদের, নবীদের পাঠিয়েছেন (কোরান- সূরা আন নহল ৩৬)। মানুষ জাতির কিছু অংশ তা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা কোরেছে কিছু অংশ করেনি। যারা গ্রহণ করেছে তাদের সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি জীবনের সমস্ত কিছুই ঐ ব্যবস্থার নির্দেশে পরিচালিত হোয়েছে। তাদের সামাজের আইনের উৎসই শুধু ঐ জীবন-বিধান বা ধর্মই ছিলো না ঐ বিধানই আইন ছিলো, ওর বাইরের কোন আইন সমাজ গ্রহণ করতো না। অনেক কারণে (বিকৃতির কারণগুলো পেছনে বোলে এসেছি) আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন-বিধান বদলিয়ে ফেলে বা ইচ্ছামত তার ভুল ব্যাখ্যা কোরে তা চালানো হোয়েছে। কিন্তু ঐ ভুল ও অন্যায় আইনকেও সেই ধর্ম বা দ্বীনের আইন বোলেই চালানো হোয়েছে। তার বাইরের মানুষের তৈরী বোলে চালানো যায়নি। পৃথিবীর ইতিহাসকে না তলিয়ে, শুধু এক নজরে যারা পড়েছেন তারাও এ কথা অস্বীকার কোরতে পারবেন না যে মানব সমাজ চিরদিন শাসিত হোয়ে এসেছে ধর্মের আইন দিয়ে। যখন যেখানে যে নবী ধর্ম বা জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা কোরেছেন, সেখানে রাজা বা শাসনকর্তা শাসন কোরেছেন সেই আইন দিয়ে- অন্য কোন কিছু দিয়ে নয়। আইনের নির্দেশ, উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা কোরেছেন সমাজের বিজ্ঞেরা, পুরোহিতরা, আর তাকে প্রয়োগ করেছেন রাজারা, শাসকরা। ওর বাইরের কোন আইন, আদেশ চালাবার চেষ্টা কোরলে সমাজ তা গ্রহণ করতো না, প্রয়োজনে বিদ্রোহ করতো। উদাহরণ হিসাবে পশ্চিম এশিয়া নিন। ইহুদীদের আগে ওখানে আমন বা রা দেবতা থেকে শুরু কোরে অনেক রকম দেব-দেবীর ধর্মের আইন চলতো। ওগুলোও পূর্বর্তন কোন নবীর আনা দ্বীনের বিকৃতির ফল ছিলো। ইব্রাহীম (আঃ) আবার আল্লাহ(Allah)র একত্ববাদ, তওহীদ প্রতিষ্ঠা করার পর ইহুদীরা যতদিন মধ্য এশিয়ায় ছিলো ততদিন ঐ আল্লাহ(Allah) প্রেরিত দ্বীনই ছিল তাদের জাতির আইন। ভারতের কথা ধরুন। রামায়ন, মহাভারতসহ ইতিহাস পড়ূন। দেখবেন রাজারা শাসন কোরেছেন শাস্ত্রানুযায়ী- অর্থাৎ ওটাই ছিলো শাসনতন্ত্র (Constitution)। ঐশ্বরিক বইয়ের (Scripture) ওপর ভিত্তি কোরে শাস্ত্র, সেই শাস্ত্রের বিধান দিতেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা এবং বিধান বা আইন জনগণের ওপর প্রয়োগ ও তার রক্ষার দায়িত্ব ছিলো ক্ষত্রিয় রাজাদের ওপর। এই শাস্ত্রীয় বিধানের বিরুদ্ধে কোন আদেশ, নির্দেশ দেয়া রাজা বা শাসকের সাধ্য ছিলো না। ইউরোপের অবস্থাও তাই ছিলো। পোপের নির্দেশে রাজ্য শাসন কোরতেন রাজারা। কোন রাজা পোপের নির্দেশ অমান্য কোরতে পারতেন না- কোরলে তার দুরাবস্থার সীমা থাকতো না। মোট কথা পৃথিবীর কোথাও আইনের উৎস ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুকে গ্রহণ করা হয়নি।

প্রশ্ন হোতে পারে, তাই যদি হয় তবে আল্লাহ(Allah)র তওহীদের বিরোধী মুর্ত্তিপূজা তাহলে কোথা থেকে এলো, গ্রীকদের গণতন্ত্রই বা কেমন কোরে গজালো? এর জবাবে দ্বীনের বিকৃতি সম্বন্ধে যে পেছনে লিখে এসেছি তা লক্ষ্য করুন। শয়তানের প্ররোচনায়, নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির উদ্দেশ্যে অমলিন একত্বকে মুখে স্বীকার কোরেও কাজে বহুর পূজা একটা। কিন্তু এই মূর্ত্তির বা বহুর পূজা বা উপাসনাকেও কিন্তু স্রষ্টার, আল্লাহ(Allah)র ধর্মের নামে, তাদের ওপর যে রসুল এসেছিলেন তারই নামে চালাতে হোয়েছে- এই আমার বক্তব্য। আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীকরা গণতন্ত্র নিয়ে যে একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোরেছিলেন তা ছিলো ক্ষণস্থায়ী ও অতি ছোট শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেটাও ধর্ম থেকে আলাদা হোয়ে করা হোয়েছিলো তার কোন প্রমাণ নেই। বরং তখনকার দিনের শিল্প, দেব-দেবীর মুর্ত্তির, মন্দিরের যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে ধর্মের শক্তিশালী প্রভাবই পাওয়া যায়। যদি ধোরেও নেয়া যায় যে গণতন্ত্রের ঐ পরীক্ষা ধর্ম-নিরপেক্ষ ছিলো, তা হোলেও তা মানুষের হাজার হাজার বছরের ধর্মের ইতিহাসে এক ফোটার বেশী জায়গা নিতে পারে না।

