বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১১

১৯। নামাযের উদ্দেশ্য

উৎস: Islam and Dajjal
এ পর্য্যন্ত যতটুকু লিখেছি তা উন্মুক্ত ও সত্যান্বেষী মন নিয়ে যদি পড়ে থাকেন তবে ইতিমধ্যেই আপনার কাছে পরিষ্কার হোয়ে গেছে যে বিশ্বনবী (দঃ) মানব জাতিকে যে জীবন বিধান দ্বীন-ই ইসলাম(Islam) দিয়ে গেছেন সেটা, আর আজ আমরা যেটাকে দ্বীন-ই ইসলাম(Islam) মনে কোরছি, নিষ্ঠা ভরে পালন কোরছি, এই দুটো শুধু সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস নয়, দু'টো পরস্পর বিরোধী। মহানবী (দঃ) তার আসহাবদের যা শিক্ষা দিয়েছেন আজ আমাদের ওলামায়ে দ্বীন, পীর মাশায়েখরা তার ঠিক উল্টো শিক্ষা দেন। যদি আপনি এ কথায় একমত না হন তবে আমি পরিষ্কার কোরে বুঝিয়ে লিখতে পারিনি, তাহোলে আমার অক্ষমতার জন্য আমিই দায়ী। তবে কথা আছে। এই জাতি যেটাকে ইসলাম(Islam) বোলে মনে করে সেটা প্রকৃত ইসলাম(Islam) থেকে এত বিকৃত যে প্রকৃতটা বোঝানো অতি কঠিন হোয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর আবার আমার ভাষার ওপর অত দখল নেই যে পরিষ্কার কোরে বোঝাতে পারি। তবু চেষ্টা আমাকে কোরে যেতেই হবে। ভাষার অক্ষমতা সত্ত্বেও আমি কী বোলতে চেষ্টা কোরছি তা কিছু সংখ্যক মানুষও বুঝতে পারলে আমার দায়িত্ব অন্ততঃ কিছুটা পালন করা হবে। আমাদের আজ যারা ইসলাম(Islam) শেখান তাদের ইসলাম(Islam) সম্বন্ধে আকীদা বিকৃত। এই দ্বীনের উদ্দেশ্য কি, ঐ উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া কি দ্বীনের মূল্যবোধের গুরুত্ব অর্থাৎ Priority কি এসব তাদের বিকৃত, উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। এরা ওয়াজ করেন, শিক্ষা দেন-নামায পড়ো নামায পড়ো, যেন নামাযই উদ্দেশ্য। নামায উদ্দেশ্য নয়, নামায প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া। আল্লাহ(Allah)র এই বিরাট বিপুল সৃষ্টির মধ্যে এমন একটি জিনিস নেই যা উদ্দেশ্যহীন। যা কিছু উদ্দেশ্যহীন তাই অর্থহীন। যে নামাযকে আল্লাহ(Allah) কোরানে আশি বারের চেয়েও বেশী উল্লেখ কোরেছেন তা কি অর্থহীন হোতে পারে? অবশ্যই নয়। তাহোলে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিষ নামায এর অর্থ কি, উদ্দেশ্য কি? এরা বলেন নামায এবাদত। এরা এবাদতের অর্থ বোঝেন না। এবাদত তো অনেক কিছুই, যে জন্য মানুষ সৃষ্টি কোরেছেন সেগুলো এবং আল্লাহ(Allah) রাসূলের (দঃ) নিষিদ্ধ কাজ ছাড়া আর সবই তো এবাদত। আল্লাহ(Allah)তো ওগুলোকে অত গুরুত্ব দেননি। আশি বারের বেশী বলেননি। অন্য দল বলেন, নামায হলো আল্লাহ(Allah)কে প্রভু বোলে স্বীকার করা, তাকে সাজদা করা। এর কোনটাই নয়। এই বিশাল অসীম সৃষ্টির যিনি স্রষ্টা, তিনি বে-নেয়ায। কারো কাছ থেকে কোন কিছুর তার দরকার নেই। তিনি কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন। আমরা তাকে স্বীকার-বিশ্বাস করি কি করিনা তাতে তার কণা মাত্র আসে যায় না। সেই প্রবল প্রতাপ মহান প্রভু আমাদের নামাযেরও বিন্দুমাত্র মুখাপেক্ষী নন। তিনি আমাদের সালাত প্রতিষ্ঠা কোরতে আদেশ দিয়েছেন আমাদেরই কল্যাণের জন্য, তার নিজের কোন উপকারের জন্য নয়। আমাদের কল্যাণ অর্থ মানব জাতির কল্যাণ, শুধু মোমেনদের, মুসলিম(Muslim)দের কল্যাণ নয়। কেমন কোরে তা ব্যাখ্যা কোরছি।

পেছনে বোলে এসেছি যে সমস্ত পৃথিবীতে যত রকম জীবন-ব্যবস্থা অর্থাৎ দ্বীন আছে সে সমস্ত গুলিকে বাতিল, নিস্ক্রীয়, বিলুপ্ত কোরে এই শেষ ইসলাম(Islam)কে মানব জাতির উপর কার্যকরী কোরে পৃথিবীময় শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য শেষ নবীকে(দঃ) আল্লাহ(Allah) পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন (কোরান-সূরা আত-তওবা- ৩৩, আল-ফাতাহ- ২৮, সূরা আস-সফ্-৯)। তার জীবনী ও ইতিহাস সাক্ষী যে, তার পুত-পবিত্র জীবন ঐ একটি মাত্র কাজে ব্যয় হোয়েছে। দু'টি কথা অতি পরিষ্কার। একটা হোচ্ছে, এক জীবনে ঐ কাজ অসম্ভব, এটা অতি মুর্খেও বুঝবে। দ্বিতীয়টি হোচ্ছে আল্লাহ(Allah)ও জানেন তার রসুলও (দঃ)জানতেন যে পৃথিবীর মানুষকে বিণীতভাবে এই শেষ দ্বীনকে গ্রহণ কোরতে ডাকলেই তারা গদ গদ হোয়ে তাদের বিকৃত ও অন্যায় জীবন-ব্যবস্থা, দ্বীন ত্যাগ কোরে চলে আসবে না। শয়তান, ইবলিস- যে আল্লাহ(Allah)কে চ্যালেঞ্জ কোরে রেখেছে সে-অত দুর্বল নয়। সে সর্বশক্তি দিয়ে মানুষকে প্ররোচিত কোরবে এই দ্বীনের বিরোধিতা কোরতে এবং সে বিরোধিতা সর্ব উপায়ে এবং সশস্ত্রভাবে। প্রথমটির জন্য সমাধান এই হলো যে বিশ্বনবী (দঃ)আল্লাহ(Allah)র নির্দেশ অনুযায়ী একটি জাতি সৃষ্টি কোরলেন- যার নাম হলো উম্মতে মোহাম্মদী এবং তাকে নির্দেশ দিলেন যে পৃথিবী থেকে তার চলে যাবার পর তারা যেন তার সেই সংগ্রাম তেমনি চালিয়ে যায়, যেমন তারা তাঁর বর্তমানে তার (দঃ) সঙ্গে থেকেই চালিয়েছে। এটিই হোচ্ছে তার সুন্নাহ। বোললেন আর এই সুন্নাহ যে ত্যাগ কোরবে সে তার (দঃ) কেউ নয়, তিনি (দঃ) তার কেউ নন (হাদীস)। দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান হলো এই যে, যে জাতিটি তিনি সৃষ্টি কোরলেন সে জাতিটি যেন ঐক্যে, উদ্দেশ্য অর্জনের আপোষহীন সংকল্পে, শৃংখলায়, আত্মত্যাগে, মহত্ত্বে এবং সর্বোপরি যুদ্ধবিদ্যায় এমন পারদর্শী ও দক্ষ হয় যে সে জাতি অপরাজেয় হোয়ে যায়। জাতিটির ঐ চরিত্র সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া হলো সালাত, যাকে আমরা ফারসি ভাষায় বলি নামায। আল্লাহ(Allah)র দেয়া দায়িত্বকে উপলব্ধি কোরে বিশ্ব নবী (দঃ) বোললেন, "আমি (আল্লাহ(Allah)র) আদেশ প্রাপ্ত হোয়েছি সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্য্যন্ত না সমস্ত পৃথিবীর মানুষ স্বীকার করে যে বিধানদাতা (এলাহ) একমাত্র আল্লাহ(Allah) ছাড়া আর কেউ নয়, আমি তার রসুল, সালাত কায়েম করে এবং যাকাত দেয় [হাদীস আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) থেকে বোখারী, মেশকাত]।" এই হাদীসে দু'টি পয়েন্ট লক্ষ্য করার আছে- প্রথমটি হোচ্ছে রসুলুল্লাহ (দঃ) যে শব্দটি এখানে ব্যবহার কোরলেন তা ‘জেহাদ' নয় ‘কিতাল' অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রাম, যুদ্ধ। দ্বিতীয়টি হলো ঐ সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্য হোচ্ছে, (ক) বিধান দাতা (এলাহ) হিসাবে একমাত্র আল্লাহ(Allah)কে স্বীকার কোরে নিতে মানব জাতিকে বাধ্য করা অর্থাৎ আল্লাহ(Allah)র সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, অন্য সর্বপ্রকার বিধান প্রত্যাখান করা, (খ) সালাত প্রতিষ্ঠা করা, ও (গ) যাকাত দেয়া। অর্থাৎ পেছনে যে বার বার দ্বীনুল কাইয়্যেমার কথা বোলে এসেছি সেই দ্বীনুল কাইয়্যেমা সেরাতুল মুস্তাকীম (কোরান- সূরা আল-বাইয়ানা-৫)। এই দ্বীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতুল মুস্তাকীমকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরতে যে সংগ্রাম কোরতে হবে সেই সংগ্রাম করার জন্য যে চরিত্র প্রয়োজন সেই চরিত্র সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া হলো সালাত।

পৃথিবীর প্রত্যেকটি কাজের দু'টি ভাগ থাকে, একটি উদ্দেশ্য অন্যটি ঐ উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া। এই শেষ ইসলাম(Islam)কে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করা হোচ্ছে উদ্দেশ্য। প্রক্রিয়া হোচ্ছে জেহাদ-সংগ্রাম (সর্ব রকমের সংগ্রাম, বুঝিয়ে, লিখে, বক্তৃতা কোরে, কথা বোলে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে) এবং জেহাদ করার শিক্ষা-প্রশিক্ষণ হোচ্ছে সালাত। অর্থাৎ সালাত উদ্দেশ্য নয় উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ-ট্রেনিং। যদি উদ্দেশ্য ভুলে যাওয়া হয় তবে প্রশিক্ষণ বা প্রক্রিয়ার আর কোন অর্থ থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ ধরুন আপনি দূরে কোন স্থানে যাবেন। যাওয়া আপনার অত্যন্ত জরুরী। মনে করুন যেখানে যাওয়া আপনার অতি প্রয়োজন সে স্থানটা এত দূরে যে হেঁটে যাওয়া যায়না, হয় সাইকেলে না হয় গাড়ীতে যেতে হবে। আপনি সাইকেল বা গাড়ী চালাতে জানেন না। আপনি আপনার উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য একটি গাড়ী বা সাইকেল কিনলেন এবং তা চালাতে শিক্ষা কোরলেন। তাহোলে আপনার উদ্দেশ্য হলো ঐ নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া, প্রক্রিয়া হলো সাইকেল বা গাড়ী এবং ওটা চালানো হলো আপনার প্রশিক্ষণ। মনে করুন যখন আপনি ঐ সাইকেল বা গাড়ী চালানো শিখছেন তখন আপনি আপনার ঐ নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানের কথা ভুলে গেলেন। তাহোলে আপনার ঐ শিক্ষা, সাইকেল বা গাড়ী চালানো সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ, যে কারণে যে উদ্দেশ্যে আপনি ঐ সাইকেল বা গাড়ী চালানো শিখছিলেন তাই-ই আপনার মনে নেই। আপনি সময়ে সাইকেল বা গাড়ী চালানোতে অতি দক্ষ হোলেও আপনার উদ্দেশ্য অর্জিত হবে না। আপনার প্রশিক্ষণ নিরর্থক।

বিশ্বনবী (দঃ) দুনিয়া থেকে চলে যাবার ৬০/৭০ বছর পর্য্যন্ত সালাত সম্বন্ধে উম্মতে মোহাম্মদীর আকীদা ঠিক ও নির্ভূল ছিলো অর্থাৎ এটা উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ। ঐ সময়ের পর এই উম্মাহ তার উদ্দেশ্য ভুলে গেলো এবং জেহাদ ত্যাগ করলো। উদ্দেশ্য ত্যাগ করার পর উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ স্বভাবতঃই অর্থহীন হোয়ে গেলেও ওটাকে ত্যাগ করা হলো না, কারণ কোরান ও হাদীসে এর ওপর গুরুত্ব এত বেশী দেওয়া হোয়েছে যে- একে বাদ দেয়া সম্ভব নয়। তখন সালাতকে অন্য অর্থ করা হলো, অন্য রূপ দেয়া হলো। মহানবীর (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ তার জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ‘জেহাদ'কে বাদ দিয়ে তার ব্যক্তি জীবনের খুঁটিনাটি অভ্যাসগুলিকেই যেমন সুন্নাহ হিসাবে নেওয়া হোয়েছিলো, তেমনি সালাত, নামাযের প্রকৃত অর্থ চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ হিসাবে বাদ দিয়ে একে অন্যান্য ধর্মে উপাসনা বোলতে যা বোঝায় সেই অর্থে নেয়া হলো। অর্থাৎ সালাত আত্মার উন্নতির, আল্লাহ(Allah)র নৈকট্যের প্রক্রিয়া। এই অর্থ এবং বর্তমানের অন্যান্য বিকৃত ধর্মগুলির উপাসনার অর্থের মধ্যে কোন তফাৎই নেই। অন্যান্য ধর্মের আকীদায় ধর্ম অর্থই আধ্যাত্মিক ব্যাপার, দুনিয়ার বিরোধী, সুতরাং উপাসনা অর্থই স্রষ্টাকে পূজা, তার সামনে নত হওয়া, পার্থিব বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে আল্লাহ(Allah)র ধ্যান করা। গবেষণার দরকার নেই, নামাযকে শুধু বাইরে থেকে দেখলেই ঐ আকীদা-ধারণা, হাওয়ায় মিশে যায়। বহু জনসমাবেশে, সামরিক কায়দায় লাইনের পর লাইনে দাঁড়িয়ে সার্জেণ্ট মেজরের (Sergeant-Major) হুকুমের মত ইমামের তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে রুকু, সাজদা কোরে ওঠ-বস কোরে, মনে মনে কোরান আবৃত্তি কোরে, ইমামের হুকুমের সঙ্গে সঙ্গে ডাইনে বাঁয়ে মুখ ঘুরিয়ে আর যাই হোক, নিবিষ্ট মনে যে আল্লাহ(Allah)কে ধ্যান করা যায় না এ সত্য বুঝতে সাধারণ জ্ঞানের (Common Sense) বেশী প্রয়োজন হয় না। যদি সন্দেহ হয় তবে খুব মনসংযোগ কোরে নামায পড়তে চেষ্টা কোরে দেখতে পারেন- দেখবেন নামাযে ভুল হোয়ে যাবে। বর্তমানে যে আকীদায় নামায পড়া হয়, তা নামাযের প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়। নামায একটা ছাঁচ (Mould)। মানুষের বিভিন্ন রকম চরিত্রকে এই ছাঁচে ঢালাই কোরে একটি বিশিষ্ট চরিত্রের জাতি সৃষ্টি করা হোচ্ছে এর উদ্দেশ্য, যে জাতি দিয়ে পৃথিবীতে শেষ ইসলাম(Islam)কে প্রতিষ্ঠা করা হবে, বিশ্বনবীর (দঃ) ওপর আল্লাহ(Allah)র দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করা হবে, পৃথিবীতে পূর্ণ শান্তি (ইসলাম(Islam)) প্রতিষ্ঠিত হবে, তার (দঃ) ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন' উপাধি অর্থবহ হবে। তাই নামায এত গুরুত্বপূর্ণ, তাই আল্লাহ(Allah) ও রসুল একে এতবার তাকিদ দিয়েছেন। যে চরিত্র সৃষ্টি না হোলে জাতি ঐ মহাকর্তব্য পূর্ণ কোরতে পারবেনা সেই চরিত্র সৃষ্টি কত প্রয়োজনীয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই নামাযকে এত গুরুত্ব দেয়া হোয়েছে। কিন্তু নামায উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণ। উদ্দেশ্যই যদি বিসর্জন দেয়া হয় তবে প্রশিক্ষণ অর্থহীন।

সংগ্রামের (সর্ব রকম সংগ্রাম, শুধু সশস্ত্র সংগ্রাম নয়) মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহ(Allah)র আইনের শাসনে আনার মত দুরূহ ও বিরাট কাজের দায়িত্ব যে জাতির ওপর অর্পণ করা আছে তাদের যে চরিত্র প্রয়োজন, যে কোরবানী করার শক্তির প্রয়োজন, যে ঐক্য ও শৃংখলার প্রয়োজন তা সৃষ্টি করে এই নামায। নামাযকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এখানে করা সম্ভব নয়, স্বভাবতঃই, কারণ যে জিনিস একটা জাতির দৈহিক, মানসিক, আত্মিক অবস্থাকে একটি ছাঁচে ফেলে একটি নতুন রূপে, নতুন চরিত্রে রূপান্তরিত করে তাকে এই বইয়ে উপস্থাপিত করার জায়গা নেই। এখানে আমি শুধু একটা রূপরেখা (Outline) পেশ করবো এইজন্য যে, আজ বিকৃত আকীদায় একে যে অন্যান্য ধর্মের অনুকরণে উপাসনা হিসাবে নেয়া হচ্ছে তা এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ও আকীদা থেকে কত দূরে তা দেখানো। নামাযের প্রথম শর্ত ওজু। কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। তারপরই জামাত অর্থাৎ বহু লোকের সমাবেশ। এই সমাবেশ যত বড় হবে তত ভালো, তত সওয়াব। এই দৃষ্টিভঙ্গী এবং বর্তমানের দৃষ্টিভঙ্গীর - অর্থাৎ আল্লাহ(Allah)র ধ্যান করা, আল্লাহ(Allah)তে নিবিষ্ট মনসংযোগ করা- ঠিক বিপরীত। কারণ, জনসমাবেশের মধ্যে থেকে মনসংযোগ (Concentration) করার চেয়ে নির্জনে করা অনেক সহজ, একথা অতি সাধারণ জ্ঞান। তারপর লাইন কোরে সুশৃংখলভাবে লাইনের পর লাইনে দাঁড়ানো। আল্লাহ(Allah)র ধ্যান কোরতে তাকে উপাসনা কোরতে লাইনের পর লাইন লাগাতে হবে এতে যুক্তির কোন স্থান নেই। শুধু তাই নয় ঐ লাইন আবার সামান্য বাঁকা হোলেও নামাযই মকরূহ হোয়ে যাবে। আল্লাহ(Allah)র রসুল (দঃ) নামায শুরু করার আগে নামাযীদের লাইনগুলি ধনুকের ছিলার, (Bow-string) মত নিখুঁত সোজা কোরে নিতেন। ধনুকের ছিলার চেয়ে সোজা আর কোন কিছু হোতে পারে না। নিজ পবিত্র হাতে নামাযীদের কাঁধ ধোরে ধোরে লাইন সোজা কোরতেন (হাদীস- আনাস (রাঃ) থেকে আবু দাউদ মেশকাত)। একদিন সবাই নিখুঁতভঅবে লাইন কোরে দাঁড়াবার পর নবী করিম (দঃ) নামায শুরু কোরতে যাচ্ছেন এমন সময় দেখলেন একজনের বুকটা লাইন থেকে সামান্য সামনে বের হোয়ে আছে। তিনি নামায আরম্ভ না কোরে তাকে ঠিক কোরলেন। বোললেন, "আল্লাহ(Allah)র বান্দারা! তোমাদের লাইনগুলোকে অবশ্যই নিখুঁতভাবে সোজা কোরবে। তা না কোরলে আল্লাহ(Allah) তোমাদের মুখগুলি পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেবেন [হাদীস- নু'মান বিন বশীর (রাঃ) থেকে মুসলীম এবং আবু মসউদ আল আনসারী (রাঃ) থেকে মুসলিম(Muslim), মেশকাত]।" বিশ্বনবীর (দঃ)এই বাণীটি লক্ষ্য করুন। মুখগুলি পেছনে (অর্থাৎ বিপরীত দিকে) ঘুরিয়ে দেবেন। তিনি ব্যাখ্যা করেননি যে, এই ঘোরা হাশরের মাঠে কেয়ামতের দিনে, নাকি এই দুনিয়াতেই। আমার মতে উভয় স্থানেই। বর্তমানে এই জাতির নামাযের লাইন নিখুঁত সোজা হয় না। সোজা করার জন্য মসজিদের মেঝেতে মোযাইকের লাইন কোরেও হয় না বাইরে তো কথাই নেই। এবং নামাযের উদ্দেশ্যও প্রকৃত উদ্দেশ্যের ঠিক বিপরীতই হোয়ে গেছে। মহানবীর (দঃ) বাণী মোতাবেক বর্তমানের নামাযীদের মুখ পেছন দিকে উল্টে গেছে। লাইন সোজা করার তাকিদ ও গুরুত্বও বহু হাদীসে আছে। খলিফা ওমর (রাঃ) নামাযের আগে জামাত সোজা হোয়ে দাঁড়ালে দোররা (চাবুক) হাতে লাইনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখতেন লাইন নিখুঁত সোজা হোয়েছে কিনা (Inspection)। কাউকে লাইন থেকে একটু বিচ্যুত দেখলে তাকে দোররা দিয়ে আঘাত কোরতেন এটা ইতিহাস। এ কেমন উপাসনা যেখানে উপাসকদের, আবেদদের চাবুক মেরে লাইন সোজা কোরতে হয়? এ দৃশ্যটি কি সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ ও সার্জেন্ট মেজরের সৈন্যদের শিক্ষার জন্য পেটানোর দৃশ্যের সঙ্গে মিলে না? মিলে এবং মিলবে কারণ দু'টোরই উদ্দেশ্য এক- শিক্ষা, ট্রেনিং, শৃংখলা। অবশ্য ঐ ট্রেনিং, শিক্ষা দিয়ে কি করা হবে তা বিভিন্ন কিন্তু দু'টোই প্রশিক্ষণ।

নিখুঁতভাবে লাইনগুলি সোজা কোরে দাঁড়াবার পর নামাযের দ্বিতীয় কর্তব্য হলো ইমামের (নেতার) তকবিরের (আদেশের) সঙ্গে সঙ্গে রুকু, ই'তিদাল, সাজদা, সালাম ইত্যাদি করা। নেতার আদেশের সঙ্গে সঙ্গে সকলে একসঙ্গে ঐগুলি করার উদ্দেশ্য হোচ্ছে আদেশ পালন ও শৃংখলা শিক্ষা, কোন দ্বিধা না কোরে সামরিক বাহিনী যেমন কোরে সেনাপতির আদেশে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পৃথিবীর সমস্ত মুসলিমে(Muslim)র জন্য আল্লাহ(Allah) ও তার রসুল (দঃ) একটিমাত্র কেবলা নির্দিষ্ট কোরে দিয়েছেন। তার কারণ এই যে, পৃথিবীর যেখানেই থাকুক মুসলিম(Muslim) যখন জামাতবদ্ধ হোয়ে ঐ এক কেবলার দিকে মুখ কোরে লাইন কোরে দাঁড়াবে তখন যেন তাদের সবার লক্ষ্য এক, উদ্দেশ্য এক ও পথ, প্রক্রিয়া এক হয়, অর্থাৎ সুদৃঢ় ঐক্য। পৃথিবীর যে কোন স্থানের একটি জামাতের নামাযের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোন ধর্মের উপাসনার কোন মিল নেই। পক্ষান্তরে যে একটিমাত্র জিনিসের সঙ্গে এই নামাযের অত্যন্ত মিল-সাদৃশ্য আছে তাহলো পৃথিবীর যে কোন সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ ও ট্রেনিং-প্রশিক্ষণের সঙ্গে। এ কথা যিনি অস্বীকার কোরবেন তার সত্যের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই, সত্যকে স্বীকার করার মানসিকতা নেই। প্রশ্ন হোতে পারে তবে কি নামায শুধুই সামরিক প্রশিক্ষণ, আত্মার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই? তা নয়, আত্মার প্রশিক্ষণও ঐ নামাযেই আছে। কিন্তু কেমন কোরে, কতখানি আছে, বিভ্রান্তিটা ঐখানে। বর্তমানের নামাযে ঐ সামরিক প্রশিক্ষণের আকীদাই নেই, নামায আজ অন্যান্য ধর্মের উপসনার মত শুধু আধ্যাত্মিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আসলে ইসলামের অন্যান্য সমস্ত ব্যাপারের মত নামাযও ভারসাম্যপূর্ণ। মুসলিম(Muslim) যখন নামাযে দাঁড়াবে তখন সে আল্লাহ(Allah)র সামনে দাঁড়াবে, তার মনের ভাব, আকীদা হবে এই যে, ‘আল্লাহ(Allah) তুমি আমাদের ওপর তোমার নবীর মাধ্যমে যে মহা দায়িত্ব অর্পণ কোরেছ, সেই দায়িত্বপূর্ণ করার জন্য যে মহান চরিত্রের, আত্মার বল প্রয়োজন সেই চরিত্র সৃষ্টির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে তোমার সামনে দাঁড়িয়েছি। তুমি দয়া কোরে আমাদের সেই চরিত্র, ঐক্য, শৃংখলা ও আত্মিক শক্তি দাও যাতে আমরা সেই মহান দায়িত্ব পালন কোরতে পারি। আমাদের ধন-সম্পত্তি, পুত্র-পরিজন এবং জীবন তোমার জন্য কোরবান কোরতে পারি। আল্লাহ(Allah)র রাস্তায় ধন-সম্পত্তি পরিবার-পরিজন এক কথায় এই দুনিয়া কোরবান কোরে দেওয়ার চেয়ে বড় আত্মিক উন্নতি আর কি আছে? ঐ তো সন্ন্যাস, ইসলামের প্রকৃত সন্ন্যাস। ঐ হলো সেই ভারসাম্য যে ভারসাম্যের ওপর এই দ্বীন প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ(Allah)র রসুলের (দঃ) চেয়ে সালাতের অর্থ ও উদ্দেশ্য আর কেউ বেশী বুঝেছেন কি? দেখা যাক তিনি সালাতকে কি আকীদায় দেখেছেন। তিনি ইসলাম(Islam)কে তুলনা দিয়েছেন একটি ঘরের সাথে। বোলেছেন, "ইসলাম(Islam) একটি ঘর", সালাত অর্থাৎ নামায এর থাম বা খুঁটি [হাদীস-মুয়ায (রাঃ) থেকে-আহমদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মেশকাত]। বর্তমানে ওলামায়ে দ্বীন, ওয়ায়েয, ধর্মীয় নেতারা এই হাদীস খুব ব্যবহার করেন মানুষকে নামাযী বানাবার জন্য, কিন্তু এর অর্থ বুঝেন না। ইসলামের সঙ্গে নামাযের সম্বন্ধ বোঝাবার জন্য মহানবী (দঃ) তুলনা দিচ্ছেন একটি ঘরের সঙ্গে থাম বা খুঁটির সম্বন্ধ। মানুষ ঘর বা বাড়ী তৈরী করে কেন? কি উদ্দেশ্যে? অবশ্যই রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য সেখানে বসবাস করার জন্য, তাই নয় কি? সেই রোদ বৃষ্টি থেকে মানুষকে বাঁচায় কিসে? অবশ্যই ছাদ, থাম-খুঁটি নয়। অর্থাৎ ঘরে বাস করার জন্য আসল প্রয়োজন হোচ্ছে ছাদটা, থাম-খুঁটি নয়। কিন্তু যেহেতু ঐ থাম-খুঁটি ছাড়া ছাদ ওপরে থাকবে না, তাই থাম-খুঁটি ছাড়া চলবে না। যদি থাম-খুঁটি ছাড়া ছাদ ওপরে রাখা সম্ভব হতো তবে আর থাম-খুঁটির কোন প্রয়োজন থাকতো না। অর্থাৎ ছাদ হোচ্ছে ঘরের উদ্দেশ্য আর থাম-খুঁটি হোচ্ছে ঐ উদ্দেশ্য পূরণের প্রক্রিয়া। আল্লাহ(Allah)র রসুলের উদ্দেশ্য হোচ্ছে সমস্ত পৃথিবীতে যত বাতিল জীবন- ব্যবস্থা আছে যার ফলে পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচার, রক্তপাতে পূর্ণ হোয়ে আছে, সে সমস্ত কে খতম কোরে দিয়ে এই শেষ জীবন-ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা কোরে শান্তি ও নিরাপত্তা ও সুবিচার কায়েম করা। দুরূহ কাজ। ইবলিস ও তার কোটি কোটি শক্তিশালী সঙ্গীরা সে কাজের বাধা। ঐ কাজ কোরতে যে শক্তিশালী সংগ্রামী চরিত্রের জাতি প্রয়োজন, সেই চরিত্র সৃষ্টি করে ঐ নামায। তাই বিশ্বনবী (দঃ) তুলনা দিয়েছেন ইসলাম(Islam) ঘর, আর নামায থাম-খুঁটি। নামায যদি উদ্দেশ্য হতো তবে বিশ্বনবী (দঃ) অবশ্যই তাকে ছাদ বোলতেন, থাম বোলতেন না। কারণ- ঘরের উদ্দেশ্য ছাদ, থাম-খুঁটি নয়। অন্য একটি হাদীসে রসুলুল্লাহ (দঃ) আরও পরিষ্কার কোরে দিয়েছেন। বোলেছেন, "নামায ইসলামের থাম আর এর শীর্ষ বা ছাদ হোচ্ছে জেহাদ [হাদীস-মুয়ায (রাঃ) থেকে-আহমদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মেশকাত]। শীর্ষ-চুঁড়া বা ছাদ ওপরে ধোরে রাখার জন্যই তো পৃথিবীতে সব থাম-খুঁটি তাই নয় কি? থাম-খুঁটির নিজের কোন দাম নেই। ঐ ছাদ বা চূড়াকে ওপরে রাখার জন্যই তার এতো প্রয়োজনীয়তা। আজ পৃথিবীময় তথাকথিত মুসলিম(Muslim)রা মহানবী (দঃ) বর্ণিত নামাযের ঐ উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণ ভুলে যেয়ে উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশিক্ষণকেই উদ্দেশ্য মনে কোরে মহা সমারোহে নামায পড়ছেন, জাঁকজমকময়, কারুকার্য খচিত বিরাট বিরাট মসজিদ তৈরী কোরছেন। উদ্দেশ্য বিচ্যুত এই বিরাট মৃত জাতির মনে ক্ষণিকের তরেও এ প্রশ্ন জাগে না যে পাঁচ লাখেরও কম সংখ্যার একটি জাতি যখন খেজুর পাতার ছাউনি দেয়া মাটির মেঝের মসজিদে নামায পড়তো তখন তাদের দুর্দম গতির সামনে দুনিয়ার দুই পরাশক্তি তাসের ঘরের মতো ভেংগে পড়েছিলো, তাদের নাম শুনলে জালেম, অন্যায়কারী শক্তির অন্তরাত্মা ভয়ে শুকিয়ে যেতো, ঐ মুষ্টিমেয় নামাযী মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে অর্দ্ধেক দুনিয়ায় আল্লাহ(Allah)র রাজত্ব-আল্লাহ(Allah)র সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা কোরেছিলেন। আর আজ শান-শওকতময় বিরাট বিরাট লক্ষ লক্ষ মসজিদে প্রায় একশ বিশ কোটি মুসলিম(Muslim) নামায পড়েও একটি ঘৃণিত অবজ্ঞাত জাতি কেন? যে জাতি কয়েকশ' বছর খ্রীস্টান ইউরোপের বিভিন্ন জাতির ঘৃণিত দাসত্ব করলো এবং সরাসরি দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানসিকভাবে আজও সেই গোলামই রোয়ে গেছে? কোন কারণে যদি সমস্ত পৃথিবীর মানুষ আজ তাদের নিজেদের জীবন-ব্যবস্থা ‘ধর্ম' ত্যাগ কোরে বর্তমানের এই ‘ইসলাম(Islam)' ধর্ম গ্রহণ কোরে রীতিমত বর্তমানের আকীদায় নামায রোযা আরম্ভ কোরে দেয়, তাতে আল্লাহ(Allah)-রসুলের (দঃ) কিছুই আসে যাবে না। কারণ, বর্তমানের এই ইসলাম(Islam), এই নামায প্রতিষ্ঠা কোরতে আল্লাহ(Allah) তার রসুলকে (দঃ) পৃথিবীতে পাঠাননি। একশ' কোটি ‘মুসলিম(Muslim)' আজ অতি নিষ্ঠার সাথে অতি নিখুঁতভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছে, অর্থাৎ বালুচরের ওপর উদ্দেশ্যহীনভাবে লক্ষ লক্ষ অতি সুন্দর, কারুকার্যখচিত নিখুঁত থাম গেড়ে যাচ্ছে। ওপরে ছাদ নেই (সংগ্রাম নেই), ওখানে কেউ বাস কোরতে পারবে না-অর্থহীন।

উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে বোলে নামায স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের যে চরিত্র সৃষ্টি কোরতে পারতো তাও পারছেনা আকীদার বিকৃতির ফলে। ঠিক সময়ে নামায পড়তে হয় কাজেই নামায সময়ানুবর্তিতা শেখায়। নামায পড়েও যদি কেউ সময়ানুবর্তিতা না শেখে তবে নামাযের ঐ শিক্ষা থেকে সে বঞ্চিত হলো। ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, কালো-সাদা, পণ্ডিত-মুর্খ সবাই কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়েও যদি মন থেকে ভেদাভেদ, অহংকার ধুয়ে না যায় তবে নামাযের ঐ শিক্ষা ব্যর্থ হোয়ে গেলো। একই দিকে মুখ করে সবার সাথে একই সঙ্গে ওঠাবসা, রুকু-সাজদা কোরেও মসজিদ থেকে বের হোয়েই নানা মুনির নানা মত হোলে নামাযের কর্মের-ঐক্যের-শিক্ষা ব্যর্থ হোয়ে গেলো। ইমামের তকবিরের সাথে সাথে রুকু, ই'তিদাল, সাজদা কোরেও নামাযের পরই অন্যান্য জাতীয় ব্যাপারে ইমামের হুকুমের তোয়াক্কা না কোরলে নামাযের শৃংখলা শিক্ষা সম্পূর্ন ব্যর্থ হোয়ে গেলো। নামায প্রকৃতপক্ষে কি তা বোঝাতে মহানবী (দঃ) নামাযকে ছাদও বলেননি, বাড়ীর ভিত্তিও বলেন নি, দরজা জানালাও বলেননি, নির্দিষ্ট করে বোলেছেন থাম-খুঁটি। এই কথাটি তিনি একবার বলেননি একাধিকবার বোলেছেন, কোন বারই নামাযকে থাম ছাড়া অন্য কিছু বলেননি। ঐ থাম ছাড়া ঘরের ছাদ রাখা সম্ভব নয় বোলেই ঐ থামের জন্য- থামের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এত তাগিদ, জেহাদী চরিত্র ছাড়া জেহাদ সম্ভব নয় বোলেই ঐ জেহাদী চরিত্র সৃষ্টির জন্য এত তাগিদ। কিন্তু যদি ছাদ না থাকে, তবে ঐ থামের যেমন প্রয়োজন নেই- তেমনি জেহাদ ও সশস্ত্র যুদ্ধ যদি না থাকে তবে নামাযেরও প্রয়োজনীয়তা নেই। বিশ্বনবীর (দঃ) সময়ে আরব জাতি কেমন ছিলো তা বলার দরকার করে না। তা ইতিহাস। গোত্রে গোত্রে পরিবারে পরিবারে এত বিভক্তি এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধ-রক্তপাত, বংশানুক্রমে হত্যা ও তার প্রতিশোধ, বিশৃংখলা এমন একটা পর্য্যায়ে ছিলো যে বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও ঐ পর্য্যায়ে ছিলো না। কিন্তু মাত্র কয়েকটি বছরের মধ্যে সেই বিশৃংখল জাতিকে নিয়ামানুবর্তিতা, ঐক্য ও শৃংখলার চূড়ান্তে নিয়ে গিয়োছিলো এই নামায। নামাযের (Mould) ছাঁচে ফেলে পৃথিবীর সবচেয়ে শৃংখলা বিরোধী জাতিকে কি রূপান্তর করা হোয়েছিলো তার উদাহরণ এই জাতির ইতিহাসে বহুবার পেয়েছি। ওমরের (রাঃ) আদেশে মানবজাতির ইতিহাসের অন্যতম চির অপরাজিত সেনাপতি খালেদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) তার পদ ছেড়ে একেবারে সাধারণ সৈনিক হোয়ে গেলেন; খলিফা সোলায়মানের আদেশে সিন্ধু-বিজয়ী সেনাপতি মহাবীর মোহাম্মদ বিন কাসেম বিনা বাক্যব্যয়ে তার পদ ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলেন। এদের দু'জনেরই সেনাবাহিনীর মধ্যে এত সমর্থক ছিলো যে তারা যদি খলিফার আদেশ অমান্য কোরতেন তবে তা জাতির ঐক্য ও শৃংখলা ক্ষতিগ্রস্ত করতো। আরও একটি অন্য রকমের উদাহরণ দেয়ার লোভ সংবরণ কোরতে পারছিনা। এটা মহান সাহাবা আবু যরের (রাঃ) জীবনী থেকে। হজ্বের সময় মহানবী (দঃ) মিনায় চার রাকাতের জায়গায় কসরের দু'রাকাত সালাত পড়তেন। স্বভাবতঃই পরে ওমর (রাঃ), আবু বকর (রাঃ) এরাও রসুলের (দঃ) অনুসরণ কোরে মিনায় কসরের দু'রাকাত সালাত পড়তেন। ওসমানের (রাঃ) খেলাফতের সময় ওসমান (রাঃ) মিনায় কসর না পড়ে পুরা চার রাকাত সালাত পড়লেন, অর্থাৎ আপাতঃ দৃষ্টিতে সুন্নাহর খেলাপ কোরলেন। অবশ্য পরে তিনি তার ও কাজ করার কারণ সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা ছিলো এই যে, মিনার কাছেই তার কিছু জমি-সম্পদ ছিলো, কাজেই তার জন্য মিনায় কসর হয় না। সে যাই হোক আবু যর (রাঃ) এই খবর শুনে প্রথমতঃ খুব চটে গেলেও পরে নিজেই ওসমানকে (রাঃ) অনুকরণ কোরে মিনায় সেই চার রাকাত নামায পড়লেন। কারণ হিসেবে বোললেন, "রসুলুল্লাহ (দঃ) বলে গেছেন যে এমামকে- নেতাকে বিনা বাক্যব্যয়ে অনুসরণ কোরতে হবে। যদি সে নেতা কান কাটা নিগ্রো ক্রিতদাসও হয় [হাদীস-ইরবাদ বিন সরিয়াহ (রাঃ) থেকে আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মেশকাত]।" সেই নামাযের শৃংখলা আনুগত্য ও ঐক্য শিক্ষার ফল। জাতির ঐক্য ও শৃংখলা রক্ষার জন্য আবু যরের (রাঃ) মত উচ্চ স্তরের সাহাবীও রসুলুল্লাহর (দঃ) নির্দেশ পালন করার জন্য তারই (দঃ) সুন্নাহ পর্য্যন্ত অমান্য কোরলেন, যদিও ওসমানের (রাঃ) মত মিনার কাছে তার কোন জমি ছিল না। চার পাঁচ লাখ লোকের একটি জাতির ঐ চরিত্রের আরও অনেক লোক ছিলেন। কিন্তু গত হাজার বছরের মধ্যে কোটি কোটি মানুষের নামায আর একটিও খালেদ (রাঃ), একটিও মোহাম্মদ বিন কাসেম বা আবুযর (রাঃ) সৃষ্টি কোরতে পারেনি। এর জন্য নামায দায়ী নয়। এর কারণ হলো, নামায সম্বন্ধে বিকৃত আকীদা, ভুল দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়াকে উদ্দেশ্যের স্থান দেয়া। বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দঃ) এবং সরাসরি তার কাছে থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আসহাব (রাঃ) যে আকীদা নিয়ে নামায পড়তেন সেই আকীদা নিয়ে নামায পড়লে আজও নামায আবার আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, খালেদ, আবু ওবায়দা, আবু যর (রাঃ) সৃষ্টি করবে। আসলেই ভবিষ্যতে নামায আবার তা কোরবে। আবু ওবায়দার (রাঃ) এক প্রশ্নের উত্তরে মহানবী (দঃ) সে ভবিষ্যতবাণী কোরে গেছেন- অন্যত্র এটা লিখেছি। যেদিন এই উম্মাহ আবার তার প্রকৃত আকীদা ফিরে পাবে, রসুলুল্লাহর (দঃ) শিক্ষার বিপরীত দিকে সে যে আজ চলছে তা ছেড়ে আবার তার দেখানো পথে চলতে শুরু করবে, সেদিন নামায আবার সেই আসহাবদের মতই চরিত্র সৃষ্টি করবে, আবার সেই দুর্জয় যোদ্ধা সৃষ্টি করবে।

অন্যান্য ধর্মে যে উদ্দেশ্যে উপাসনা করা হয় নামাযও তেমনি উপাসনা, এবাদত, এই আকীদা যে ভুল তার আর এক প্রমাণ এই যে, চোখ বন্ধ কোরে নামায পড়া নিষেধ। খোলা চোখের চেয়ে চোখ বন্ধ করলে একাগ্রতা নিবিষ্টতা বেশী আসে, এটা সাধারণ জ্ঞান, সবাই জানে। তাই উপাসনা কোরতে সর্ব ধর্মের মানুষই চোখ বন্ধ করে। এমন কি উপাসনা ছাড়াও কোন কিছু গভীরভাবে চিন্তা কোরতে গেলেও মানুষের চোখ আপনা থেকে বুঁজে আসে। অথচ চোখ বন্ধ করে নামায পড়া নিষেধ। কেন? এইজন্য যে একাগ্রতা-নিবিষ্টতা এখানে লক্ষ্য নয় এখানে লক্ষ্য হচ্ছে ট্রেনিং, শৃংখলা শিক্ষা, সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা কুচকাওয়াজ কোরে যে ট্রেনিং প্রশিক্ষণ নেয়। কোন সামরিক বাহিনীর কমাণ্ডার যে কারণে তার সৈন্যদলকে চোখ বন্ধ কোরে কুচ-কাওয়াজ কোরতে দেবেন না, ঠিক সেই কারণে চোখ বুঁজে নামায পড়া নিষিদ্ধ। নামাযের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভুল আকীদার অধিকারী বর্তমান মুসলিম(Muslim) জাতি নামাযে নিবিষ্টতার যে দাবী করেন- নামাযের চৌদ্দটি ফরয, চৌদ্দটি ওয়াজেব, সাতাশটি সুন্নাত আর বারটি মুস্তাহাব খেয়াল রেখে সেই নিবিষ্টতা অসম্ভব এ কথা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। নামায যদি অন্যান্য ধর্মের উপাসনার উদ্দেশ্যেই বাধ্যতামূলক (ফরজ) করা হতো, তবে এক পায়ে একটু বেশী ভর দিয়ে দাঁড়ালে নামায ত্রুটিযুক্ত হোয়ে যেতো না। কারণ, এক পায়ে বেশী ভর দিয়ে দাঁড়ালে আল্লাহ(Allah)র প্রতি মনসংযোগ কোরতে কোন প্রতিবন্ধকতা হয় না। আসল কথা হোচ্ছে যে জেহাদ ও কিতালের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্য সমস্ত জীবন-ব্যবস্থা রদ, বাতিল কোরে দ্বীনুল ইসলাম(Islam)কে প্রতিষ্ঠার জন্য এই জাতি ‘উম্মাহ'কে সৃষ্টি করা হোয়েছে সেই কাজ সফলভাবে করার জন্য যে মহান চরিত্র ও দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা দরকার তা তৈরী করার ট্রেনিং-প্রশিক্ষন হোচ্ছে নামায। তাই এই উম্মাহর স্রষ্টা পরিষ্কার বোলে দিয়েছেন ইসলামের ঘরের থাম-খুঁটি হোচ্ছে নামায, ছাদ হোচ্ছে জিহাদ ও সশস্ত্র যুদ্ধ। তার কথার উপর আর অন্য কোন কথা নেই। নামাযের ঐ বুনিয়াদী অর্থ ছাড়াও নামায মানুষের দৈহিক, মানসিক, আত্মিক- এক কথায়, মানুষের পূর্ণ জীবনের প্রত্যেকটি দিকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। শুধু তাই নয়, নামাযের মাধ্যমে জাতির রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা ও নীতি-নির্দেশনা পর্য্যন্ত রয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে এখানে আর যাবো না বইয়ের আকার বেশী বড় হোয়ে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে অত গুরুত্বপূর্ণ হোলেও নামায উদ্দেশ্য নয় নামায প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ। নামায যে উদ্দেশ্য নয়-উদ্দেশ্য পূরণের প্রশিক্ষণ, তার আরও সরাসরি প্রমাণ আছে। নামাযের প্রশিক্ষণের যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ জেহাদ ও কিতাল ‘সশস্ত্র যুদ্ধ' যখন এসে যেতো তখন মুসলিম(Muslim)রা নামায পড়তেন না, এটা ইতিহাস এবং একবারের ইতিহাস নয়, বহুবারের ইতিহাস। পৃথিবীর কোন সৈন্য বাহিনীই যুদ্ধের সময় প্যারেড-কুচকাওয়াজ করেনা, ট্রেনিং নেয় না, তখন তারা যুদ্ধ করে, একথা জানেনা এমন অজ্ঞ বোধহয় কোথাও নেই। কারণ, সৈন্যবাহিনী তখন কোরছে সেই কাজ- যে কাজের জন্য তারা এতদিন এত প্রশিক্ষণ নিয়েছে- যেটা তাদের আসল উদ্দেশ্য। মুসলিম(Muslim)রাও তাই করেছেন, কারণ তারা জানতেন নামাযের উদ্দেশ্য কি? নামায সম্বন্ধে তাদের আকীদা সঠিক ছিলো। ইয়ারমুকের যুদ্ধ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত ছয়দিন পর্য্যন্ত চোলেছে। এই ছয়দিন মুসলিম(Muslim) বাহিনী সারাদিন কোন নামায পড়েছে বোলে কোন ইতিহাসবেত্তা উল্লেখ করেননি। যদিও প্রত্যেক দিনের যুদ্ধের বিস্তৃত বিবরণ, এমনকি বহু ছোট ছোট ঘটনার উল্লেখ আছে- কে কি বোলেছেন তা পর্য্যন্ত লেখা আছে। ইয়ারমুকে এক হাজারের বেশী আসহাব (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন, যারা আল্লাহ(Allah)র রসুলের (দঃ) কাছ থেকে সরাসরি ইসলাম(Islam) শিক্ষা কোরেছিলেন, এমন কি আশরাতুল মুবাসশারা থেকে অন্ততঃ একজন- আবু ওবায়দা (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন। এদের একজনও একথা বলেননি যে নামাযের সময় হোয়েছে যুদ্ধ থামাও। বলেননি, কারণ, এখনকার ধর্মীয় নেতাদের মতো তাদের গুরুত্ব (Priority) উল্টো হোয়ে যায়নি। আজ যারা নামায পড়ো, নামায পড়ো বোলে গলা ফাটান, নামাযকেই উদ্দেশ্য মনে করেন, তাদের কাছে নিবেদন এই যে- প্রত্যক্ষ যুদ্ধ বাদ দেন, যুদ্ধের শুধু প্রস্তুতিমূলক কাজেও নামায বাদ দেয়ার শিক্ষা স্বয়ং মহানবী (দঃ) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। খন্দকের যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে অন্যদের সঙ্গে পরিখা খননকালে তিনি (দঃ) আসরের নামায পড়েননি এবং অবশ্যই অন্য আর কেউই পড়েননি। মনে রাখবেন শত্রু সৈন্যবাহিনী তখনও এসে পৌঁছায়নি। বিশ্বনবী (দঃ)কি দশ মিনিটের জন্য কাজ বন্ধ রেখে আসরের মাত্র চার রাকাত নামায পড়ে নিতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন। কিন্তু পড়েননি। পড়েননি আমাদের জন্য উদাহরণ রেখে যাওয়ার জন্য, যেন আমরা যে জিনিষের যে গুরুত্ব তাই যেন দেই, যেন উল্টা-পাল্টা না কোরে ফেলি, প্রক্রিয়া প্রশিক্ষণকে যেন উদ্দেশ্যের আসনে না বসাই। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তো পরের কথা, সামান্য পাহারা দেওয়ার কাজ যাকে ‘security duty’ বলা হয় সেটা মহানবী (দঃ) বোলেছেন এক রাত্রির পাহারা বহু বছরের নফল নামাযের চেয়ে বড়। নামায বড় না যুদ্ধ বড়, অগ্রাধিকারের এই প্রশ্নের জবাব আমরা পাই আল্লাহ(Allah)র রসুলের (দঃ) জীবনী থেকেই। খন্দকের যুদ্ধের পর বিশ্বাসঘাতক ইহুদী বনু-কুরাইজা গোত্রকে অবরোধ করার জন্য যখন তিনি মুজাহিদদের পাঠিয়ে দিলেন তখন আসরের নামাযের সময় হোতে কিছু বাকি। মুজাহিদদের তিনি রাস্তায় আসরের নামায পড়তে নিষেধ কোরে দিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য। আমরা ঠিক তাই কোরেছি। উদ্দেশ্য জেহাদ ‘কিতাল'কে বাদ দিয়ে প্রশিক্ষণকেই উদ্দেশ্য বানিয়ে তাই নিয়ে হুলুস্থুল কোরছি। এর ফল কি হোয়েছে তা এই দুর্ভাগা জাতির ইতিহাস। ফল হোয়েছে শত্রুর দাসত্ব, দাসত্বের ফল হোয়েছে তাদের অনুকরণে ইসলাম(Islam)কে জাতীয় জীবন থেকে নির্বাসন দিয়ে মোশরেকে পরিণত হওয়া, মোশরেক হওয়ার ফল হোয়েছে এই যে আজ মসজিদে নামায নামে যে প্রহসন হয় তাতে অশিক্ষিত বা অর্দ্ধশিক্ষিত কয়েকশ' টাকার বেতনভোগী ‘ধর্মীয়' এমাম সাহেবের পেছনে তার তকবিরের (আদেশের) শব্দে ওঠ-বস করেন সমাজের ‘অধর্মীয়' অর্থাৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা। সালাত শেষ হোলেই কিন্তু ঐ ‘অধর্মীয় নেতরা' আর ‘ধর্মীয় নেতার দিকে চেয়েও দেখেন না'। কারন তারা জানেন যে ঐ ‘ধর্মীয়' নেতার দাম কয়েকশ টাকা বেতনের বেশী কিছুই নয়, জাতীয় জীবনে তার কোন দাম নেই। ঐ ‘ধর্মীয় নেতারা' অর্থাৎ এমামরা যদি ‘অধর্মীয় নেতাদের' সামনে কোন ধৃষ্টতা-বেয়াদবি করেন তবে তখনই তাদের নেতৃত্ব অর্থাৎ মসজিদের এমামতির কাজ শেষ। খ্রীস্টানদের পায়রবি কোরতে কোরতে এই জাতি এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে, ঐ খ্রীস্টানদের পাদ্রীদেরও তাদের জাতির ওপর যেটুকু সম্মান ও প্রভাব আছে, এই ‘এমাম'দের তাও নেই।

আকীদার বিকৃতি অর্থাৎ সালাতকে জেহাদের প্রশিক্ষণের বদলে উদ্দেশ্য মনে করা ও একে অন্যান্য ধর্মের মত শুধু আল্লাহ(Allah)র নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া বোলে বিশ্বাস করার ফলে আরও একটি বিকৃতি এসেছে। নামাযের লাইন ধনুকের ছিলার মত সোজা করার উপর রসুলুল্লাহর (দঃ) এত তাগিদ সত্ত্বেও আজ অতি মুসলিম(Muslim)দের লাইন সোজা হয়না। শুধু তাই নয় ইমামের তাকবিরের সঙ্গে সঙ্গে রুকু, ই'তিদাল, সাজদা ইত্যাদি হয় না, সমস্ত জামাতের বিচলন, নড়া-চড়া একসঙ্গে হয় না। লাইন ধনুকের ছিলার মত সোজা করার ওপর মহানবীর (দঃ) গুরুত্ব দেয়া থেকে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে নামাযের সমস্ত বিচলন সৈন্য বাহিনীর কুচকাওয়াজের মতই সমস্ত জামাতের এক সঙ্গে হোতে হবে; একটি মাত্র দেহের বিচলনের মত। ইমামের প্রতিটি তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যবাহিনীর প্যারেডের মত দ্রুত এবং এক সঙ্গে হোতে হবে। আজকের নামাযের লাইনও ধুনকের ছিলার মত সোজা নেই, বিচলনও দ্রুত বদলে অসুস্থ, মৃত-প্রায় মানুষের মত অতি ধীরে এবং এক সঙ্গের বদলে বিচ্ছিন্ন, এক এক জন এক এক গতিতে। তাই বিশ্বনবীর (দঃ) বাণী মোতাবেক এই জাতির মুখ আল্লাহ(Allah) ও বিশ্বনবী (দঃ) যেদিকে স্থাপন কোরেছিলেন আজ তার বিপরীত দিকে ঘুরে গেছে।

শেষ নবী মোহম্মদ (দঃ) তাঁর উম্মাহ কে সারা জীবনের পরিশ্রমে, সাধনায় একটি অপরাজেয়, দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা বাহিনীতে পরিণত কোরেছিলেন। তিনি অবশ্যই এ কাজ তার নিজের ইচ্ছায় করেননি, নিশ্চয়ই আল্লাহ(Allah)র নির্দেশেই কোরেছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহ(Allah)র সত্য নবী। আল্লাহ(Allah) ঐ নির্দেশ তার রসুলকে দিয়েছিলেন এই জন্য যে, এই শেষ জীবন-ব্যবস্থা ‘দ্বীন' যেটাকে সমস্ত মানব জাতির জন্য তিনি পাঠালেন তা জেহাদ এবং কিতালের (সশস্ত্র সংগ্রাম, যুদ্ধ) মাধ্যমে ছাড়া পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। সবিনয়ে এবং প্রচার কোরে তা সম্ভব নয়। কাজেই যে নবীর উম্মাতের ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করা হলো সেই উম্মাহকে একটি দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা বাহিনীতে পরিণত করার নির্দেশ নবী করিম (দঃ) আল্লাহ(Allah)র কাছ থেকেই পেয়েছিলেন এবং এই উম্মাহর ইতিহাস সাক্ষী যে, তিনি নিখুঁতভাবে আল্লাহ(Allah)র নির্দেশ কাজে পরিণত কোরেছিলেন। তার উম্মাহকে যুদ্ধবিদ্যায় এমন পারদর্শী কোরে দিয়েছিলেন যে, ইসলামের আগে যে আরব জাতি নিজেরাই স্বীকার করতো যে- তারা দশ জন একজন মাত্র পারসিক সৈন্যের সমান, তারাই যুদ্ধক্ষেত্রে পারসিকদের চেয়ে সংখ্যায়, সমর সজ্জায়, প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রে সব দিকে দিয়ে নগণ্য হোয়েও প্রতি যুদ্ধে তাদের শোচনীয়ভাবে পরাস্ত কোরে দিলো। এটা সম্ভব হোয়েছিলো এই জন্য যে বিশ্বনবী (দঃ) নিজে তার উম্মাহকে সমরবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন। প্রথমে নিজে শিক্ষা দিয়ে এবং নিজে নেতৃত্ব দিয়ে তারপর পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে সেনাপতি নিযুক্ত কোরে দিতেন। উদ্দেশ্য ছিলো নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা; যারা তার(দঃ) পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর তার উম্মাহকে জেহাদে ও কিতালে সঠিক ও সফল নেতৃত্ব দিতে পারেন। বিশ্বনবীর (দঃ) ঐ প্রচেষ্টা যে কতখানি সফল হোয়েছিলো, কী দুর্দমনীয় অজেয় সুশৃংখল যোদ্ধার বাহিনী ও সেই বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড ঝড়ের মত চালনা করার উপযুক্ত সেনাপতির দল তিনি (দঃ) তৈরী কোরে গিয়েছিলেন, যিনি এই উম্মাহর ইতিহাস পড়েছেন তাকে বোলে দিতে হবে না। মহানবীর (দঃ) নিজের হাতে গড়া ও নামাযের মাধ্যমে শৃংখলা শিক্ষিত ঐ বাহিনী পৃথিবীর অন্যায়কারী, অত্যাচারী শক্তিগুলির আতংক হোয়ে দাঁড়িয়েছিলো। ঐ অজেয় বাহিনীর যোদ্ধা হোতে এবং ঐ বাহিনীগুলিকে নেতৃত্ব দিতে সেই সব সেনাপতিদের নামায ছাড়াও কত রকম প্রশিক্ষণ নিতে হোয়েছে, অস্ত্রশস্ত্র চালনায় কত অনুশীলন (Practice) কোরতে হোয়েছে জেহাদ বিমুখ, কিতাল (যুদ্ধ) ভুলে যাওয়া এই জাতির পক্ষে আজ তা ধারণা করাও অসম্ভব। সাধারণ মানুষ বাদ দেন, ইসলামের আত্মা অর্থাৎ জেহাদ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই জাতির ধর্মীয় নেতাদেরও যদি প্রশ্ন করেন যে এই উম্মাহর অবিশ্বাস্য সামরিক সাফল্যের কারণ কি? তারা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন- ঈমানের জোর। বহুবার এ জবাব শুনেছি এবং শুনে ইচেছ হোয়েছে যে এই চিন্তাহীন লোকদের বলি যে, তাই যদি হয় তবে আপনাদের মধ্যে যাদের মোকাম্মল ঈমান সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই, অর্থাৎ যারা রামাদানের রোযা ছাড়াও নফল রোযা রাখেন এবং নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়েন (মোকাম্মাল ঈমান ছাড়া ঐ দুই কাজ সম্ভব নয়) তাদের যে কেউ অন্য ধর্মের একজন কুস্তিগীর পাহলোয়ানের সঙ্গে লড়ুন, দেখি ঈমানের জোরে তিনি জিতেন কিনা। অবশ্যই তিনি জিতবেন না, ঐ বিধর্মী পাহলোয়ান তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলবেন। এই ইসলাম(Islam) ‘দ্বীনে ফিতরত' স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বীন। ঐ প্রাকৃতিক নিয়ম মোতাবেকই শারীরিক শক্তি না থাকলে কুস্তির প্যাঁচ না জানলে শত ঈমান থাকলেও ঐ হিন্দু বা খ্রীস্টান বা ইহুদী পাহলোয়ানের সাথে পারবেন না। রসুলুল্লাহ (দঃ) ও তার সৃষ্ট জাতি তা জানতেন তারা আজকের এই জাতির মত প্রায়ান্ধ ছিলেন না। ঈমান তাদের অবশ্যই ছিলো, সে সম্বন্ধে তো কোন প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু ঐ ঈমানের সঙ্গে এ জ্ঞানও ছিলো যে, অস্ত্র ব্যবহারে দক্ষ, অতি দক্ষ না হোলে শুধু ঈমানের জোরে যুদ্ধে জেতা যায় না। কাজেই তারা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষণ নিতেন, অবিশ্রান্ত প্রশিক্ষণ নিতেন; যার ফলে শুধু সম্মিলিতভাবে নয়, রোমান ও পারসিকদের অপরাজেয় বোলে বিখ্যাত যোদ্ধাদের দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে (Single Combat) পরাজিত কোরে শত্রুর হৃদয়ে ত্রাসের সৃষ্টি কোরেছিলেন। এই প্রশিক্ষণ এই দ্বীনে এত গুরুত্বপূর্ণ যে এর খেলাধূলার (Sports) ব্যাপারেও এর নীতি হোচ্ছে শুধু সেই সব খেলাধূলাকে যায়েজ করা, স্বীকৃতি দেয়া যেগুলো যুদ্ধে কাজে আসবে। মোহাদ্দিসরা জানেন যে মহানবী (দঃ) ঘোড়ায় চড়া, ঘোড়দৌড়, তীর চালনার প্রতিযোগিতা, তলোয়ার ও ছুরি চালানার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি খেলাধূলাকে শুধু অনুমতিই দেন নাই এই খেলাধূলাকে উৎসাহিত কোরেছেন। এমন কি এগুলোতে নিজে অংশ গ্রহণ কোরেছেন। কারণ এগুলো যুদ্ধের কাজে আসবে। এক কথায় এই দ্বীনে সব কিছুতো বটেই, এমন কি খেলধূলা পর্য্যন্ত যুদ্ধমুখী-সংঘাতমুখী (Battle oriented)। এবং ঘরে বোসে বোসে যে সব খেলা আছে, তাস-দাবা ইত্যাদি এগুলো নিষিদ্ধ কোরে দিয়েছেন।

বর্তমানের ধর্মের ধারক-বাহকরা তাদের লেখায়, কথায়, ওয়াযে নানা ছোট খাটো অপ্রয়োজনীয় খুঁটি-নাটি নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান সৃষ্টি করেন, কিন্তু ইসলামের যে মর্মবাণী জেহাদ ও কিতাল সে সম্বন্ধে তারা চুপ কারণ, ওগুলোতে বড় কষ্ট, বড় কোরবানী এমন কি জানের ভয়। তারা জনেন না তাদের ঐ সংগ্রামহীন যুদ্ধবিহীন ইসলাম(Islam) আল্লাহ(Allah) ও তার রসুল (দঃ) ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান কোরবেন।

1 টি মন্তব্য:

সম্রাট শফিউল বাসার (বাদল) বলেছেন...

এক ঐতিহাসিক মহাসত্যের দ্বার উন্মোচন করেছেন মহামান্য ঈমামোজ্জামান| এই মহাসত্য যেন মানুষের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে| মহামহীম আল্লাহর ককছে সেই প্রার্থনা|