এ পর্য্যন্ত যা বোলে এলাম, তা সমস্তটা একত্র কোরলে আমরা একটা পরিষ্কার ছবি পাই। সেটা হলো- গোটা পৃথিবীটাকে পটভূমি হিসাবে নিয়ে মানুষ সৃষ্টির সময় থেকে যদি আরম্ভ করি তবে দেখতে পাই যে প্রথম মানব আদম (আঃ) আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন-বিধান, দ্বীন ইসলাম(Islam) অনুযায়ী চলতে লাগলেন তার সন্তান-সন্তুতি নিয়ে এবং ফলে শান্তিতে বাস কোরতে থাকলেন। ইবলিস তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী চেষ্টা চালাতে লাগলো সেই জীবন ব্যবস্থা থেকে মানুষকে বিচ্যুত কোরতে। মানুষেরই ভেতরে বোসে তাকে প্ররোচনা দিয়ে আইন ভঙ্গ করাতে। হাবলকে দিয়ে তার ভাই কাবলকে হত্যা করালো। তারপর আরো আইন ভাঙ্গার ফলে যখন ওটা যথেষ্ট বিকৃত হোয়ে গেলো তখন আল্লাহ(Allah) পাঠালেন দ্বিতীয় রসুল। তার ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করলো অনেকে রোয়ে গেলো সেই পুরোনো ব্যবস্থায়- যেটা ছিলো আদমের (আঃ) ওপর দেয়া। সৃষ্টি হলো দু'টো দ্বীন, দু'টো ধর্ম, দু'টো জীবন-ব্যবস্থা। এদিকে মানুষের বংশ বৃদ্ধি চলছেই। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়লো আদম সন্তানরা পৃথিবীর চারিদিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যেখানেই তারা বসতি স্থাপন করলো সেখানেই আসতে লাগলেন প্রেরিত নবীরা আল্লাহ(Allah)র দেয়া দ্বীনুল কাইয়্যেমা, সনাতন ধর্ম নিয়ে। উদ্দেশ্য সেই একই- মানুষ যেন নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি না কোরে, রক্তপাত না কোরে শান্তি ও সুখে বাস কোরতে পারে। একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নবী উপস্থিত ছিলেন। কেউ হয়তো চীনের এক প্রান্তে, কেউ দক্ষিণ আমেরিকায়, কেউ ইউরোপে, কেউ মধ্য এশিয়ায়, কেউ ভারতের কোন কোণে। আল্লাহ(Allah) তার দায়িত্ব এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যাননি। যুগ বয়ে চলেছে, নবীরা মানুষের জন্য জীবন-ধর্ম দিয়ে চলে যাচ্ছেন, শয়তান মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে সেগুলো বিকৃত, অকেজো কোরে ফেলছে। তারা আবার আসছেন আবার নতুন কোরে জীবন পথ দিচ্ছেন, নতুন ধর্ম সৃষ্টি হোয়ে চলেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই অতীতে হারিয়ে গেছেন। তারাও হারিয়ে গেছেন, তাদের মাধ্যমে প্রেরিত জীবন-ব্যবস্থা গুলিও হারিয়ে গেছে। আমরা পেছন দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, তাদের আনা ইসলাম(Islam)কেও দেখতে পাই। পাই, কিন্তু অত্যন্ত অস্পষ্টভাবে এবং মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে বিকৃতভাবে।

এই হলো মানুষের প্রকৃত অতীত। ইতিহাসকে বহুলোক বহুভাবে ব্যাখ্যা কোরেছেন। কিন্তু সত্য গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান, ন্যায় ও অন্যায়ের অবিরাম দ্বন্দ্ব, সমষ্টি ও ব্যক্তিগতভাবে মানুষের আত্মাকে একদিকে ইবলিস অন্যদিকে আল্লাহ(Allah)র আত্মা, রুহাল্লাহর টানাটানি- এই হলো আদম (আঃ) থেকে শুরু কোরে আজ পর্য্যন্ত মানুষের সত্যিকার অতীত। এবং এ শুধু অতীত নয় ভবিষ্যতও নিঃসন্দেহে এই-ই। এর কোন বিরতি, কোন চ্যুতি হয়নি, হোচ্ছে না, হবে না। কার্ল মার্কসের ইতিহাসের ব্যাখ্যা অর্থাৎ শ্রেণী সংগ্রাম থেকে শুরু কোরে বহু দার্শনিক বহু রকমের ব্যাখ্যা কোরেছেন। এর কোনটাই গোটা সত্য নয়- খুব হোলে আংশিক সত্য এবং অত্যন্ত ছোট আংশিক। শ্রেণী সংগ্রাম যদি শেষ হোয়ে যায় (মার্কস যে শ্রেণীহীন সমাজ পৃথিবীতে দেখতে চান যদি বাস্তবায়িত হয়ও) সেদিন মার্কসের ইতিহাস ও তার ব্যাখ্যা দুইই স্তব্ধ, মুক হোয়ে যাবে। অন্যান্য সব ব্যাখ্যা সম্বন্ধেও এই একই কথা বলা যায়। যে ব্যাখ্যা মানুষের ইতিহাসের একটি বিশেষ সময় পর্য্যন্ত, অর্থাৎ অতীত, তা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হোতে পারেনা। ইতিহাসের মতই সে প্রকৃত ব্যাখ্যাও ইতিহাসের শেষ পর্য্যন্ত একই থাকতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই: