বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১১

৭। ভারসাম্যহীন সুফী মতবাদের অনুপ্রবেশ

আল্লাহ(Allah)র রসুল (দঃ) বোলেছিলেন- আমার উম্মাহর (জাতির) আয়ু ৬০/৭০ বছর। এর প্রকৃত অর্থ হলো এই যে, তার (দঃ) জাতি ঐ ৬০/৭০ বছর পর্য্যন্ত তার কাজ চালিয়ে গেছে। তারপর তারা ঐ কাজে বিরতি দিলো, কারণ ঐ উদ্দেশ্যটা ভুলে গেলো। তাদের দৃষ্টি, তাদের প্রকৃত লক্ষ্য, যে লক্ষ্য আল্লাহ(Allah) ও তার রসুল (দঃ) নির্দিষ্ট কোরে দিয়েছিলেন তা থেকে ঘুরে যেয়ে যে সহজ-সরল দ্বীনকে সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার কথা সেটাকে চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে ব্যাপৃত হোয়ে পড়লো এবং আল্লাহ(Allah) ও রসুলের (দঃ) কথা মতই ধ্বংস হোয় গেলো। কিন্তু এই ধ্বংস হবার কারণ শুধু পণ্ডিতদের ঐ অতি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই নয়। আরও একটি প্রধান কারণ আছে আর তা হলো এই দ্বীনুল কাইয়্যেমাতে, সেরাতুল মুস্তাকীমের মধ্যে বিকৃতি সুফী মতবাদ অর্থাৎ ভারসাম্যহীন আধ্যাত্ববাদের অনুপ্রবেশ। আল্লাহ(Allah) মানুষের জন্য যত জীবন-ব্যবস্থা পাঠালেন যুগে যুগে, তার শেষটাকে তিনি তৈরী কোরলেন একটা অপূর্ব ভারসাম্য (Balance) দিয়ে। এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্টই হলো ভারসাম্য। এর আগের দ্বীনগুলিতে যে ভারসাম্য ছিলো না তা নয়, মূল দ্বীনে ভারসাম্য অবশ্যই ছিলো। কারণ মানুষ শুধু দেহ নয় আত্মাও, শুধু সামাজিক জীব নয়, তার ব্যক্তিগত জীবনও আছে। তাই তার জীবন-বিধান, দ্বীনও একতরফা হোতে পারে না। সেটাকে অবশ্যই এমন হোতে হবে যে সেটা মানুষের উভয় রকম প্রয়োজনীয়তা পূরণ কোরতে পারে। নইলে সেটা ব্যর্থ হোতে বাধ্য। তাই আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন-ব্যবস্থা অবশ্যই সব সময় মূলতঃ ভারসাম্যযুক্ত ছিলো। কিন্তু পূর্ববর্তী সব নবীদের (আঃ) ওপর অবতীর্ণ দ্বীনগুলি ছিলো স্থান ও কালের প্রয়োজনের মধ্যে সীমিত এবং ওগুলোর ভারসাম্যও ছিলো ঐ পটভূমির প্রেক্ষিতে সীমিত। কিন্তু ঐ দ্বীনগুলির ভারসাম্যও মানুষ নষ্ট কোরে ফেলেছে। হয় বিধানের আদেশ-নিষেধগুলিকে আক্ষরিকভাবে পালন কোরতে যেয়ে দ্বীনের মর্মকে, আত্মাকে হারিয়ে ফেলেছে, না হয় দ্বীনের সামাজিক বিধানগুলিকে যেগুলো মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা কোরবে সেগুলিকে ত্যাগ কোরে শুধু আত্মার উন্নতির জন্য সংসার ত্যাগ কোরে সন্ন্যাস গ্রহণ কোরেছে। উভয় অবস্থাতেই দ্বীনের ভারসাম্য নষ্ট হোয়ে গেছে। ঐ ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা কোরতে আল্লাহ(Allah)কে আবার প্রেরিত, নবী পাঠাতে হোয়েছে। শেষ যে জীবন-বিধান স্রষ্টা পাঠালেন তার শেষ নবীর (দঃ)মাধ্যমে এটা এলো সমগ্র মানব জাতির জন্য। এর মধ্যে মানুষের সমষ্টিগত জীবনের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন, বিচার ও দণ্ডবিধিও যেমন রোইল, তেমনি তার ব্যক্তিগত জীবনের আত্মার উন্নতিরও ব্যবস্থা রোইলো। দু'টোই রোইলো- কিন্তু ভারসাম্যযুক্ত অবস্থায়। কোরানে স্রষ্টা এ ব্যাপারে পরিষ্কার কোরে বোলে দিলেন- আমি তোমাদের একটি ভারসাম্যযুক্ত জাতি কোরে সৃষ্টি কোরলাম (কোরান- সূরা আল-বাকারা ১৪৩)। এই আয়াতে আল্লাহ(Allah) ভারসাম্য বুঝাতে যে শব্দটি ব্যবহার কোরছেন তা হোচ্ছে ওয়াসাত। আল্লামা ইউসুফ আলী এই শব্দের অনুবাদ কোরেছেন Justly Balanceed এবং Mohammaed Marmaduke Pickthal অনুবাদ কোরেছেন Middle অর্থাৎ মাঝখানে অবস্থিত। যে আয়াতে আল্লাহ(Allah) এই জাতিকে ভারসাম্যযুক্ত কোরে তৈরী করার কথা বোলছেন তার ঠিক আগের আয়াতে তিনি সেরাতুল মুস্তাকীমের কথা বোলছেন। দ্বীনুল কাইয়্যেমার, সেরাতুল মুস্তাকীমের ও ওয়াসাতের মূল অর্থ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রত্যেকটি শব্দের অর্থের মধ্যে সেই ভারসাম্য অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে। এই ওয়াসাত শব্দ ব্যাখ্যা কোরতে যেয়ে আল্লামা ইউসুফ আলী লিখছেন- আরবী ওয়াসাত শব্দটি আক্ষরিকভাবে মধ্যবর্তীতা অর্থ প্রকাশ করে (The Holy Qur’an- translation by Allama Abdullah. Yousuf Ali, Note- 143)। এই ভারসাম্য যদি নষ্ট হোয়ে যায় অর্থাৎ যে কোন একদিকে ঝুঁকে পড়ে তবে যে কোন ব্যবস্থা নষ্ট হোয়ে যায়। আধ্যাত্দবাদ এই দ্বীনে প্রবেশ কোরে এর ভারসাম্য নষ্ট কোরে দিলো কারণ এই মতবাদ এই জীবন-ব্যবস্থার সমষ্টিগত দিকটা, যার মধ্যে আল্লাহ(Allah)র দেয়া রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাগুলি রোয়েছে সেগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা কোরে এর শুধু ব্যক্তিগত ও আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়াকে আকড়ে ধরাকেই ধর্মকর্ম সাব্যস্থ করলো। একদিকে পণ্ডিতরা ফকিহ, মুফাস্সিররা এই দ্বীনের আইন-কানুনকে তন্ন তন্ন বিশ্লেষণ কোরতে শুরু কোরলেন, অন্যদিকে সুফীরা ও সব কিছু সম্পূর্ণ ত্যাগ কোরে নিজেদের আত্মাদার ধোয়ামোছা পরিষ্কারের কাজে মগ্ন হোয়ে গেলেন। দু'দল দু'দিকে ঝুঁকে পড়লেন। ভারসাম্য আর রইল না, হারিয়ে গেলো। যে কাজের জন্য বিশ্বনবী (দঃ) প্রেরিত হোয়েছিলেন, যে কাজের জন্য তার উম্মাহ সর্বস্ব ত্যাগ কোরে পৃথিবীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, সে কাজ উপেক্ষিত হোয়ে পরিত্যক্ত হলো। জাতি দু'ভাগ হোয়ে দু'দিকে ঝুঁকে পড়লো, উম্মতে মোহম্মদী ঐ খানেই শেষ হোয়ে গেলো জাতি হিসাবে। এই যে দু'টি ভাগ হলো, দু'টি ভাগই হলো অন্তর্মুখী (Introvert)। ফকিহ মুফাস্সির ইত্যাদিরা বই কেতাব, কলম, কাগজ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, আর সুফীরা তসবীহ নিয়ে হুজরায় আর খানকায় ঢুকলেন। বিশ্বনবী (দঃ) ও তার আসহাবদের অসমাপ্ত কাজ করার জন্য বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সংখ্যক মাত্র লোক রোইলেন যারা এই জাতির উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, সেরাতুল মুস্তাকীম ও দ্বীনুল কাইয়্যেমাকে ভুললেন না। কিন্তু জাতি হিসাবে এই উম্মাহ আর উম্মতে মোহাম্মদীও রোইলো না সেরাতুল মুস্তাকীম, সহজ-সরল রাস্তায়ও রইলো না। এরই ভবিষ্যত বাণী কোরে শেষ নবী (দঃ) বোলেছিলেন- আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর। কারণ তার (দঃ) ওফাতের ৬০/৭০ বছর পরই এই মহা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছিল।

যেহেতু দ্বীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতুল মুস্তাকীম ও উম্মাতে ওয়াসাতা মূলতঃ একই অর্থ বহন করে অর্থাৎ ১) সহজ ও সরল, ২) মধ্যপন্থী, ৩) স্থির, নিশ্চিত, ৪) চিরস্থায়ী, শাশ্বত ও ৫) ভারসাম্যযুক্ত সুতরাং এটা পরিষ্কার হোয়ে যায় যে, এই ভারসাম্য (Balance) এই দ্বীনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, কতখানি প্রয়োজনীয়। এক কথায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। এ দ্বীনের প্রাণ এই ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহ(Allah) এই ভারসাম্যের কথা শুধু বোলে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, এর গুরুত্ব বোঝাবার জন্য তিনি আরও কাজ কোরছেন। যার মাধ্যমে তিনি এই সহজ-সরল পথ (সেরাতুল মুস্তাকীম) আমাদের জন্য পাঠালেন তাকে অর্থাৎ তার শেষ নবীর (দঃ) পবিত্র দেহখানিও তিনি সৃষ্টি কোরলেন এক অপূর্ব ভারসাম্য দিয়ে। ইতিহাসবেত্তাদের ও বিভিন্ন হাদীসে এই সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষের যে দৈহিক বর্ণনা পাওয়া যায়। সেগুলিকে একত্র কোরলে যে মানুষটাকে পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় তিনি বেশী লম্বাও ছিলেন না খাটোও ছিলেন না; দেহ ছিলো শক্তিমান, সুগঠিত কিন্তু মোটাও নয়, কৃশও নয়; গায়ের রং ইউরোপিয়ানদের মত ধবধবে সাদাও নয়, কালোও নয়, দুধে আলতায় মেশানো; মাথার চুল বেশী কুঞ্চিতও নয়, একেবারে সোজাও নয়, মাঝারি ঢেউ খেলানো; এমন কি পবিত্র মুখখানাও গোলও ছিলো না, লম্বাও ছিলো না, ছিলো ডিম্বাকৃতি, যাকে পাশ্চাত্য ইতিহাসবেত্তারা বর্ণনা কোরেছেন Oval শব্দ দিয়ে। সমস্ত কিছুই মাঝারি, কোনটাই বেশী নয়। অর্থাৎ আল্লাহ(Allah) মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে, তার নবীর (দঃ) পবিত্র দেহের মত তার দেয়া জীবন-ব্যবস্থাও ভারসাম্যযুক্ত, কোন কিছুরই অতিরিক্ততা নেই। এর যে কোন ব্যাপারেই একটু অতিরিক্ততা কোরলেই এর ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং তা আর সেই নিখুঁত ভারসাম্যযুক্ত ইসলাম(Islam) থাকবে না। এই দ্বীনকে অতি বিশ্লেষণ কোরে পণ্ডিতরা, ফকিহ ও মুফাস্সিররা এর ভারাসাম্য যেমন নষ্ট কোরে দিলেন, সেরাতুল মুস্তাকীমের, অতি সহজ-সরলতাকে মাসলা-মাসায়েলের দুর্বোধ্য জটিলতায়, তেমনি অন্যদিকে সুফী সাধকরাও এর ভারসাম্য নষ্ট কোরে এর বহির্মুখী সংগ্রামী চরিত্রকে অন্তর্মুখী কোরে নিঃসাড় কোরে দিলেন, স্থবির কোরে দিলেন। এরা জীবনের নতুন লক্ষ্য স্থাপন কোরলেন। আল্লাহ(Allah) তার রসুলের (দঃ) জন্য তার (দঃ) জীবনের লক্ষ্য নির্দিষ্ট কোরে দিয়েছিলেন। কোরানে বোলেছিলেন- আল্লাহ(Allah) তার রসুলকে পাঠিয়েছেন পথ-প্রদর্শন ও সত্য দ্বীন দিয়ে এই জন্য যে, তিনি পৃথিবীতে প্রচলিত অন্যান্য সমস্ত দ্বীনগুলির ওপর একে প্রতিষ্ঠা কোরবেন। তার রসুলের জীবনের লক্ষ্য এত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বোলে দিয়েও সন্তুষ্ট না হোয়ে, এযে কত গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাবার জন্য বোললেন- (এই কথার) সাক্ষী হিসাবে স্বয়ং আল্লাহ(Allah)ই যথেষ্ট (কোরান- সূরা আল ফাতাহ ২৮)। আল্লাহ(Allah)র ভাষা থেকে মনে হয় যেন তিনি জানতেন, তার রসুলের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের মধ্যে মতভেদ হবে। তাই যেন তিনি বোলছেন যে, তোমাদের মধ্যে যত মতভেদই হোক, আসলে তার জীবনের লক্ষ্য কি তা আমি বোলে দিলাম ও এর সত্যতা সম্বন্ধে আমি স্বয়ং সাক্ষী রইলাম। এই সত্য উপলব্ধি কোরে বিশ্বনবী (দঃ) ঘোষণা কোরলেন- আমি আদিষ্ট হোয়েছি (আল্লাহ(Allah) কর্তৃক) যে, আমি যেন সমস্ত মানব সমাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাই যে পর্য্যন্ত না তারা আল্লাহ(Allah)কে একমাত্র প্রভু (এলাহ) বোলে এবং মোহাম্মদকে তার প্রেরিত বোলে স্বীকার করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত প্রদান করে(হাদিস- আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) থেকে বোখারী, মেশকাত)। এখানে আমি 'সশস্ত্র সংগ্রাম' অনুবাদ কোরেছি এইজন্য যে, বিশ্বনবী (দঃ) শব্দ ব্যবহার করেছেন কিতাল, যার অর্থ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ। আল্লাহ(Allah) ও তার রসুলের অকাট্য বাণী থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রসুলুল্লাহর (দঃ) জীবনের উদ্দেশ্য কী ছিলো। এখানে একটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় আবার এসে যাচ্ছে। তা হলো- যে জীবনের লক্ষ্য এই বিশাল পৃথিবীতে এক আদর্শ, এক জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। সে জীবন অতি অবশ্যই হবে বহির্মুখী (Extrovert), সে জীবনের দৃষ্টি হবে বহির্মুখী, এবং হোয়েছেও তাই। তার সম্পূর্ণ জীবনটাই বহির্মুখী। শুধু তাই নয়, তিনি যে জাতিটি সৃষ্টি কোরলেন তারও জীবন হলো বহির্মুখী। স্বভাবতঃই, কারণ আল্লাহ(Allah) তার নবীর ওপর যে কাজের ভার চাপিয়ে দিলেন এবং নবীর (দঃ) পর যা তার উম্মাহর ওপর চাপলো সে কাজটাই তো বহির্মুখী, সমস্ত পৃথিবীর ওপর এই দ্বীন স্থাপন করা। কাজেই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, রসুলের (দঃ) ও তার সৃষ্ট উম্মাহর চরিত্রকে শুধু বহির্মুখী (Extrovert) বলা যথেষ্ট হয় না, বোলতে হয় বিস্ফোরণমুখী (Explosive)। বিশ্ব নবীর (দঃ) জীবিত কালে প্রথম বিস্ফোরণ সমস্ত আরবকে আচ্ছন্ন কোরে দিলো এবং তার (দঃ) ওফাতের পর তার উম্মাহর বিস্ফোরণ আটলান্টিক মহাসাগরের তীর থেকে চীনের সীমান্ত পর্য্যন্ত আচ্ছাদিত কোরে দিল।

বোলছিলাম, এই সুফী সাধকরা ইসলামের ভারসাম্য নষ্ট কোরে দিলেন। কেমন কোরে সেইটা এখন বিবেচ্য। আল্লাহ(Allah) ও তার রসুল (দঃ) জাতির সামনে যে লক্ষ্য নির্দিষ্ট কোরে দিয়েছিলেন এই আধ্যাত্ম সাধকরা সেটা বদলিয়ে নতুন লক্ষ্য স্থাপন কোরলেন। সেটা হলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরে, আত্মাকে উন্নত কোরে আল্লাহ(Allah)র সান্নিধ্য লাভ, এবং তা কোরতে ঐ বিশেষ প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপই হলো লোক সান্নিধ্য বর্জন কোরে নির্জনতা বেছে নেয়া। অর্থাৎ রসুলাল্লাহ (দঃ) তার জাতির, উম্মাহর যে বহির্মুখী সংগ্রামী চরিত্র সৃষ্টি কোরেছিলেন তার ঠিক বিপরীতমুখী- অন্তর্মুখী। অন্যান্য ধর্মের আধ্যাত্দিক সাধকরা তাদের সাধনার প্রক্রিয়ার মাল-মশলা তাদের যার যার ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে সংগ্রহ কোরেছিলেন। এ ধর্মের সুফী-সাধকরাও কিছু কিছু মাল-মশলা কোরান-হাদীস থেকেখুঁজে বের কোরলেন। খুব বেশী কিছু পেলেন না, কারণ এ জীবন-ব্যবস্থা সংগ্রামী, নির্জনে বোসে সাধনার কোন ব্যবস্থা এতে নেই। কিন্তু যেহেতু এ দ্বীন ভারসাম্যযুক্ত, দেহ ও আত্মার উভয়ের উন্নতির ব্যবস্থা এতে আছে, কাজেই আত্মার দিকের যেটুকু আছে ঐ টুকুকেই তারা আলাদা কোরে নিয়ে নিলেন এবং তাতে যোগ কোরলেন কিছু প্রক্রিয়া, যা তারা অন্যান্য ধর্মের প্রক্রিয়া থেকে নিলেন ও কিছু নিজেরা তৈরী কোরে নিলেন। ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হোয়ে গেলো। এই দ্বীনে মানুষের আত্মার উন্নতির যে অংশটুকু আছে তাকে যদি মা'রেফাত বোলে ধোরে নেওয়া যায় তবে এ দ্বীন হলো শরিয়াহ ও মা'রেফাতের মিশ্রণে একটি পূর্ণ ব্যবস্থা। মানুষ এক পায়ে হাটতে পারে না, তাকে দু'পায়ে ভারসাম্য কোরতে হয়। দ্বীনেরও দু'টি পা। এক পা শরিয়াহ অন্য পা মারেফাত। এই দুই পায়ের সহযোগিতায় একটা মানুষ ভারসাম্য রেখে হাটতে পারে। একটা জাতির বেলায়ও তাই। ঐ দুই পায়ের একটা বাদ দিলে বা নিষ্ক্রিয় হোয়ে গেলে ঐ জাতিও আর হাটতে পারবেনা, তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যেও পৌঁছতে পারবে না। সুফী-সাধকরা এই দ্বীনের মারেফাতের পাটাকে আঁকড়ে ধোরলেন। অবশ্য শারিয়াহর পায়ের যেটুকু ব্যক্তিগত পর্য্যায়ের সেটুকু আংশিকভাবে গ্রহণ কোরলেন। কিন্তু এ দ্বীনের শরিয়াহ প্রধানতই জাতীয়; রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ও দণ্ডবিধিই এর প্রধান ভাগ। এই প্রধান অংশটুকুকে বাদ দিয়ে শুধু ব্যক্তিগত শরিয়াহ ও আত্মার উন্নতির অংশটুকু গ্রহণ কোরে নির্জনবাসী হয়ে সুফীরা এই দ্বীনের একটা পা কেটে ফেললেন। ফলে এ দ্বীন স্থরিব হোয়ে গেলো, চলার শক্তি হারিয়ে ফেললো। যে জিনিসের গতি নেই সেটা মৃত, গতিই প্রাণ। এক পা হারিয়ে এই জাতি চলার শক্তি হারালো তার পর ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। যে জাতি শরিয়াহ আর মারেফাতের দু'পায়ে হেঁটে আরব থেকে বের হয়ে আটলান্টিকের তীর আর চীনের সীমান্ত পর্য্যন্ত গেলো, সে জাতি ফকিহ, মুফাসসির আর সুফীদের কাজের ফলে চলার শক্তি হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।

সুফীদের যে উদ্দেশ্য চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক উন্নতি তা জাতিগতভাবে অসম্ভব। একটা জাতির অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ নির্জনের বা হুজরায় বোসে ব্যক্তিগতভাবে আত্মিক উন্নতি কোরতে পারে এবং ব্যক্তিগতভাবে তার ফলও ভোগ কোরতে পারে। কিন্তু তাতে জাতি উপকৃত হোতে পারে না- পারলেও তা অতি সামান্য। যদিঐ আধ্যাত্দিক উন্নতি লাভই এই উম্মাহর একমাত্র উদ্দেশ্য হতো, তবে মহানবীর (দঃ) জীবনটাই অন্য রকম হতো। তিনি তাহলে একটা একটা কোরে মানুষ মুরীদ কোরে তাকে হুজরায়, খানকায় বসিয়ে দিতেন নামায, তাসবিহ মোরাকেবা, মোশাহেদা আর যিকর দিয়ে, বর্তমানের ধর্মীয় নেতাদের মত এবং তা কোরলে তদানিন্তন মোশরেক ও কাফের সমাজের সাথে তার কোন সংঘর্ষও হতো না। কারণ তখনকার মূর্তিপূজক আরব সমাজে খ্রীস্টান ছিলো, ইহুদী ছিলো, এমনকি তাসাওয়াফ প্রক্রিয়া তরিকা অনুশীলনকারী লোকও ছিলো। তদানিন্তন মোশরেক আরববা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতো না, তাদের সাথে মিলেমিশে বাস করতো, এটা ইতিহাস। কাজেই বিশ্বনবী (দঃ)যদি নতুন একটি তরিকা উদ্ভাবন কোরে তাতে লোক ভর্তি শুরু কোরতেন এবং তাদের আল্লাহ(Allah)র নৈকট্য লাভের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া শিক্ষা দিতেন তবে নিশ্চিত বলা যায় যে, মোশরেক সমাজ তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ কোরতো না। হযরত ওয়ায়েস করণী (রাঃ) শেষ নবীর (দঃ) নতুন জীবন-বিধান প্রচারের অনেক আগে থেকেই তাসাওয়াফ সাধনা কোরতেন। মোশরেক আরবরা তাকে কোন রকম বাধা দিয়েছে বা উত্যক্ত কোরেছে বোলে কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু বিশ্বনবী (দঃ) তা করেননি। তিনি এমন এক জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, জেহাদ আরম্ভ কোরলেন যা আইন ও তাসাওয়াফের, শারিয়াহ ও মারেফাতের ভারাসাম্যযুক্ত। এর প্রথম ও প্রধান অংশ হলো আইন, যার মধ্যে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি সর্বরকম বিধান রোয়েছে। মোশরেক আরব সমাজ বিশ্বনবীর (দঃ) কার্য প্রনালী থেকে শীগগীরই বুঝতে পারলো যে, তাসাওয়াফের মাধ্যমে স্রষ্টার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন কোরে তার নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া শিক্ষা দেওয়া মোহাম্মদের (দঃ) লক্ষ্য নয়, তার উদ্দেশ্য হোচ্ছে তাদের সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে সেখানে নতুন আইন, নতুন সমাজ-ব্যবস্থা স্থাপন করা- একটা সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তাই তারা বিশ্বনবীর (দঃ) বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।

প্রশ্ন আসে তবে কি আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের প্রয়োজনীয়তা এ দ্বীনে নেই? আছে, আগেই বলেছি এ দ্বীন ভারসাম্যযুক্ত, কাজেই দুটোই আছে। কিন্তু প্রথম হলো পৃথিবীতে আল্লাহ(Allah)র আইন প্রতিষ্ঠিত কোরে শান্তি (ইসলাম(Islam)) প্রতিষ্ঠা কোরে তারপর আল্লাহ(Allah)র নৈকট্য লাভের চেষ্টা। প্রথমটা ফরজ, দ্বিতীয়টা নফল। ফরদ নামায বাদ দিয়ে শুধু সুন্নত বা নফল নামায পড়লে শরিয়াহ মোতাবেকই তা যেমন নাজায়েয, ঠিক তেমনি বিশ্বনবীর (দঃ) ওপর আল্লাহ(Allah)র দেয়া দায়িত্বকে পূর্ণ করার ফরদ কাজ বাদ দিয়ে আল্লাহ(Allah)র নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া অর্থাৎ নফল কাজ নিয়ে ব্যস্ত হোলে তা ঐ শরিয়াহ মোতাবেকই জায়েয হবে না। প্রথমে ফরজ তারপর ওয়াজেব, তারপর সুন্নাহ, তারপর নফলও তারপর মুস্তাহাব। এ ধারাবাহিকতার গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রণালী (Pririty) আল্লাহ(Allah) ও তার রসুলই (দঃ) বিধিবদ্ধ কোরে দিয়েছেন। সুতরাং তা ভঙ্গ কোরে অগ্রাধিকারের গুরুত্বের (Pririty) ওলট-পালট যায়েজ হবে না। শুধু তাই নয় আল্লাহ(Allah)র হাবীবের (দঃ) সুন্নাহ অর্থাৎ পৃথিবীতে এই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম বাদ দিয়ে আল্লাহ(Allah)র নেকট্য লাভের চেষ্টা আল্লাহ(Allah) মঞ্জুর কোরবেন কি? কারণ বিশ্বনবী (দঃ) প্রদর্শিত পথ ছাড়া মুসলিমের, মোমেনের জন্য অন্য আর কোন পথ (তরিকা) নেই। মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ (দঃ) শুধু মুসলিমের নয়, সমস্ত মানব জাতির একমাত্র আশা, একমাত্র ভরসা। ঐ একটি মানুষই আল্লাহ(Allah) সৃষ্টি কোরেছেন যাকে সমস্ত মানব জাতির মুক্তির জন্য আল্লাহ(Allah)র কাছে সুপারিশ করার অধিকার দেয়া হবে কিয়ামতের দিনে। অন্যান্য সমস্ত নবীদের দেয়া হবে শুধু তাদের যার যার উম্মাহর মুক্তির জন্য সুপারিশের অনুমতি। আল্লাহ(Allah)র নৈকট্য লাভ যদি এই শেষ জীবন-ব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ্য হতো তবে বলবো এটা মাত্র গুটি কয়েকজন লোকের জন্য এসেছে। কারণ কোটিতে একজন লোক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ যিনি তাসাওয়াফের প্রক্রিয়ায় সাধনা রেয়াযত কোরে স্রষ্টার নৈকট্য বা তার সাথে মিশে যেতে পেরেছেন। দু'চার কোটিতে একজন কোরে এমন লোক, যিনি ফানা-ফিল্লাহ বা বাকি-বিল্লাহর স্থরে পৌঁছতে পেরেছেন, সুফী তৈরী করাই যদি রসুলাল্লাহর (দঃ) ওপর দায়িত্ব হতো তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, তার সম্পূর্ণ জীবনটাই অন্য রকম হতো, তার শিক্ষাও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হতো। তিনি তাহলে একটি জাতি, একটি উম্মাহ সৃষ্টি কোরতেন না, একটি সুফী তরিকার উদ্ভাবন কোরতেন। যে সশস্ত্র সংগ্রাম তিনি সারা জীবন ধোরে কোরলেন তার প্রয়োজন হতো না।

শেষ ইসলামের ভারসাম্য নষ্ট কোরে এই সুফীর দল যাকে আদর্শ হিসাবে বেছে নিলেন তিনি বিশ্বনবী (দঃ) নন, তিনি মহাসাধক ওয়ায়েস করণী (রাঃ), যিনি রাসূলাল্লাহর (দঃ) নুবয়াত পাওয়ার অনেক আগে থেকেই আত্মিক উন্নতি অর্থাৎ তাসাওয়াফের সাধনা কোরে অতি উচ্চ স্তরে (মাকামে) অধিষ্ঠিত হোয়েছিলেন। শেষ প্রেরিতের নবুয়াত পাওয়ার আগে থেকেই যিনি সাধনা কোরছিলেন তিনি কী প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরছিলেন? নিশ্চয়ই মহানবীর (দঃ) শেখানো পদ্ধতিতে নয়, হয় খ্রীস্টান বা ইহুদী বা বৌদ্ধ বা হিন্দু বা অন্য যে কোন পূর্ববর্তী ধর্মের পদ্ধতি হবে। তা সত্ত্বেও তার সাধনা যে সম্পূর্ণ সফল ছিলো তার প্রমাণ তার জীবনী এবং বিশেষ কোরে এই যে মহানবী (দঃ) তার পবিত্র জোব্বা (জড়নব) তাকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ায়েস করণী (রঃ) বিশ্বনবীর (দঃ) জীবনের কর্ম প্রবাহে যোগ দেননি, এমন কি তার (দঃ) সাথে তার দেখাই হয়নি। মহানবী (দঃ) আল্লাহ(Allah)র কাছ থেকে যে মহাদায়িত্ব নিয়ে এসে এবং তা পালন কোরতে যে অবিশ্বাস্য দুঃখ, দুর্দশার সংগ্রামের জীবন অতিবাহিত কোরলেন, তাতে ওয়ায়েস করনী (রঃ) অংশ নেননি- মা কে ছেড়ে আসতে হয় বোলে। আবু বকর (রাঃ) থেকে শুরু কোরে হাজার হাজার আসহাব তাদের শুধু মা কে ছেড়ে নয়, বাপ-মা, স্ত্রী-পুত্র, কন্যা, সম্পত্তি, বাড়ী-ঘর হেলায় ত্যাগ কোরে এসে মহানবীর (দঃ) সঙ্গী হোয়েছেন, তার সঙ্গে সব রকম দুঃখ বরণ কোরেছেন, বছরের পর বছর ছায়াহীন উত্তপ্ত মরুভূমিতে কাটিয়েছেন, বিশ্বনবীর (দঃ) দায়িত্ব পূরণের সশস্ত্র সংগ্রামে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। সুফীরা ওহোদের যুদ্ধে বিশ্বনবীর (দঃ) পবিত্র দাঁত ভেঙ্গে যাওয়ার খবরে ওয়ায়েস করণীর (রঃ) নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলাকে ভালবাসার চূড়ান্ত পরিচয় হিসাবে পেশ করেন। নিজের দাঁত ভেঙ্গে ফেলা বেশী ভালবাসার পরিচয়, না প্রিয় নেতার জীবন রক্ষার জন্য তাকে ঘিরে দাড়িয়ে শত্রুর অজস্র তীর নিজেদের শরীর দিয়ে ঠেকিয়ে তীরে তীরে সজারুর মত হোয়ে যাওয়া বেশী ভালবাসার পরিচয়? শত্রুর আক্রমণ থেকে বিশ্বনবীকে (দঃ) রক্ষা কোরতে জীবন পণ কোরে যুদ্ধ কোরে মারাত্মক আহত হোয়ে প্রাণের চেয়ে প্রিয় নেতার পবিত্র পায়ের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে মরে যাওয়া কতখানি ভালবাসার প্রমাণ [যিয়াদ (রাঃ)]। আর যদি দাঁতের কথাই তুলেন তবে রসুলুল্লাহর (দঃ) মাথায় ঢুকে যাওয়া শিরস্ত্রাণের পেরেক পাগলের মত কামড়িয়ে টেনে তুলতে যেয়ে আবু ওবায়দার (রাঃ) কয়েকটা দাঁত ভেঙ্গে ফেলার কথা ভূলে যাচ্ছেন কেন? ঐ ওহোদের যুদ্ধেই। লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র যে দশজন লোককে আল্লাহ(Allah)র সম্পূর্ণ ক্ষমা ও জান্নাতের সুসংবাদ তাদের জীবিতকালেই দেয়া হলো আবু ওবায়দা (রাঃ) তাদের অন্যতম- ওয়ায়েস করনী (রাঃ) নন। রসুলাল্লাহর (দঃ) নিজের ব্যবহৃত খেরকা (Robe) ওয়ায়েস করণীকে (রাঃ) উপহার দেওয়াও এদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মানের চিহ্ন হিসাবে বিবেচিত। বহু বইয়ে পড়েছি, বহু ওয়াজে এ ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ শুনেছি। কিন্তু বিদায় হজ্জ্বে মাথার চুল কামিয়ে সমস্ত পবিত্র চুলটুকু যে মহানবী (দঃ) আল্লাহ(Allah)র তলোয়ার খালেদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)কে উপহার দিয়েছিলেন এবং খালেদ (রাঃ) যে সেই মহাপবিত্র চুলগুচ্ছ তার টুপির মধ্যে সেলাই কোরে নিয়েছিলেন এবং প্রতিটি যুদ্ধে তিনি শিরস্ত্রাণের নিচে সেই টুপি পড়তেন- কই, কোন ওয়াজে, কোন বক্তৃতায় তো তা শুনি না। কাপড়ের তৈরী খেরকা উপহার দেয়া বেশী মেহেরবাণীর চিহ্ন না নিজের দেহের অংশ, মাথার চুল উপহার দেয়া বেশী স্নেহের, বেশী প্রেমের চিহ্ন? ওয়ায়েজরা খালেদকে (রাঃ) রসুলাল্লাহর চুল উপহার দেবার কথা বলেন না- বলেন ওয়ায়েসকে (রাঃ) খেরকা উপহার দেয়ার কথা কারণ খালেদ (রাঃ) তার সমস্ত কিছু নিজের প্রাণ আল্লাহ(Allah)র ও তার রসুলের (দঃ) জন্য উৎসর্গ কোরে অস্ত্র হাতে সংগ্রাম কোরে গেছেন সারা জীবন। ওটা অনুসরণ করা বড় কষ্ট, বড় কোরবাণী, বড় জানের বিপদ। ওয়ায়েসের (রাঃ) কথা সর্বত্র বলেন কারণ হুজরায় বোসে আধ্যাত্মিক সাধনায়, নফল নামায, রোযায়, তসবিহ টানতে বিপদের আশংকা নেই।

সাবধান! আমি ওয়ায়েস করনীকে (রাঃ) ছোট করার জন্য এসব বোলছি বোলে কেউ মনে কোরবেন না। যে ভারসাম্য বিনষ্ট হোয়ে, যে আকীদা বিকৃত হোয়ে যেয়ে আজ এই জীবন-ব্যবস্থা পৃথিবীতে অবহেলার জিনিষ হোয়ে গেছে, এই জাতি আল্লাহ(Allah) রসুলের (দঃ) চোখে কার্যত মুশরেক, কাফের হোয়ে গেছে- সেই ভারসাম্য, সেই আকীদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্যই আমি লিখছি। আমি ওয়ায়েস করণীকে (রাঃ) ছোট রকার জন্য লিখতে পারি না। কারণ যাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহ(Allah)র রসুল (দঃ) তার ব্যবহৃত কাপড় উপহার দিয়েছেন তাকে কোন রকম ছোট করা কোন মুসলিমের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া পরবর্তীকালে এই মহা সাধক প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী হবার অর্থ কি তা উপলব্ধি কোরতে পেরেছিলেন বোলেই নির্জনতা ত্যাগ কোরে উম্মাহর বহির্মুখী জীবন প্রবাহে যোগ দিয়েছিলেন এবং অস্ত্র হাতে জেহাদে নেমে শহীদ হোয়েছিলেন। অর্থাৎ এই ভারসাম্যযুক্ত জীবন-ব্যবস্থার দুটো দিকেই তিনি কামেলিয়াত, সিদ্ধিলাভ কোরলেন। আমি যা বোলতে চেষ্টা কোরেছি, ওয়ায়েস করনীর (রাঃ) জীবন তারই দৃষ্টান্ত। কাজেই তাকে কি কোরে ছোট কোরতে পারি? তাকে ছোট কোরছেন ভারসাম্যহীন সুফীরা।

আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আল্লাহ(Allah)র নৈকট্য লাভ, আত্মার উন্নতি করাটাই যারা ইসলামের সবটুকু মনে করেন বা অন্ততঃ প্রধান অংশ ও কর্তব্য মনে করেন তারা তাদের যুক্তির পক্ষে কোরানে বর্ণিত খিদিরের (আঃ) ঘটনা উল্লেখ করেন। প্রথম কথা হলো- সমস্ত ব্যাপারটা সাধারণ নয়- অসাধারণ। আল্লাহ(Allah) তার অসীম ও সর্বব্যাপী শক্তি দিয়ে তার এই বিপুল সৃষ্টিকে চালনা করেন। কেমন কোরে তা করেন সে জ্ঞান তিনি ছাড়া আর কারুরই নেই। মুফাস্সিরদের মতে কোরানে বর্ণিত ঘটনাটার কারণ হলো এই যে, একবার মুসার (আঃ) মনে এই ধরণা হলো যে, যেহেতু তিনি আল্লাহ(Allah)র নবী কাজেই সব রকম জ্ঞানই তাকে দেয়া হোয়েছে এবং তার চেয়ে বেশী জ্ঞানী আর কেউ নেই। তার এই ভুল ধারণা অপনোদন করার জন্য আল্লাহ(Allah) তাকে খিদিরের (আঃ) সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলেন এবং মুসার (আঃ) ভুল ভাঙ্গলো। আল্লাহ(Allah) যে রহস্যময়ভাবে তার সৃষ্টি পরিচালনা করেন খিদির (আঃ) তার একটি মাধ্যম মাত্র। আর নবুয়াত হলো মানুষ কেমন কোরে পৃথিবীতে শান্তিতে অর্থাৎ ইসলামে বাস কোরবে সেই জীবন-ব্যবস্থার জ্ঞান ও শিক্ষা। দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, ভিন্ন জ্ঞান। এই দুটো জ্ঞানের মধ্যে নবীদের মাধ্যমে আল্লাহ(Allah)র দেয়া জ্ঞানই হোচ্ছে আমাদের জন্য। স্রষ্টা কেমন কোরে তার সৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করেন তা জাতি অর্থাৎ নবীদের উম্মাহ হিসাবে আমাদের জন্য নয়। তা না হলে মুসাকে (আঃ) নবী না কোরে আল্লাহ(Allah) তো খিদির (আঃ)কেই নবী বানাতে পারতেন এবং তা হোলে খিদির (আঃ) ঐ বিশেষ জ্ঞানই তার উম্মাহর জন্য নির্দিষ্ট হোয়ে যেতো। দ্বিতীয়তঃ খিদিরকে (আঃ) চিরজীবি বলা হয়। আল্লাহ(Allah) বোলেছেন- প্রত্যেক জীবকে মরতে হবে (কোরান- সূরা আলে ইমরান ১৮৫। আন নিসা ৭৮)।' খিদির যদি চিরজীবী হোয়ে তাকেন তবে প্রশ্ন উঠে তিনি আমাদের মত মানুষ বা কোন জীব কিনা তার নাম খিদির অর্থর্াৎ সবুজ বা চির সবুজ- নামটাই তো এ ব্যাপারে সন্দেহজনক। তৃতীয়তঃ খিদিরের (আঃ) জ্ঞান হলো এক বিশেষ জ্ঞান, যাকে বলা যায় (Specialised Knowledge) কিন্তু বিশেষ বোলেই সেটা মুসার (আঃ) জ্ঞানের চেয়ে উচ্চতর কিছু তা মনে করার কোন কারণ নেই।ধরুন কোন দেশ বা জাতির সর্বময় প্রধান। তিনি জ্ঞানী, গুণী, সুশাসক, সুবিচারক। তার জাতির মধ্যে অনেক বিশেষ গুণধারী মানুষ আছেন। চিকিৎসক আছেন, প্রকৌশলী, নৌবিদ্যা বিশারদ, সামরিক বিশেষজ্ঞ, সেচ বিভাগীয় বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি আছেন। ঐ শাসক ঐ সব বিশেষজ্ঞদের সব জ্ঞানের অধিকারী নন- কিন্তু তাই বোলে তিনি যে জাতির সর্বময় কর্তা তা বদলাবে না। ঐ বিশেষজ্ঞরা তাদের যার যার জ্ঞান ঐ শাসককে শেখাতে পারেন। কিন্তু তারা তাদের ঐ বিশেষ জ্ঞান (Specialised Knowledge) নিয়েও ঐ শাসকের অধীন, তার আদেশ অনুযায়ী চলেন। চতুর্থ কথা হলোঃ খিদির (আঃ) মুসাকে (আঃ) যে কয়টি কাজ কোরে দেখালেন সেগুলির প্রতি লক্ষ্য কোরে দেখুন। নৌকা ছিদ্র কোরে একজনের নৌকাটা রক্ষা কোরলেন। একটা ছেলেকে হত্যা কোরে তার বাপ মাকে এক ভবিষ্যতে দুস্কৃতিকারী সন্তানের হাত থেকে রক্ষা কোরলেন এবং একটি দেয়াল মেরামত কোরে একজনের সম্পত্তি রক্ষা কোরলেন। এই তিনটি কাজের প্রত্যেকটিই ব্যক্তিগত ব্যাপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোনটিই জাতিগত অর্থাৎ বৃহত্তর নয়। অন্যদিকে মুসার (আঃ) কাজ ছিলো জাতির জন্য এমন এক জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেটার প্রতিষ্ঠা হোলে হয়ত জবর দখলকারী ঐ রাজারই অস্তিত্ব থাকতো না, ঐ দুস্কৃতিকারী ছেলে দুস্কৃতিকারী হতো না, এবং এমন সমাজ সৃষ্টি হতো যে সমাজ ঐ ইয়াতীম বালকের সম্পদ রক্ষা কোরে যথা সময়ে তাকে দিয়ে দিতো। আসল কথা হলো কোরানে ঐ ঘটনা মুসার (আঃ) নিজের সম্বন্ধে একটা ভুল ধারণা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। ওটাকে যদি আমাদের প্রধান কর্তব্য বোলে নিয়ে ঐ নিয়ে মাতামাতি করি তবে পথভ্রষ্ট হোতে হবে।

তাহলে সুফীদের প্রবর্তিত এই -তাসাওয়াফ কি? আদম (আঃ) থেকে শেষ নবী (দঃ) পর্য্যন্ত আল্লাহ(Allah) এই দ্বীন-এ ইসলাম(Islam) পাঠিয়েছেন একটা ভারসাম্য দিয়ে। প্রত্যেকটিকে একদিকে যেমন মানুষের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিধান রোয়েছে-তেমনি তার আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়াও রোয়েছে। দু'দিকেই সমান এবং একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা একেবারে অচল। মানুষ যেমন দুপায়ে চলে, এক পায়ে চলতে পারে না, দ্বীনও একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা একা চলতে পারে না। আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়া পূর্ববর্তী সমস্ত দ্বীনেই ছিলো, বিকৃত অবস্থায় আজও আছে। এবং ঐ পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরলে আজও ফল পাওয়া যায়। আজও অন্যান্য ধর্মে অতি শক্তিশালী মহা সাধকরা আছেন যাদের কেরামত অলৌকিক ক্ষমতা মুসলিম(Muslim) ওলী, আওলিয়াদের চেয়ে কম নয়। যে কেউ-ই নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরলে তার ফল পাবে, তার আত্মার শক্তি বৃদ্ধি পাবে, অদৃশ্যের, গায়েবের অনেক খবর তার কাছে আসবে, সাধারণ মানুষ যা পারে না তেমন কাজ করার ক্ষমতা জন্মাবে, এক কথায় তাসাওয়াফের বই-কেতাবে যে সব উন্নতির কথা লেখা আছে সবই হবে। কিন্তু এ শেখাতে বিশ্বনবী (দঃ) আসেননি। এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফী ও আলেম, হাকীম-আল-উম্মাহ আশরাফ আলী থানভী (রঃ) লিখেছেন- "মানব শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যেমন জাহিরী (প্রকাশ্য) শক্তি রহিয়াছে। সেইরূপে মানুষের রূহের (আত্মার) মধ্যে অনেক বাতেনী (গুপ্ত) শক্তি নিহিত আছে। শরীর চর্চার মাধ্যমে যেমন মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেমন শক্তিশালী হইয়া উঠে, তদ্রূপ আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা তাহাদের রূহানী শক্তি বৃদ্ধি পায় (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ- ইসলামিক ফাউণ্ডেশন-১ম খণ্ড ৭৬ পৃঃ)। আশরাফ আলী থানভী প্রকৃত সত্য কথা লিখেছেন এবং সে সাধনার কথা লিখেছেন যে সাধনার প্রক্রিয়া প্রতিটি ধর্মেই আছে। শুধু এই প্রক্রিয়া শেখাতে শেষনবী (দঃ) আসেননি। আল্লামা আযাদ সোবহানী লিখেছেন- "মোহাম্মদকে (দঃ) একটি বিরাট গাছ হিসাবে নিলে তাসাওয়াফ তার একটা ডাল মাত্র।" আমিতো শারিয়াহ ও তাসাওয়াফকে মোটামুটি অর্দ্ধেক অর্দ্ধেক ভাগ করেছি, দুটো পা বোলে, আল্লামা সোবহানী তাওসায়াফকে একটি ডালের চেয়ে বেশী বলেননি।

তাসাওয়াফের প্রক্রিয়ায় সাধনা কোরে আত্মার উন্নতি কোরে আল্লাহ(Allah)র নৈকট্য লাভ যে এই দ্বীনের মুখ্য উদ্দেশ্য নয় তার চূড়ান্ত প্রমাণ এই হাদিসটি- হিজরতের আগে, যখন মোশরেকদের অমানুষিক অত্যাচার, নির্য্যাতন মুষ্ঠিমেয় মুসলিম(Muslim)দের অসহ্য হোয়ে উঠেছে অথচ তারা অসহায়, কিছু করার নেই, তখন একদিন এক সাহাবা বিশ্বনবীকে (দঃ) বোললেন- হে আল্লাহ(Allah)র রসুল! আপনি দোয়া করুন যাতে এই মোশরেকরা ধ্বংস হোয়ে যায়। এটা ইতিহাস যে মানব জাতির মুকুটমনি (দঃ) জীবনে খুব কমই রাগান্তিত হোয়েছেন। সেদিন ঐ সাহাবার কথা শুনে তিনি রেগে গিয়েছেলেন এবং বোলেছিলেন- শীগগীরই এমন সময় আসছে যখন একটি মেয়ে লোক একা সানা থেকে হাদরামাউত পর্য্যন্ত ভ্রমণ কোরতে পারবে, তার মনে এক আল্লাহ(Allah) এবং বন্য পশু ছাড়া আর কিছুরই ভয় করার থাকবে না [হাদীস- খাব্বাব (রাঃ) থেকে- বোখারী, মেশকাত ]। বিশ্বনবীর (দঃ) কথাটার ভেতরে প্রবেশ করুন। তিনি কি বোললেন? তিনি ইংগিত দিলেন, এত বাধা, এত অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি সফল হবেন এবং যাদের ধ্বংস করার জন্য ঐ সাহাবা দোয়া কোরতে বোলছেন তারাই এমন বদলে যাবে এবং তাদের দিয়েই এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে একা একটা মেয়ে মানুষ কয়েক শ'মাইল পথ নির্ভয়ে চলে যেতে পারবে। রসুলুল্লাহ (দঃ) তার সাহাবাকে যে উত্তরটি দিলেন তা দিয়ে শুধু একটি মাত্র কথা বোঝায় আর তা হলো এই যে, তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হোচ্ছে এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যেখানে ন্যায়-বিচার, আইন-শৃংখলা ও জনসাধারণের নিরাপত্তা এমন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, একা একটি মেয়ে মানুষও ঐ দূরত্বের পথে চলতে কোন ভয়ই কোরবে না। তিনি ঐ সাহাবার জবাবে এ কথা বোললেন না যে, এমন সময় আসছে যখন এই সব মোশরেক ও কাফেররা দলে দলে মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়বে, রোযা রাখবে, হজ্জ কোরবে, যাকাত দেবে, দাড়ি রাখবে, টুপি পরবে, চিল্লায়, খানকায় বোসে মোরাকাবা কোরবে, যিকর কোরবে। তার কথার একমাত্র অর্থ হোচ্ছে, এমন একটিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও এমন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব শুধুমাত্র আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন-ব্যবস্থা মানুষের সার্বিক জীবনে প্রতিষ্ঠা হোলে, এবং তাই ছিলো বিশ্বনবীর (দঃ) জীবনের উদ্দেশ্য। এবং ঐ উদ্দেশ্য পূরণ ফিকাহর বিশ্লেষণ কোরেও হবে না, খানকায় বোসে রেয়াযাত কোরেও পাওয়া যাবে না। শুধু পাওয়া যাবে না নয় ফিকাহর বিশ্লেষণ ও খানাকায় তসবিহ টপকানো বিশ্বনবীর (দঃ) জীবনের উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ কোরে দেবে, এবং দেবে নয়- দিয়েছে। তার জীবনের উদ্দেশ্যকে পূর্ণ কোরতে পারে শুধুমাত্র দ্বীনুল কাইয়্যেমাকে, সেরাতুল মুস্তাকীমকে আকড়ে ধোরে রেখে একতাবদ্ধ হোয়ে, সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে যাওয়ার পথে। রসুলুল্লাহ (দঃ) সেদিন ঐ সাহাবার কথার উত্তরে যে ভবিষ্যত বাণী কোরেছিলেন তা কিছুদিনের মধ্যেই সত্যে পরিণত হয়েছিলো এটা ইতিহাস। এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোয়েছিলো যে রাষ্ট্রে অন্যায় অবিচার লুপ্ত হোয়ে গিয়েছিলো, সম্পত্তি ও জীবনের নিরাপত্তা এমন পর্য্যায়ে পৌঁছেছিলো যে সত্যই একজন মেয়ে মানুষ আরবের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্য্যন্ত নির্ভয়ে ভ্রমণ কোরতে পারতো। কিন্তু বিশ্বনবীর (দঃ) প্রতিষ্ঠিত ঐ রাষ্ট্র ফকিহ ও মুফাসসিরদের অতি বিশ্লেষণ দিয়েও হয়নি, আধ্যাত্মিক সাধকদের খানকায় বোসে মোরাকেবা দিয়েও হয়নি, হোয়েছে বিশ্বনবীর (দঃ) ও তার আসহাব মুজাহিদদের (রাঃ) অবিশ্রান্ত সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে। এটা ইতিহাস এবং এটাও ইতিহাস যে আমাদের ফকিহ ও সুফীদের জন্ম হোয়েছে বহু পরে। মহানবী (দঃ) ও তার আসহাবদের কেউই হুজরায় বা খানকায় বসেননি।

কিন্তু যেহেতু সুফীরা মানব জীবনের একটি দিককে আকড়ে ধোরলেন সুতরাং তারা ভারসাম্যহীন হোয়ে গেলেন। যে ভারসাম্যের উপর আল্লাহ(Allah) এই শেষ ইসলাম(Islam)কে প্রতিষ্ঠা কোরেছিলেন সেই ভারসাম্য, সেরাতুল মুস্তাকীম সুফীরা নষ্ট কোরে দিয়ে এক পাশে, আত্মার পাশে ঝুঁকে পড়লেন। দ্বীন এক পা ওয়ালা মানুষের মত চলার শক্তি হারিয়ে ফেললো। নিজেদের কাজকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য তারা যুক্তি দেখালেন- আমরা তো জেহাদ ছাড়িনি। আমরা জেহাদে আকবর কোরছি, কারণ নফসের সঙ্গে জেহাদ হোচ্ছে জেহাদে আকবর বড় জেহাদ। তাদের এই যুক্তি যে অসার রসুলের (দঃ) সুন্নত থেকে কাপুরুষের মত পলায়নের পক্ষে ভুল হাদীসের উল্লেখ ও সরাসরি কোরানের বিরোধিতা সম্মুখে একটি আলাদা পরিচ্ছদে তা দেখাবো। আল্লাহ(Allah) যে জন্য এই জেহাদ কোরতে আদেশ কোরছেন তা হলো যে জন্য তিনি তার রসুল পাঠিয়েছেন- অর্থাৎ পৃথিবীময় আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন-ব্যবস্থা, ইসলাম(Islam), প্রতিষ্ঠা করা। এই জেহাদ যারা কোরবে তাদের নিজেদের চরিত্র গঠন কোরতে গেলে তাদের ভেতরের শয়তানের বিরুদ্ধেও তাদের জেহাদ কোরতে হবে। তাই বাইরের জেহাদ হবে প্রচার কোরে, মানুষকে যুক্তির মাধ্যমে বুঝিয়ে, বক্তৃতা কোরে, লিখে এবং অস্ত্র নিয়ে। এবং ভেতরের জেহাদ হবে শয়তানের প্ররোচনার বিরুদ্ধে, লোভ, অহংকার, হিংসা ইর্ষা, ক্রোধ ও কামের বিরুদ্ধে। এই দু'রকম জেহাদের যে কোনটাকে বাদ দিলেই সেই ভারসাম্য নষ্ট হোয়ে যাবে এবং সেই এক পা ওয়ালা মানুষের মত জাতিও চলার শক্তি হারিয়ে স্থবির হোয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, যে উদ্দেশ্যে ভেতরের জেহাদ সেই উদ্দেশ্যই অপূর্ণ থেকে যাবে। একটি মানুষ হোক আর একটি জাতিই হোক গতিই (Dynamism) প্রাণ, যারই গতি রুদ্ধ হোয়ে গেলো সেটাই মৃত। সুফীদের কাজের ফলে এই জাতি এক পা হারিয়ে স্থবির, গতিহীন অর্থাৎ মৃত হোয়ে গেলো। যে জন্য বিশ্বনবী (দঃ) বোলেছিলেন আমার জাতির আয়ু ৬০/৭০ বছর।

কিন্তু এইই সব নয়। অতি বিশ্লেষণকারী পণ্ডিতদেরও এই সুফীদের কাজের সম্মিলিত একটি ফল হলো যা ভয়ংকর, যা এই জাতিটিকে, এই উম্মাহকে একেবারে বিপরীতমুখী কোরে দিয়েছে। তা হলো এই যে, এই জাতিকে অন্তর্মুখী কোরে দিয়েছে। আমি পেছনে বোলে এসেছি যে, বিশ্বনবী (দঃ) যে জাতিটি সৃষ্টি কোরলেন সেটার মূল চরিত্র হলো শুধু বহির্মুখী নয় একেবারে বিস্ফোরণমুখী (Explosive)। এই জাতির ইতিহাস দেখুন। শত্রু মিত্র কেউই এ ইতিহাস সম্বন্ধে দ্বিমত পোষণ করে না যে, বিশ্বনবীর (দঃ) নেতৃত্বে এই জাতি একটি বোমের মত ফেটেছিলো এবং তেইশ বছরে সমস্ত আরব উপদ্বীপকে আচ্ছন্ন কোরে ফেলেছিলো। তারপর বিশ্বনবীর (দঃ) ওফাতের পর তার অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্তির পথে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে, জেহাদে, এই উম্মাহ আরেকবার বিস্ফোরিত হলো মহা শক্তিশালী এটম বোমের মত এবং এক বিস্ফোরণে মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে আটলান্টিকের তীর থেকে ভারত মহাসাগরের তীর পর্য্যন্ত আচ্ছন্ন কোরে ফেললো। এরপর আর কি কোন সন্দেহ থাকতে পারে যে, এই জাতির উম্মাহর মূল চরিত্র হচ্ছে জেহাদ এবং বিস্ফোরণমুখী (Explosive)? এবং ঐ চরিত্র সৃষ্টি কোরেছিলেন স্বয়ং আল্লাহ(Allah)র রসুল। এই বর্হিমুখী (Extrovert) এবং বিস্ফোরণমুখী (Explosive) চরিত্র তিনি (দঃ) সৃষ্টি কোরেছিলেন অবশ্যই স্বয়ং আল্লাহ(Allah)র নির্দেশেই এতে তো আর সন্দেহের কারণ থাকতে পারে না। সাধারণ জ্ঞানেও বোঝা যায় যে, যে নবীর (দঃ) ওপর আল্লাহ(Allah)র দায়িত্ব দিলেন এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে, এই শেষ সংবিধানকে সমস্ত মানব জাতির ওপর প্রতিষ্ঠা করার এবং যে দায়িত্ব নবীর পর তার উম্মাহর ওপর বর্তিলো সে উম্মাহর চরিত্র, দৃষ্টিভঙ্গী, আকীদা অবশ্যই বহির্মুখী হোতে হবে, নইলে ঐ কাজের একবিন্দু অগ্রগতি হবে না। কোনভাবে যদি এই জাতিকে তার চরিত্র বদলিয়ে অন্তর্মুখী করা যায় তবে ঐ জাতি শেষ হোয়ে গেলো। এ সম্বন্ধে এখানে একটা হাদীস পেশ কোরছি। একবার মহানবী (দঃ) সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে জেহাদে যাচ্ছিলেন। পথে এমন একটা স্থানে বিশ্রামের জন্য যাত্রা বিরতি কোরলেন যে জায়গাটা নির্জন, ছায়া ঘেরা এবং একটি পানির ঝরনা আছে। একজন সাহাবা বোললেন- আহ্! আমি যদি এই সুন্দর নির্জন জায়গাটায় একা থেকে যেতে পারতাম। অবশ্যই তিনি ওখানে থেকে আল্লাহ(Allah)র এবাদতের কথা বোঝালেন, কারণ এ নির্জনে বোসে তো আর ঘর-সংসার বা ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বোঝাননি। আল্লাহ(Allah)র রসুল (দঃ) ঐ কথা শুনে বোললেন- আমি ইহুদী বা খ্রীস্টান ধর্ম নিয়ে আসিনি, আমাদের এ পথ নয়। যার হাতে মোহাম্মদের জীবন তার কসম, আল্লাহ(Allah)র রাস্থায় যুদ্ধের জন্য শুধু সকাল বা বিকাল বেলার (একবেলা) পথ চলা সমস্ত পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার চেয়ে এবং ৬০ বছরের নামাযের চেয়ে বেশী[হাদীস- আবু ওমামা (রাঃ) থেকে -আহমদ, মেশকাত]। তার কথার অর্থ হলো পূর্ববর্তী নবীরা তাদের যার যার জাতিও সমাজের মধ্যে আল্লাহ(Allah)র দ্বীন প্রতিষ্ঠা কোরতে প্রেরিত হোয়েছিলেন। তাদের স্থান ও পরিধি ছিলো সীমিত, ছোট। কিন্তু শেষ নবী (দঃ) প্রেরিত হোয়েছেন বিশাল পৃথিবীতে আল্লাহ(Allah)র দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কোরতে, তার নিজের এবং তার উম্মাহর কোন অবকাশ, কোন উপায়ই নেই তাদের নিজেদের কোথাও সীমিত, অবরুদ্ধ কোরে ফেলতে। তাদের কার্যক্ষেত্র এই বিশাল পৃথিবী এবং সংগ্রাম অন্য নবীদের এবং তাদের উম্মাহর তুলনায় বহু গুণ বৃহত্তর ও কঠিন। তাই এই শেষ উম্মাহকে কোথাও কোন বন্ধনে সীমিত কোরলে তা হবে এই উম্মাহকে হত্যা কোরে ফেলার মত। তাই বিশ্বনবী (দঃ) তার সাহাবার কথা শুনে তার প্রতিবাদ কোরে তার দৃষ্টিভঙ্গীর, আকীদার সংশোধন কোরে দিলেন।

মহা পণ্ডিতরা, ফকিহ, মুফাসসিররা আল্লাহ(Allah) ও রসুলের (দঃ) সাবধান বাণী অগ্রাহ্য কোরে চুলচেরা বিশ্লেষণ কোরে এ জাতিকে তো আগেই দ্বীনুল-কাইয়্যেমা, সেরাতুল মুস্তাকীম, সহজ-সরল দ্বীন থেকে বিচ্যুত কোরে, বহু মযহাব ও ফেরকায় বিভক্ত কোরে এর ঐক্য ও শক্তি ভেঙ্গেচুরে দিয়েছিলেন, এবার সুফীরা এসে এর দিকনির্দেশনাই একেবারে উল্টো দিকে কোরে দিলেন। যে উম্মাহকে আল্লাহ(Allah)র রসুল (দঃ) হাতে তলোয়ার ধরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে পৃথিবীতে বের কোরে দিয়েছিলেন সুফীরা সে উম্মাহর হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নিয়ে হাতে তসবিহ ধরিয়ে দিয়ে পেছন টেনে ঘরে, খানকায় বসিয়ে দিলেন। লক্ষ শত্রু বিশ্বনবীর (দঃ) জীবনের ব্রতকে যে ক্ষতি কোরতে পারেনি পণ্ডিত ও ভারাসাম্যহীন সুফীরা তার চেয়ে বহুগুণ বেশী ক্ষতি কোরলেন। মহানবী (দঃ) তার উম্মাহকে যেদিকে চালনা কোরলেন সুফীরা চালনা করলেন তার উল্টো দিকে। মহানবী (দঃ) চালনা কোরে ছিলেন বাইরের দিকে সুফীরা, দরবেশরা চালনা কোরলেন ভেতরের দিকে। রসুলুল্লাহ (দঃ) এ জাতিকে চালনা কোরেছিলেন অন্যায়ের, অবিচারের আর অশান্তির সঙ্গে সংঘর্ষের দিকে, এরা চালনা কোরলেন অন্যায়ের (যুলম) কাছে আত্মসমর্পণের দিকে, পালানোর দিক। এই জাতির পণ্ডিতদের আলেমদের কাজের ফলে জাতি ঐক্যহীন, খণ্ড-বিখণ্ড একটি শক্তিহীন পদার্থে পরিণত হলো, তারপর সুফীরা এসে একে এর চলার দিক পরিবর্তন কোরে উল্টো দিকে পরিচালিত কোরলেন। এর পর এ জাতির আর রইলো কি? কিছুই না। এই কথাই বিশ্বনবী (দঃ) বলেছেন- আমার উম্মাহর আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছর। ইতিহাস দেখুন, যখন রসুল (দঃ) ঐ কথা বোলেছিলেন তার মোটামুটি ৬০/৭০ বছর পরই এই উম্মাহ পৃথিবীতে এই দ্বীন প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম জাতি হিসাবে ছেড়ে দেয়। ঐ সময়েই জাতি হিসাবে উম্মতে মোহাম্মদীর মৃত্যু হয়, মহানবীর (দঃ) ভবিষ্যতবাণী সঠিক হয়।

এই খানে মনে আসে রসুলুল্লাহর (দঃ) আরেকটি হাদীস। একদিন তিনি সাহাবাদের সামনে একটি সোজা লাইন টানলেন (বোধহয় মাটির ওপর), তারপর বোললেন- এই হোচ্ছে আল্লাহ(Allah)র রাস্থা সেরাতুল মুস্তাকীম। এরপর তিনি ঐ সোজা লাইন থেকে ডানদিকে কতকগুলি ও বা দিকে কতকগুলি লাইন রেখা টেনে বোললেন- এইগুলি ঐ রাস্থাগুলি যে রাস্থায় যাবার জন্য শয়তান ডাকতে থাকবে। এই বোলে তিনি (দঃ) কোরান থেকে পড়লেন- নিশ্চয়ই এই হোচ্ছে আমার সহজ, সরল পথ (সেরাতুল মুস্তাকীম)। এই পথে চল, অন্যান্য পথে চলো না। কারণ ঐ সব পথ তোমাদেরকে আল্লাহ(Allah)র ঐ পথ থেকে বিচু্যত কোরে দেবে [হাদীস- আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ (রাঃ) থেকে আহমদ, নিসায়ী, মেশকাত]। আল্লাহ(Allah)র রসুলের (দঃ) এ উপদেশ ও সতর্কবাণীকেও আমাদের মহাপণ্ডিতরা আর সুফী দরবেশরা উপেক্ষা কোরেই ঐ সেরাতুল মুস্তাকীম থেকে জাতিকে দুই দিকে টেনে নিলেন। তারা দেখলেন না আল্লাহ(Allah) কতবার তার কোরানে এই সেরাতুল মুস্তাকীমকে, দ্বীনুল কাইয়্যেমাকে উল্লেখ করেছেন এবং কোন জটিলতায় না যেয়ে এই সহজ সরল রাস্থায় আমাদের রাখার জন্য আল্লাহ(Allah)র কাছে প্রার্থণাকে বাধ্যতামূলক কোরে দিয়েছেন, শুধু প্রতি ওয়াক্তে নয় একেবারে প্রতি রাকাতে। এই সেরাতুল মুস্তাকীম, সহজ সরলতাকে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা কোরলে আল্লাহ(Allah) একে প্রতি রাকাতে পড়া ফরজ কোরে দিতে পারেন। আর সত্যই এই সরলতা এতই গুরুত্বপূর্ণ এত প্রয়োজনীয়। এই সহজ সরলতাকে, সেরাতুল মুস্তাকীমকে পণ্ডিতরা এবং সুফীরা ত্যাগ কোরে জটিলতার পথ ধরার ফলে বিশ্বনবীর (দঃ) উম্মাহ একটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন অন্তমুর্খী স্থবির জাতিতে পরিণত হলো। তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের সংগ্রাম করার শক্তি আর তাদের অবশিষ্ট রোইলো না।

এখানে প্রশ্ন আসে এখানেই কি তবে এই উম্মাহর শেষ? না তা নয়। মহানবীর (দঃ) ভাবিষ্যতবাণী মোতাবেক তার উম্মাহর ৬০/৭০ বছর পর মৃত্যু ঠিকই তবে সে মৃত্যু জাতি হিসাবে। ব্যক্তিগত ও ছোট দল হিসাবে অনেক লোক সেরাতুল মুস্তাকীম, দ্বীনুল কাইয়্যেমাকে এবং এই জাতির প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলে গেলেন না। কিন্তু তারা অনেকটা অসহায় হোয়ে পড়লেন এই জন্য যে, বৃহত্তর জাতি ও সরকারী শক্তি জাতির উদ্দেশ্য ভুলে গেছে। এই ছোট ছোট দলগুলি সম্বন্ধেই শেষনবী (দঃ) বোলে গেছেন- আমার উম্মাহর মধ্যে চিরদিন একদল লোক থাকবে যারা সর্বদা আল্লাহ(Allah)র হুকুম ইত্যাদিকে বলবৎ রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে [হাদীস- মুয়াবিয়া (রাঃ) থেকে বোখারী ও মুসলিম(Muslim)]। বৃহত্তর উম্মাহ জাতি হিসাবে উম্মতে মোহাম্মদী রইলো না কিন্তু এরা দলগতভাবে ও ব্যক্তিগত ভাবে মহানবীর (দঃ) প্রকৃত অনুসারী রোইলেন। আটলান্টিকের তীর থেকে চীনের সীমান্ত পর্য্যন্ত শেষ জীবন ব্যবস্থা বিস্থারের পর যখন উদ্দেশ্য নষ্ট ও আকীদা বিকৃতির জন্য এর গতি রুদ্ধ হোয়ে গেল, তারপর এর যে বিস্থারটুকু হোয়েছে তা হোয়েছে ঐ দলগত উম্মতে মোহাম্মদীদের দিয়ে। যখন এরা দেখলেন যে, জাতি তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হোয়ে গেছে, এর নেতারা এখন রাজত্ব করাকেই উদ্দেশ্য মনে কোরছে, এর পণ্ডিতরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করা নিয়ে অতি ব্যস্থ হোয়ে পড়েছেন এর সুফীরা খানকায় বোসে আল্লাহ(Allah)কে অত্যন্ত যিকর কোরছেন কিন্তু মোহাম্মদ (দঃ) ওপর আল্লাহ(Allah)র দেয়া দায়িত্বকে সম্মুখে নিয়ে যাবার কেউ নেই তখন তারা আল্লাহ(Allah)র নাম নিয়ে ছোট ছোট দলেই বের হোয়ে পড়লেন পৃথিবীতে শেষ জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা কোরে শান্তি স্থাপন করার জেহাদে। পরবর্তীতে ইসলামের যে বিস্থার আফ্রিকায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এবং চীনের মুল ভূখণ্ডে হোয়েছে তা হোয়েছে ঐ ছোট ছোট উম্মতে মোহাম্মদীর দলের জেহাদের কারণে। বিশ্বনবী (দঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদার সময়ের প্রকৃত উম্মতে মোহম্মদীর মতই এরা প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার কার্যকরী করেন। কিন্তু পরে এদের সুফী বোলে প্রচার চালানো হয় এবং ইসলামের প্রকৃত রূপ দৃষ্টি থেকে বিলুপ্ত হওয়ায় ঐ প্রচারের ফলে এই জাতি ঐ দুঃসাহসী যোদ্ধাদের সুফী বলেই গ্রহণ করে নেয়, এবং আজও তাদের খানকাবাসী সুফী বোলেই বিশ্বাস করে। এদের জীবনী লেখকরা বহু সত্য, আধা সত্য, আধা মিথ্যা ঘটনা তাদের জীবনীগুলোতে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের মহাসুফী বোলে চিত্রিত কোরতে চেষ্টা কোরেছেন এবং সফলও হোয়েছেন। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায় যে তাদের প্রায় প্রত্যেকজনই ছিলেন মরদে মুজাহিদ। প্রত্যেকে সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়াগায় এই শেষ জীবন ব্যবস্থার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা কোরেছেন। খুব কম স্থানেই সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া এই দ্বীন কায়েম হোতে পেরেছে। জাতি হিসাবে উদ্দেশ্য ভুলে যাবার পর সংগ্রাম ছেড়ে দেয়ার পর ব্যক্তিগত ও দলগত ভাবে যারা উম্মতে মোহাম্মদী রইলেন তাদেরই কোরবাণী ও সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে পরবর্তীতে এই দ্বীন পৃথিবীতে আরও বিস্তৃত হোয়েছে। এরা তখন দুনিয়া ত্যাগ কোরে ইসলামের সন্ন্যাস গ্রহণ কোরে ঘরবাড়ী সম্পত্তি সব কিছু ছেড়ে দলবেধে সশস্ত্র সংগ্রামে বের হোয়ে না পড়লে আজ ইসলাম(Islam) ঐ প্রাথমিক পর্য্যায়ে অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে এবং উত্তর আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো, দক্ষিণ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও চীনে বিস্থার লাভ করতো না। বিশ্বনবীর (দঃ) সময়ের প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর মত এরাও ছিলেন প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী অর্থাৎ দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা। অথচ এদের প্রকৃত রং বদলিয়ে এদের সুফী বোলে চিত্রিত করা হোয়েছে নিজেদের সঠিক বোলে প্রমাণ করার জন্য। আসলে এরা সুফীদের ঠিক উলটো। এরা নিজেদের সব কিছু ছেড়ে এই দ্বীনুল কাইয়্যেমাকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জেহাদে অজানা পৃথিবীতে বের হোয়ে পড়েছিলেন আর সুফীদের কাজ হোচ্ছে তসবিহ হাতে খানকায় বোসে তপস্যা করা।

অর্দ্ধেক পৃথিবীতে শেষ জীবন ব্যবস্থা, শেষ ইসলাম(Islam) যে প্রতিষ্ঠিত হোয়েছিলো তা মুজাহিদদের শাহাদাতের বিনিময়ে নয়, সুফীদের প্রচারের ফলে- এ মিথ্যা ও অবিশ্রান্ত প্রচারের ফলে মানুষের মধ্যে সত্য বোলে গৃহীত হোয়ে গেছে। এই কথা প্রমাণ করার জন্য বহু বই লেখা হোয়ে গেছে বিভিন্ন ভাষায়। যারা ঐ সব বই লিখেছেন আর যারা তা পড়ে বিশ্বাস কোরেছেন, উভয়ই প্রকৃত ইসলামের আকীদা থেকে বহু দূরে। এই দ্বীনের যে মর্মবাণী জেহাদ, কিতাল, এ সত্যকে ধামাচাপা দেবার চেষ্টা আরম্ভ হোয়েছে রসুলাল্লাহর (দঃ) সময়ের ৬০/৭০ বছর পর থেকেই। ঐ মহাপাপের শাস্থি হিসাবে প্রথমে এসেছে অনৈক্য, তারপর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, রক্তারক্তি, তারপর এসেছে ইউরোপের খ্রীস্টান জাতিগুলির ঘৃণ্য গোলামী, দাসত্ব এবং স্পেন থেকে একেবারে দৈহিকভাবে নির্মূল হোয়ে যাওয়া। ঐ ধামাচাপার প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হওয়ার ফলেই ইসলামের পৃথিবীময় বিস্থারকে মুজাহিদদের সশস্ত্র সংগ্রামের ফলের বদলে সুফীদের প্রচারের ফল হিসাবে যেমন লেখাও হোয়েছে তেমনি তা বিশ্বাসও করা হোয়েছে এবং এখন এই মিথ্যা সর্বত্র গৃহীত। এ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখতে গেলে আলাদা বই-ই হোয়ে যাবে, কাজেই শুধু কয়েকটি বুনিয়াদী সত্য লেখা ছাড়া উপায় নেই।

সমস্ত পৃথিবীর খবর আমার জানা নেই, কাজেই পৃথিবীর যে অংশে আমি বাস করি শুধু সেইটুকুর কথাই বোলছি। এই দেশে শেষ ইসলাম(Islam) প্রতিষ্ঠিত হোয়েছে বখতিয়ার খিলজীর তলোয়ারের শক্তিতে। উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশে হোয়েছে শাহজালালের (রঃ) তলোয়ারে, যে তলোয়ার আজ উপেক্ষিত হোয়ে পড়ে আছে। দক্ষিণ বাংলায় হোয়েছে খান জাহান আলীর (রঃ) তলোয়ারে। উত্তর বাংলায় হোয়েছে সুলতান মাহমুদ শাহী সওয়ারের (রঃ) তলোয়ারের শক্তিতে, পশ্চিম বাংলায় হোয়েছে শাহ সফী উদ্দিন (রঃ), শাহ সুলায়মান(রঃ), সৈয়দ দেওয়ান চন্দন শহীদ (রঃ) ইত্যাদি অনেক মুজাহিদদের তলোয়ারের জোরে। অবশ্য আমার এ কথার অর্থ এই নয় যে, শুধু মুজাহিদদের সশস্ত্র সংগ্রামের ফলেই এদেশে আজ মুসলিম(Muslim) সংখ্যাগরিষ্ট। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী এই দেশ অস্ত্রের বলে জয় করার আগেও আরব ও অন্যান্য মুসলিম(Muslim)রা ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষে এ দেশের বন্দরগুলিতে এসে স্থানীয় লোকজনের সংস্পর্শে আসেন। তখনকার ঐ মুসলিম(Muslim) ব্যবসায়ী ও বণিক মুসলিম(Muslim)রা এখনকার মত মৃত মুসলিম(Muslim) ছিলেন না। তারা যেখানেই যেতেন সেখানেই তারা তাদের জীবন বিধান দ্বীন প্রচারের চেষ্টা কোরতেন। তাদের সে চেষ্টা যে সম্পূর্ণ বিফল হোয়েছে তা আমি বলি না। নিশ্চয়ই মানুষের মধ্যে সব সময়ই এমন মন থাকে যা সত্য গ্রহণ করে। এবং অনেক মানুষই নিশ্চয় তাদের হাতে মুসলিম(Muslim) হোয়েছিলেন। কিন্তু বুনিয়াদী সত্য হলো এই যে, প্রধান কারণ হলো মুজাহিদদের সশস্ত্র সংগ্রাম। এই দেশে মুসলিম(Muslim)রা যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেজন্য যাদের অবদান সর্বশ্রেষ্ঠ, যাদের কয়েকটি মাত্র নাম উল্লেখ কোরলাম তাদের জীবনী পড়লে দেখা যে যায় সশস্ত্র সংগ্রামেই তাদের জীবনের বেশীর ভাগ সময় কেটেছে। সিলেটের শাহ জালালের (রঃ) মত অনেকের হাতের তলোয়ার আজও রক্ষিত আছে। তারা যে আধ্যাত্মিক সাধকও ছিলেন না তা আমি বোলছিনা, তাদের আধ্যাত্মিক সাধনাও অবশ্যই ছিলো কারণ তাদের জীবন প্রকৃত মুসলিম(Muslim) ও উম্মতে মোহাম্মদীর মতই ভারসাম্যযুক্ত ছিলো। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের জীবনের সশস্ত্র সংগ্রামের ভাগটুকু ছেটে ফেলে তাদের কেরামতির ভাগটাকেই শুধু প্রধান নয় একমাত্র ভাগ বোলে প্রচার করা হোয়েছে। ঐ প্রচারের চেষ্টায় নানা অসত্য অর্দ্ধসত্য কল্পকাহিনী এমনকি সম্পূর্ণ মিথ্যাও তাদের পবিত্র জীবনীগুলোতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বনবীর(দঃ) প্রকৃত উম্মাহ, ইসলামের সন্ন্যাসী এই মহাযোদ্ধাদের খানকাবাসী সুফী প্রমাণের জন্য যে সমস্ত বই লেখা হোয়েছে তাদের মধ্য থেকে একটি বই নিন- গোলাম সাকলায়েনের লেখা- বাংলাদেশের সুফী সাধক। দেখুন, এই যোদ্ধাদের সুফী প্রমাণ করার জন্য লেখক লিখছেন- "ফলত বাংলাদেশে মুসলমান যে আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ তার মুলে দেশী ও বিদেশী বহু পীর দরবেশ ও সুফীসাধকদের সাধনা ও কর্ম তৎপরতাই প্রধাণত দায়ী। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে কোন কোন সময় কোন কোন ধর্মোন্মক্ত মুসলিম(Muslim) বাদশাহ বা শাসক ক্ষাত্রশক্তির সাহায্যে এদেশে ইসলাম(Islam) বিস্থারের চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফলকাম হয়নি। মুসলিম(Muslim) ক্ষাত্রশক্তি যেখানে পরাজিত ও বিধ্বস্থ হয়েছে দরবেশ ও সুফী সাধকদের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি সেখানে অত্যাশ্চার্যরূপে জয়লাভ করেছে (বাংলাদেশ সুফী-সাধক- গোলাম সাকলায়েন। পৃঃ ৮৭)।" এই কথা তিনি লিখলেন বইটার প্রথমদিকে-৮৭ পৃষ্ঠায়। তারপর বহু "সুফী-সাধক"দের বহু যুদ্ধ, বহু কোরবানী বহু শাহাদাত ও বহু গাজীত্বের বর্ণনার পর বইয়ের শেষ দিকে লিখছেন- "প্রকৃতপক্ষে তুর্কী শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশ বিজিত হওয়ার পর সুফী-সাধক এদেশের চিন্তা জগতে অভিনব ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূত্রপাত করে।" (২৫৫পৃঃ) অর্থাৎ গোলাম সাকলায়েন সাহেব প্রথমে ভুল কথা লিখে পরে নিজের অজান্তেই শেষ দিকে সত্য কথা লিখে ফেলেছেন। আরও প্রকৃত সত্য এই যে, প্রথম দিকে ইসলামের মুজাহিদদের সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে এই দেশে ইসলাম(Islam) প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ভারসাম্যহীন, অস্ত্রহীন, তসবীহধারী সুফীদের সময়ে দেশ ইংরাজের গোলামে পরিণত হয়। শুধু 'দরবেশের" সংখ্যাই যদি ধরা হয় তবে প্রথম দিকের ঐ যোদ্ধার দরবেশরা যখন এদেশে ইসলাম(Islam) প্রতিষ্ঠা করেন তখন তাদের যে সংখ্যা ছিলো, পরবর্তীতে যখন ইংরাজ এসে মুসলমানদের হাতে থেকে দেশ ছিনিয়ে নিলো, তখন "দরবেশ"দের সংখ্যা বহু বেশী। অর্থাৎ যোদ্ধারা ক্ষাত্রশক্তির বলে এদেশে ইসলাম(Islam) আনলেন আর দরবেশদের, সুফীদের আমলে ইংরাজরা এদেশ মুসলিম(Muslim)দের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ঐ সুফী দরবেশ সহ সমস্ত মুসলিম(Muslim) জাতিটাকে গোলাম বানিয়ে দিলো।

তাসাওয়াফ সম্বন্ধে শেষ কথা এই যে, মো'মেন মুসলিম(Muslim) ও উম্মতে মোহাম্মদীর সর্বশ্রেষ্ঠ যে দায়িত্ব, অর্থাৎ এই দ্বীনুল ইসলাম(Islam), দ্বীনুল কাইয়্যেমাকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরে ইবলিসের চ্যালঞ্জে আল্লাহ(Allah)কে জয়ী করার সংগ্রাম, জেহাদ করার পর যদি সময় থাকে তবে তাসাওয়াফের সাধনা করুন, কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ঐ সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব পালন না কোরে যদি শুধু সাধনাই কোরতে থাকেন তবে এই দুনিয়াতেই এই জাতির ওপর যে আযাব হোচ্ছে তার চেয়েও কঠিন আযাব এবং আখেরাতে আরও ভয়ংকর আযাবের অপেক্ষা করুন।

মহানবীর (দঃ) ভবিষ্যৎবাণী মোতাবেক ৬০/৭০ বছর পর উম্মতে মোহাম্মদীর মৃত্যু হলো, একথা বহু লোকই মানবেন না জানা কথা। বিশেষ কোরে যারা অতি মুসলিম(Muslim), যারা এই দ্বীনের মর্মবাণী থেকে বহুদূরে, এর মৃত কংকালটা যারা আঁকড়ে ধোরে আছেন তারা তর্ক দেবেন বিশ্বনবী (দঃ) নিজেই বহু হাদীসে আমাদের তার উম্মাহ বোলে বোলেছেন, এমনকি পথভ্রষ্ট হোলেও আমাদের তার উম্মাহ বোলে উল্লেখ কোরেছেন। ঠিক কথা। কিন্তু ঐসব হাদীসে তিনি তার প্রকৃত উম্মাহ বোঝাননি, বুঝিয়েছেন সাধারণভাবে-ইংরেজীতে যাকে বলা হয় In general sense অর্থাৎ অন্য থেকে পৃথক বোলে বোঝাবার জন্য। অর্থাৎ যেটাকে তিনি উল্লেখ কোরছেন সেটা খ্রীস্টান, ইহুদি জাতি নয়, মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মাদুর রাসুল্লাল্লাহ বলে এমনি একটা পৃথক জাতি- একথা বোঝাবার জন্য। প্রমাণ দিচ্ছি- মহানবী (দঃ) ভবিষ্যতবাণী কোরেছেন যে, ক্রমে ক্রমে ভবিষ্যতে তার জাতি বনী ইসরাইলীদের (এখানে তিনি বনি ইসরাইল বোলতে ইহুদী-খ্রীস্টান সভ্যতা(Civlization)কে বোঝাচ্ছেন) এমনভাবে অনুসরণ কোরবে যে তাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্যে তার মায়ের সাথে ব্যভিচার কোরলে, তার উম্মাহর মধ্য থেকেও কেউ তা কোরবে [হাদীস- আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে তিরমিযি, মেশকাত]। প্রশ্ন হোচ্ছে কেউ যদি মানসিকভাবে অন্য জাতির এতটা দাস হোয়ে যায় যে, হীনমন্যতায় সে ঐ পর্য্যায়ে যায় যে, তাদের নকল ও অনুকরণ কোরতে যেয়ে সে প্রকাশ্যে মায়ের সাথে ব্যাভিচার কোরতেও বিরত হয় না, তবে সেই লোককে বা জাতিকে উম্মতে মোহাম্মদী বলা যায়? নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু এখানেও বিশ্বনবী (দঃ) তার উম্মাহ বোলেই উল্লেখ কোরেছেন, কারণ এই জাতিটিকে অন্য জাতি থেকে পৃথক কোরে বোঝাবার জন্য In general sense, তিনি তার প্রকৃত উম্মাহ বোঝাননি।

মহানবীর (দঃ) ভবিষ্যবাণী মোতাবেক ৬০/৭০ বছর পর যখন উম্মতে মোহাম্মদীর জাতি হিসাবে মৃত্যু হোলো তখন কি রইলো? রইলো জাতি হিসাবে মুসলিম(Muslim)। মুসলিম(Muslim) শব্দের অর্থ হলো- যে বা যারা আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে তসলীম অর্থাৎ সসম্মানে গ্রহণ কোরে নিজেদের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা করে, অন্য কোন রকম জীবন বিধানকে স্বীকার করে না, সে বা তারা হলো মুসলিম(Muslim)। এই জাতি রসুলাল্লাহর (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ অর্থাৎ তার মাধ্যমে প্রেরিত দ্বীনকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দেবার ফলে জাতি হিসাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হোয়ে শুধু একটি মুসলিম(Muslim) জাতিতে পরিণত হলো। এ জাতির সংবিধান রইলো কোরান ও হাদীস, রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক সবরকম ব্যবস্থা শাসন ও দণ্ডবিধি (Penal code) সবই রইলো ঐ কোরান ও হাদীস মোতাবেক। ওর বাইরে অন্য কোন রকম রাজনৈতিক বা আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে তারা শেরক বা বহু ঈশ্বরবাদ মনে কোরতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য তারা হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাদের আকীদা বিকৃত হোয়ে গিয়েছিলো। কাজেই তারা ঐ বিশাল ভূখণ্ডের শাসক হোয়ে পৃথিবীর আর দশটা রাজ্যের মত রাজত্ব কোরতে লাগলেন। এই অবস্থায় কয়েক'শ বছর পার হোয়ে গেলো।

আমি এইখানে একটু থামবো। কারণ এই সময় থেকে নিয়ে কয়েকশ' বছর পর এই জাতির পতন ও ইউরোপের অন্যান্য জাতিগুলির কাছে যুদ্ধে হেরে যেয়ে তাদের গোলামে পরিণত হওয়া পর্য্যন্ত কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিন্তা করার আছে। উদ্দেশ্য ভুলে যেয়ে পৃথিবীতে এই দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যখন এই জাতি বন্ধ করলো, ঠিক তখনকার পরিস্থিতি এই রকম।

ক) পৃথিবীর দুইটি বিশ্ব শক্তিকে উম্মতে মোহাম্মদী সশস্ত্র সংগ্রামে পরাজিত কোরেছে।

খ) একটি (পারস্য) এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে স্বীকার ও গ্রহণ কোরে এই জাতির অন্তর্ভূক্ত হোয়ে গেছে ও অন্যটি (পূর্ব রোমান অর্থাৎ বাইজেনটাইন) তার সাম্রাজ্যের বেশীর ভাগ হারিয়ে শক্তিহীন ও দুর্বল হোয়ে গেছে। খ্রীস্টান শক্তি বোলতে তখন ইউরোপের ছোট ছোট কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছু নেই।

গ) উম্মতে মোহাম্মদী যদি তখন তাদের উদ্দেশ্য ভুলে না যেতো তবে পৃথিবীময় এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠায় আর কোন বড় বাধা ছিলো না। থাকলেও তা ঐ দুই বিশ্বশক্তির মতই পরাজিত হতো। সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত হতো, আল্লাহ(Allah) তার শেষ রসুলকে (দঃ) যে দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন' (কোরান- সূরা আল ফাতাহ ২৮। আত তওবা ৩৩, আস্ সাফ ৯) তা পূর্ণ হতো, পৃথিবী থেকে অন্যায় অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত বন্ধ হোয়ে পূর্ণ শান্তিতে মানব জাতি বাস কোরতে পারতো, মালায়েকদের আশংকা মিথ্যা হতো, ইবলিসের মাথা নত হোয়ে যেতো, বিশ্বনবীকে আল্লাহ(Allah)র দেয়া রহমাতুল্লীল আলামীন উপাধির অর্থ পূর্ণ হতো।

ঘ) এই সংগ্রাম যখন আরম্ভ হোয়েছিলো তখন উম্মতে মোহাম্মদীর মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখেরও কম। কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, পৃথিবীর দরিদ্রতম জাতিগুলির অন্যতম, যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র নিম্নতম প্রয়োজনের চেয়েও কম। আর প্রতিপক্ষ তদানিন্তন পৃথিবীর দুই মহাশক্তি, জনসংখ্যায়, সম্পদে সুশিক্ষিত সৈন্যের সংখ্যায় অস্ত্র ও সরঞ্জামে এক কথায় কোনদিক দিয়েই তুলনা চলে না। আর ৬০/৭০ বছর পর যখন এ সংগ্রাম বন্ধ করা হলো তখন পরিস্থিতি ঠিক উলটো। এই নিঃস্ব জাতি আটলান্টিকের তীর থেকে চীনের সীমান্ত আর উত্তরে উরাল পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের তীর পর্য্যন্ত বিশাল এলাকার শাসনকর্তা। তখন আর নিঃস্ব নয়, তখন সম্পদে, সামরিক শক্তিতে জনবলে প্রচণ্ড শক্তিধর পৃথিবীর কোন শক্তির সাহস নেই এই জাতির মোকাবেলা করার। অর্থাৎ প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী যারা নিঃসংশয়ে জানতেন তাদের নেতার (দঃ) জীবনের উদ্দেশ্য কী ছিলো এবং তাদের নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী তারা ডাইনে বামে কোনও দিকে না চেয়ে একাগ্র লক্ষ্যে (হানিফ) সেই উদ্দেশ্য অর্জনে পার্থিব সব কিছু কোরবান কোরে পৃথিবীতে বের হোয়ে পড়ে ছিলেন। আল্লাহ(Allah) তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তাদের সঙ্গে ছিলেন। আর স্বয়ং আল্লাহ(Allah) যাদের সাথে তারা কেমন কোরে বিফল হবে, কেমন করে পরাজিত হবে? তাই মানব ইতিহাসে দেখি এক অবিশ্বাস্য অধ্যায়। অজ্ঞাত ছোট্ট একটি নিঃস্ব জাতি অল্প সময়ের (৬০/৭০ বছর) মধ্যে মহাপরাক্রমশালী দুইটি বিশ্ব শক্তিকে পরাজিত কোরে প্রায় অর্দ্ধেক পৃথিবীতে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করলো। উম্মাহর ওপর দায়িত্ব দেয়া কাজের এই পর্য্যন্ত অগ্রগতি হওয়ার পর দুর্ভাগ্যক্রমে এই উম্মাহ তার আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভুলে গেলো, এর আকীদা নষ্ট হোয়ে গেলো, পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠার বদলে তাদের আকীদা হয়ে গেলো রাজত্ব করা, অন্য দশটা সাম্রাজ্যের মত। এই উম্মাহকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হোয়েছিলো সে কাজ ত্যাগ কোরে সে অন্য পথ ধরলো।

কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ত্যাগ কোরলেও যেহেতু তারা এই শেষ জীবন ব্যবস্থা, দ্বীনের ওপরই মোটামুটি কায়েম রোইলো তাই এর সুফলও তারা লাভ করলো। কোরানের ও হাদীসের নির্দেশ মোতাবেক শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার ফলে জাতি আইন শৃংখলা ও সম্পদ বিতরণে অপূর্ব সাফল্য লাভ করলো, আল্লাহ(Allah) ও রসুলের (দঃ) জ্ঞান আহরণের আদেশ উৎসাহ ভরে পালন কোরে অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে উপবিষ্ঠ হলো। যে সময়টার (Period) কথা আমি বোলছি অর্থাৎ জাতি হিসাবে সংগ্রাম ত্যাগ কোরে উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে পতিত হওয়া থেকে কয়েকশ' বছর পর ইউরোপের বিভিন্ন জাতির পদানত ও গোলামে পরিণত হওয়া পর্য্যন্ত এই যে সময়টা এই সময়টা পার্থিব হিসাবে অর্থাৎ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ইত্যাদিতে এক কথায় উন্নতি ও প্রগতি বোলতে যা বোঝায় তাতে এই জাতি পৃথিবীর সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হোয়ে রোইলো। শেষ নবীর(দঃ) মাধ্যমে শেষ জীবন ব্যবস্থা মোটামুটি নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করার অনিবার্য ফল হিসাবে এই জাতি এমন এক পর্য্যায়ে উন্নীত হলো যে, তদানিন্তন বিশ্ব সভায়ে ও সসম্ভ্রমে এই জাতির সামনে নতজানু হোয়ে পড়েছিলো। এই সময়ে এই জাতির সাফল্য, কীর্তি, বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন, গবেষণা, পৃথিবীর অজানা স্থানে অভিযান ইত্যাদি প্রতি বিষয়ে যে সাফল্য লাভ কোরেছিলো তার বিবরণ এখানে দেওয়ার স্থান নেই এবং প্রয়োজনও নেই। এ ব্যাপারে বহু বই কেতাব লেখা হয়ে গেছে। এই সময় (Period) টাকেই বলা হয় ইসলামের স্বর্ণ যুগ।

কিন্তু এত কিছুতেও কোন লাভ নেই- কারণ আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হোলে বাকি আর যা কিছু থাকে সবই অর্থহীন। এ সত্য রসুলাল্লাহর (দঃ) ঘনিষ্ঠ সহচর এই জাতির প্রথম খলিফা আবু বকর (রাঃ) জানতেন। তাই খলিফা নির্বাচিত হয়ে তার প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্বোধন কোরে বলেছিলেন- হে মুসলিম(Muslim) জাতি! তোমরা কখনই সংগ্রাম (জেহাদ) ত্যাগ কোরোনা। যে জাতি জেহাদ ত্যাগ করে আল্লাহ(Allah) সে জাতিকে অপদস্থ, অপমানিত না কোরে ছাড়েন না। আবু বকর (রাঃ) এ কথা তার প্রথম বক্তৃতাতেই কেন বোলেছিলেন? তিনি বিশ্বনবীর (দঃ) ঘনিষ্ঠতম সাহাবাদের একজন হিসাবে এই দ্বীনের প্রকৃত মর্মবাণী হকিকত তার নেতার কাছ থেকে জেনেছিলেন। বিশ্বনবীর কাছ থেকে জানা ছাড়াও আবু বকর (রাঃ) আল্লাহ(Allah)র দেয়া সতর্কবাণীও কোরানে নিশ্চয়ই পড়েছিলেন যেখানে আল্লাহ(Allah) এই মোমেন জাতি ও উম্মতে মোহাম্মদীকে লক্ষ্য কোরে বোলছেন- যদি তোমরা (জেহাদের) অভিযানে বের না হও তবে তোমাদের কঠিন শাস্থি (আযাব) দেবো এবং তোমাদের বদলে (তোমাদের পরিত্যাগ কোরে) অন্য জাতিকে মনোনীত করবো(কোরান- সূরা আত তওবা ৩৮) এই জাতি যে একদিন তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হোয়ে যাবে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দেবে ফলে আল্লাহ(Allah)র গযবে পতিত হবে তাও বোধহয় তিনি তার প্রিয় নেতার (দঃ) কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন। তাই খলিফার দায়িত্ব হাতে নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম সেই সম্বন্ধেই জাতিকে সতর্ক কোরে দিলেন। শুধু আবু বকর (রাঃ) নয়, তারপর ওমর (রাঃ), ওসমান (রাঃ) এবং আলী (রাঃ)ও যে ঐ মর্মবাণী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন তার প্রমাণ এই যে, তাদের সময়েও এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম নিরবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়া হোয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদা তো নয়ই এমনকি মহানবীর (দঃ) একজন মাত্র সাহাবাও কোনদিন এই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরতির জন্য একটিমাত্র কথা বোলেছেন বোলে ইতিহাসে প্রমাণ নেই। বরং প্রতিটি সাহাবা তাদের পার্থিব সব কিছু কোরবান করে স্ত্রী পুত্রকে আল্লাহ(Allah)র হাতে সপে দিয়ে বছরের পর বছর আরব থেকে বহু দূরে অজানা অচেনা দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আবু বকরের (রাঃ) মত তারাও জানতেন যে, এই সংগ্রাম বিশ্বনবীর (দঃ) ওপর আল্লাহ(Allah)র অর্পিত দায়িত্ব, যা তার উম্মাহ হিসাবে তাদের ওপর এসে পড়েছে। তারা জানতেন এ সংগ্রাম ত্যাগ করার অর্থ উম্মতে মোহাম্মদীর গণ্ডি থেকে তাদের বহিষ্কার, আল্লাহ(Allah)র রোষানলে পতিত হওয়া ও পরিণামে আল্লাহ(Allah)র শত্রুদের হাতে পরাজিত, অপমান, অপছন্দ ও লাঞ্ছনা, যা আবু বকর (রাঃ) বলেছিলেন।

যে সময়টার (Period) কথা এখানে আলোচনা করছি- সংগ্রাম থামিয়ে দেওয়া থেকে ইউরোপীয় শক্তিগুলির দাসে পরিণত হওয়া পর্য্যন্ত কয়েকশ' বছর- একেই বলা হয় ইসলামের স্বর্ণ যুগ, কারণ একটু আগে বোলে এসেছি। এলাকায়, জনসংখ্যায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক, শক্তিতে, শিক্ষায়, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে এক কথায় সর্বতোভাবে এই জাতি এই সময়টায় পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। এই বিস্ময়কর উন্নতি এই জাতি কোরতে পেরেছিলো, তার কারণ মুল বিষয়ে ব্যর্থ হোলেও মোটামুটিভাবে এই জাতির সংবিধান ছিলো কোরান ও সুন্নাহ। অন্য কোন রকম জীবন বিধানকে স্বীকার কোরে না নিয়ে কোরান ও সুন্নাহ মোতাবেক জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবন ও দণ্ডবিধি পরিচালনা করার দরুণ এই সময়কালের এই জাতিটাকে মুসলিম(Muslim) বলা যায়। কিন্তু বিশ্বনবীর (দঃ) আরদ্ধ কাজ ত্যাগ করার দরুন এখন আর একে জাতি হিসাবে উম্মতে মোহাম্মদী বলা যায় না। এই কয়েকশ' বছরের মধ্যে ক্রমে ক্রমে এই 'মুসলিম(Muslim)' জাতির মধ্যে যে পরিবর্তনগুলি এলো তা গভীরভাবে লক্ষ্য করা প্রয়োজন।

ক) ফকীহ মুফাস্‌সির, পণ্ডিতদের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে ক্রমে ক্রমে জাতি নানা মাযহাবে ও ফেরকায় বিভক্ত হোয়ে যেয়ে এর ঐক্য সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হোয়ে গেলো, শক্তি শেষ হেয়ে গেলো।

খ) সুফীদের অনুপ্রবেশ ও প্রভাবে জাতি মানসিকভাবে নির্জীব হোয়ে গেলো।

গ) ঐ দুইটির সম্মিলিত প্রভাবে উম্মাহর বহির্মুখী (Extrovert) ও বিস্ফোরণমুখী (Explosive) চরিত্র অন্তর্মুখী (Introvert) ও অনড় (Inert) হোয়ে গেলো। জাতি স্থবির, মৃত হোয়ে গেলো। যার গতি নেই তাই মৃত।

ঘ) এই মৃত অবস্থায় জাতির পচনক্রিয়া (Decomposition) চলতে লাগলো।

এই পচনক্রিয়া যে কয়েকশ' বছর ধরে চললো এই সময়টায় কিন্তু এই উম্মাহর শত্রুরা বোসে ছিলো না। তারা ক্রমাগত চেষ্টা কোরে চলছিলো এই জাতিকে ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু এই উম্মাহর জনক মহানবী (দঃ) এর মধ্যে যে বিপুল পরিমাণ সামরিক গুণ ও চরিত্র সৃষ্টি কোরে দিয়েছিলেন তার প্রভাবে ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি কোন বড় রকমের বিজয় লাভ কোরতে পারেনি। কিন্তু ফকীহ, মুফাস্‌সির ও সুফীদের প্রভাবে উম্মাহর আকীদা বিকৃত হোয়ে যাবার ফলে পচনক্রিয়া আরও যখন ভয়াবহ হোয়ে উঠলো তখন আর এই জাতির শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তি রোইলনা। মনে রাখতে হবে, সমস্ত ফকীহ, মুফাস্সির ও পীর দরবেশদের আবির্ভাব হয় এই সময়কালেই (Period)। এদের মতবাদের বিষ কেমন কোরে এই উম্মাহকে ইউরোপী খ্রীস্টানদের ক্রীতদাসে পরিণত কোরেছে তার একটি মাত্র উদারহণই বোধহয় উন্মুক্ত মনের মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে।

শেষ জীবন ব্যবস্থাকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে অর্থাৎ রাসুলাল্লাহর (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ কোরে এই দ্বীনের মাসলা-মাসায়েলের সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে, নানা মাযহাব ফেরকা সৃষ্টি কোরে এই জাতিটাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার কাজে যখন পণ্ডিতরা ব্যস্থ, শাসকরা যখন মহা জাকজমক, শান-শওকতের সঙ্গে রাজত্ব করায় ব্যস্থ তখনও এই জাতির সমস্ত মানুষ মরে যায়নি। মহানবী (দঃ) তার শিক্ষায় যে সামরিক প্রেরণা উম্মাহর বুকে প্রোথিত কোরে দিয়েছিলেন, যা বটগাছের শেকড়ের মত স্থান কারে নিয়েছিলো, তা তখনও সম্পূর্ণ মরে যায়নি। কিন্তু ঐ সামরিক প্রেরণা তখন পরিবর্তন হোয়ে আত্মরক্ষামূলক (Defensive) হোয়ে গেছে। এই জাতির সীমান্ত তখন উত্তরে আটলান্টিকের তীর থেকে ভূমধ্য সাগরের তীর ধরে উরাল পর্বত মালা পর্য্যন্ত, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকার আটলান্টিকের তীর, পূর্বে পুর্ব ভারত। এর মধ্যে শত্রুর আক্রমণের আশংকা ছিলো শুধুমাত্র ইউরোপের দিক থেকে। কারণ অন্য দিকে গুলোয় এমন কোন শক্তি ছিলোনা যেটা এই জাতিকে আক্রমণ করার সাহস করে। এই উত্তর সীমান্তে আক্রমণ কোরতে হোলে শত্রুকে ভূমধ্যসাগর পার হোয়ে এপারে এসে নামতে হবে। এই উত্তর সীমান্তকে রক্ষা করার জন্য মুসলিম(Muslim) জাতি মরক্কো থেকে ভূমধ্য সাগরের উপকূল বরাবর পূর্বদিকে পারস্য পর্য্যন্ত অসংখ্য ছোটবড় দুর্গ তৈরী কোরেছিল। এ দুর্গগুলির নাম দেয়া হোয়েছিলো রিবাত। শব্দটি নেয়া হোয়েছিলো কোরানের সূরা আনফালের ৬০নং আয়াত থেকে যেখানে আল্লাহ(Allah) উম্মাতে মোহাম্মদীকে আদেশ কোরছেন শত্রুর মোকাবিলার জন্য তোমরা যথাসাধ্য সামরিক সরঞ্জাম, অশ্ববাহিনী ইত্যাদি একত্র কোরে সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক (কোরান- আল আনফাল ৬০)।এই প্রস্তুতির স্থানটাকে আল্লাহ(Allah) কোরানে রিবাত বোলেছেন- যার অর্থ হলো সামরিকভাবে একটি সুরক্ষিত স্থান। এই রিবাতগুলিতে একটি কোরে নিরীক্ষণ মঞ্চ (Watch tower) থাকতো। শত্রু আক্রমণ কোরলে তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে দুর্গের ভেতরে ও আশেপাশের স্থানীয় লোকদের সতর্ক কোরে দেওয়া ও নিজেরা শত্রুদের প্রতিরোধ করা ছিলো এই দুর্গ বা রিবাতগুলির উদ্দেশ্য। তখনকার দিনে এখনকার মতো পাশ্চাত্যের অনুকরণে আলাদা সামরিক বাহিনী (Standing Army) ছিলো না, গোটা জাতিটাই, উম্মাহটাই ছিলো একটা বাহিনী, প্রত্যেক মুসলিম(Muslim) একটি সৈন্য। তাই যেখানে যে রিবাত তৈরী করা হোয়েছিলো সেখানকার আশেপাশের লোকেরা দল বেঁধে পালাক্রমে ঐ রিবাতে বাস করতেন এবং শত্রুর আক্রমণ আসে কিনা তা লক্ষ্য করতেন। যে যতদিন সম্ভব ঐ দুর্গগুলিতে কাটাতে চেষ্টা কোরেছেন। এমনও দেখা গেছে কেউ কেউ বছরের পর বছর রিবাতে সামরিক জীবন যাপন কোরেছেন। রিবাত শব্দটি যেমন কোরান থেকে নেয়া হোয়েছিলো তেমনি মহানবীর (দঃ) বাণী, "একরাত সীমান্ত প্রহরা দেয়া হাজার বছর নফল এবাদতের সওয়াবের সমান [হাদীস- ওসমান (রাঃ) থেকে তিরমিযি, মেশকাত], এই মুজাহীদদের প্রেরণার কারণ ছিলো। এই রিবাতগুলির মধ্যে এরা প্রহরীর কাজ কোরতেন, কুচকাওয়াজ কোরতেন, অস্ত্র ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতেন। অবশ্যই সালাত, সওমও পালন কোরতেন ফরদ হিসাবে। তাছাড়া এ জাতির সালাত তো সামরিক কুচকাওয়াজেরই অন্য সংস্করণ। উত্তর আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরের উপকুল বরাবর এই বহুসংখ্যক রিবাতগুলির সতর্ক প্রহরা ও প্রতিরোধের মুখে খ্রীস্টান শত্রু বহুবার আক্রমণ কোরেও মুসলিম(Muslim)দের কাবু কোরতে পারেনি, পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছে। ইসলামের প্রথম অর্থাৎ গতিশীল (Dynamic) যুগ (মহানবীর (দঃ) কথিত ৬০/৭০ বছর) শেষ হোয়ে যাবার পর থেকে খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীরও পর পর্য্যন্ত এই কয়েকশ' বছর সীমান্ত রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ এই মুজাহিদরা অস্ত্র হাতে এই পতনোম্মুখ ও পচনশীল জাতিকে রক্ষা কোরেছেন।

একদিকে ঐ মুজাহিদরা কোরান ও সুন্নাহর আদর্শে অনুপ্রাণিত হোয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে জাতিকে রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন সীমান্তে, অপরদিকে জাতির ভেতর পচনক্রিয়া দ্রুত প্রসার লাভ কোরছে। যথাসময়ে এই পচনক্রিয়া ঐ রিবাত লাইনেও প্রবেশ করলো। প্রবেশ করলো লাইনের পূর্ব প্রান্তে পারশ্য দেশের দিক থেকে বিকৃত তাসাওয়াফরূপে। কিছু দিনের মধ্যেই ঐ রিবাতগুলি দুর্গ থেকে বোদলে হোয়ে গেল সুফীদের আশ্রম আর রিবাতগুলির মুজাহিদরা হোয়ে গেলেন দরবেশ, সুফী। এমনকি এগুলির আরবী নাম রিবাত পর্য্যন্ত বোদলে হোয়ে গেলো ফারসী শব্দ খানকাহ। এরপর কী হলো তা ইতিহাস। এরপর শত্রু আক্রমণ কোরতে এসে কোন বাধার সম্মুখীন হলো না কারণ তখন তারা মুখোমুখী হলো তলোয়ার হাতে মুজাহিদদের নয়, তসবিহ হাতে খানকাহবাসী, মঠবাসী সুফীদের। দু'চারটি জায়গা ছাড়া সমস্ত মুসলিম(Muslim) পৃথিবী শত্রুর পদানত দাসে পরিণত হলো। মুজাহিদদের তলোয়ার যা কয়েক শতাব্দীরও বেশী রক্ষা কোরেছিল, সুফীদের আধ্যাত্মিক শক্তি ও তসবিহ তা রক্ষা কোরতে পারলোনা (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন পৃঃ ৩৯৮)।

এছাড়া এই সময়কালের মধ্যে এই জীবন ব্যবস্থার ও এই উম্মাহর আরেকটি ভয়ংকর ক্ষতি করা হলো। চুলচেরা বিশ্লেষণের ফলে যে অনৈক্য ও ফেরকা, মাযহাব সৃষ্টি হলো তা ভবিষ্যতে ইনশাল্লাহ লুপ্ত হোয়ে যেয়ে আবার আগের মত কঠিন ঐক্য এই উম্মাহর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে- যখন এই উম্মাহ আবার তার প্রকৃত আকীদা ফিরে পাবে। বিকৃত তাসাওয়াফের অন্তর্মুখী চরিত্রের ও সেরাতুল মুস্তাকীম ছেড়ে দিয়ে দ্বীনের অতি বিশ্লেষণের বিষময় ফল উপলব্ধি কোরে উম্মাহ ইনশাল্লাহ আবার একদিন সেরাতুল মুস্তাকীমের সহজ, সরল রাস্তায়, দ্বীনুল কাইয়্যেমাতে অর্থাৎ তওহীদে ফিরে আসবে। কিন্তু এখন যে ক্ষতির কথা বোলছি সে ক্ষতির পূরণ কঠিন হবে। সেটা হলো এই, এই সময়কালের পণ্ডিত, ফকীহ, মুফাস্সির মোহাদ্দিসরা যে অক্লান্ত ও অপরিসীম পরিশ্রম কোরেছেন এই দ্বীনের কাজে, তা পড়লে, চিন্তা কোরলে বিস্ময়ে অবাক হোয়ে যেতে হয়। বিশেষ কোরে মোহাদ্দিসরা রসুলুল্লাহর (দঃ) হাদীস সংগ্রহ ও যাচাই কোরতে যে অধ্যবসায়, পরিশ্রম আর কোরবানী কোরেছেন তার তুলনা মানুষের ইতিহাসে আর নেই। কিন্তু এরা সবাই বিশ্বনবীর (দঃ) জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় যে ভাগটি সেটাকে যর্থার্থ গুরুত্ব দেননি, সেটা হলো মহানবীর (দঃ) জীবনের সামরিক ভাগ। অবশ্য এটাকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিতে পারেননি কারণ কোরানে স্বয়ং আল্লাহ(Allah) যে তার নবীকে (দঃ) সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে এই জীবন ব্যবস্থা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার আদেশ দিয়েছেন (কোরান- সূরা আল ফাতাহ ২৮, আত তওবা ৩৩, সূরা আস-সাফ ৯)। এই উম্মাহকে যে আদেশ দিয়েছেন সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্য্যন্ত না পৃথিবী থেকে যুলম, অত্যাচার, অশান্তি আর রক্তপাত দূর হোয়ে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত হয় (কোরানে সূরা আনফাল ২২-২৩) এগুলো তো আর বাদ দেয়া সম্ভব নয়। তারপর বিশ্বনবীর (দঃ) জীবনী লিখতে গেলে তিনি যে সমস্ত জেহাদে, কিতালে এবং গাযওয়াতে (যুদ্ধ) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে সব লিখতেই হয়েছে। কিন্তু লিখলেও তারা সেগুলির প্রাধান্য দেননি, প্রাধান্য দিয়েছেন তার জীবনের অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোয়। যে মানুষটির জীবনের মাত্র নয় বছরের মধ্যে আটাত্তরটি যুদ্ধ হয়েছে যার সাতাশটি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নিজে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেছিলেন নয়টিতে, সাংঘাতিকভাবে যখম হোয়েছিলেন আর বিভিন্ন দিকে সামরিক অভিযান পাঠিয়েছিলেন পয়ত্রিশটি, যেগুলির সমরনীতি এবং ব্যবস্থাপনা তাকেই কোরতে হয়েছিল, সে মানুষের জীবনটাকে প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন যোদ্ধার জীবন বোলতে আপত্তির কোন কারণ আছে? প্রতিটি যুদ্ধের আগে কত রকম প্রস্তুতি নিতে হোয়েছে। অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা, সেগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা, শত্রুপক্ষের অবস্থান ও চলাচল, তাদের সংখ্যা ও অস্ত্র শস্ত্রের সংবাদ (Intelligence) শত্রুর ও নিজেদের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা ইত্যাদি কত রকমের কত বন্দোবস্থ কোরতে হোয়েছে, তার ওপর প্রতি যুদ্ধের বিভিন্ন রকমের সমস্যা উদ্ভুত হোয়েছে। সেগুলির সমাধান কোরতে হোয়েছে এই ব্যাপারে ঐ সময়ের পণ্ডিতদের কাছ থেকে আমরা এখন যে তথ্য পাই তা অন্যান্য বিষয়ের তথ্যাদির তুলনায় অতি সামান্য। অথচ যাকে অতগুলি যুদ্ধ কোরতে হোয়েছিলো তার সম্পর্কে লিখতে গেলে তার সামরিক জীবনের খুঁটিনাটিই মুখ্য হোয়ে দাঁড়াবার কথা। কিন্তু হোয়েছে উল্টো। মহানবীর (দঃ) ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি কম প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলোর পুংখানুপুংখ বিবরণ তাদের লেখায় আছে কিন্তু তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সংগ্রামের দিক এত কম স্থান পেয়েছে যে, মনে হয় তারা এটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা কোরেছেন।

এর কারণ আছে। এই ফকীহ, মুফাস্সির, মোহাদ্দিস এরা সবাই আবির্ভুত হোয়েছিলেন এই উম্মাহ তার নেতার (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ অর্থাৎ সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীতে এই দ্বীন প্রতিষ্ঠা কোরে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করার সুন্নাহ ত্যাগ করার পর। এই উম্মাহ সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য তখন তাদের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হোয়ে গেছে, আকীদা বিকৃতি হোয়ে গেছে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হারিয়ে গিয়েছিলো বোলেই তো তারা সংগ্রাম ত্যাগ কোরে খাতা কলম নিয়ে ঘরে বোসেছিলেন এই দ্বীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ কোরতে, আরেক দল এসবও কিছু না কোরে খানকায় ঢুকে তাদের আত্মার ঘষামাজা কোরতে শুরু কোরেছিলেন, নেতার (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ সংগ্রাম মুষ্ঠিমেয় লোক ছাড়া কারুরই সম্মুখে ছিলো না। সুতরাং তারা যে ঐ সংগ্রাম সম্বন্ধে নিরুৎসুক, অনাগ্রহী হবেন তা স্বাভাবিক। তাই তাদের সারাজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের, অসাধারণ অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে যে দ্বীন, জীবন ব্যবস্থা জনসাধারণের সম্মুখে উপস্থাপিত হলো তাতে বিশ্বনবীর (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহর বিবরণ অতি সামান্য, তার ব্যক্তিগত জীবনের কম প্রয়োজনীয় অভ্যাসের বিশদ বিবরণ, দ্বীনের গুরুত্বহীন ব্যাপারগুলির অবিশ্বাস্য বিশ্লেষণ। জন সাধারণের মনে দ্বীন সম্বন্ধে আকীদা বোদলে যেয়ে ঐ রকম হোয়ে গেলো।

এই যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হোয়ে জাতি কয়েকশ' বছর কাটালো এই সময়টাতে পণ্ডিতদের ফতোয়াবাজী আর সুফীদের অন্তর্মুখী সাধনা খুব জোরে শোরে চলছিলো। কাজেই পচনক্রিয়াও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিলো সমস্ত জাতির দেহময়। কিন্তু ওর মধ্যেও দলগত ও ব্যক্তিগতভাবে যাদের মনে প্রকৃত দ্বীনের আকীদা ঠিক ছিলো তারা তাদের কাজ কোরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ক্রমে ঐ পচনক্রিয়া জাতিকে এমন অবস্থায় নিয়ে এলো যে এর মধ্যে আর ফতোয়াবাজী আর তসবিহ টপকানো ছাড়া প্রায় আর কিছুই অবশিষ্ট রোইলো না। বিজ্ঞান, চিকিৎসা, রসায়ন, অংক ইত্যাদি সর্বরকম জ্ঞান থেকে এ জাতি বঞ্চিত হোয়ে এক অশিক্ষিত অন্ধ জাতিতে পরিণত হলো। অন্যদিকে জাতির স্রষ্টা বিশ্বনবী (দঃ) যে সামরিক প্রেরণায় একে এমন এক দুর্দ্ধর্ষ অজেয় জাতিতে পরিণত কোরেছিলেন যার সামনে বিশ্ব শক্তিগুলো পর্য্যন্ত ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মত উড়ে গিয়েছিলো, সে প্রেরণাও কর্পূরের মত উড়ে গিয়ে এক অন্তর্মুখী কাপুরুষ জাতিতে পরিণত হলো। যে বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তির চর্চা কোরে, গবেষণা কোরে এই জাতি পৃথিবীর জ্ঞানকে সম্মুখে অগ্রসর করিয়ে দিয়েছিলেন সেই জ্ঞান এই জাতির শত্রু ইউরোপের খ্রীস্টান জাতিগুলি লুফে নিয়ে তার চর্চা ও গবেষণা শুরু করলো আর এই উম্মাহ ওসব ছেড়ে দিয়ে বিবি তালাকের মাসলা আর ফতোয়া নিয়ে মহা ব্যস্থ হোয়ে পড়লো। এই উম্মাহর আহরিত জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তির ওপর খ্রীস্টান ইউরোপ তাদের প্রযুক্তির (Technology) সৌধ গড়ে তুললো এবং তুলে শক্তিমান হোয়ে এই উম্মাহকে সামরিকভাবে আক্রমণ করলো।

এটা ইতিহাস যে, এই আক্রমণ এই জাতি প্রতিহত কোরতে পারেনি এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিরাট জাতি ইউরোপের বিভিন্ন জাতির পদানত দাসে পরিণত হোয়ে যায়। ইউরোপের ছোট বড় রাষ্ট্রগুলি এই উম্মাহকে টুকরো টুকরো কোরে কেটে খণ্ডগুলি নিজেদের মধ্যে ভাগ কোরে নেয়। প্রতিরোধ যে হয়নি, তা নয়, হোয়েছে, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে। আর যে জাতির ঐক্য নেই সে জাতি শক্তিহীন, পরাজয় তার স্বাভাবিক এবং অবশ্যম্ভাবী। ফকীহ, মুফাস্সির, পণ্ডিতরা পাণ্ডিত্য জাহির কোরতে যেয়ে নানা মাযহাব ফেরকা সৃষ্টি কোরে ঐক্য ধ্বংস কোরে দিয়েছিলেন আর সুফীরা উম্মাহর হাত থেকে তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়ে তসবিহ ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সংগ্রামী চরিত্রই মিটিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই উম্মাহ আর লড়বে কি দিয়ে ইউরোপের বিরুদ্ধে? সুতরাং যা হবার তাই হলো। যে উম্মাহর ওপর বিশ্বনবী (দঃ) দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রাম কোরে সমস্ত পৃথিবীকে এই জীবন ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে এসে মানব জাতির মধ্যে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কোরতে, সেই জাতি তার সংগ্রামী চরিত্র হরিয়ে নিজেই অন্যের ক্রীতদাসে, গোলামে পরিণত হলো।

আমি পেছনে বোলে এসেছি মহানবীর (দঃ) ৬০/৭০ বছর পর থেকে এই জাতি আর জাতি হিসাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী ছিলো না। কিন্তু মুসলিম(Muslim) ছিলো কারণ তাদের সংবিধান ছিলো কোরান এবং হাদীস অর্থাৎ তাদের এলাহ ছিলো আল্লাহ(Allah), আর পথপ্রদর্শক ছিলেন - মোহাম্মদ (দঃ)। যদিও লক্ষ্যচু্যত হোয়ে যাবার এবং আকীদা বিকৃত হবার কারণে তাদের এমন নিদারুন পতন এলো যে, তারা ক্রীতদাসে পরিণত হলো কিন্তু এইবার গোলামে পরিণত হবার পর এই জাতি আর মুসলিম(Muslim)ও রইলোনা, মুশরেকে পরিণত হলো। কারণ বোলছি। আল্লাহ(Allah) কোরানে অনেকবার এই জাতিকে লক্ষ্য কোরে বোলেছেন যে, যদি তোমরা মো'মেন হও তবে আমি তোমাদের পৃথিবীতে উচ্চ রাখব, অন্যান্য জাতিদের ওপর তোমাদের প্রবল রাখবো পৃথিবীর কতৃত্ব, ক্ষমতা তোমাদের হাতে দেব (কোরান- সূরা আন নূর ৫৫)। তাহোলে যখন এই জাতি ইউরোপীয়ানদের কাছে যুদ্ধে হেরে গেলো তখন প্রমাণ হলো যে ঐ জাতি আর মো'মেন নয়। না হলে আল্লাহ(Allah)র প্রতিশ্রুতি মিথ্যা (নাউযুবিল্লাহ)। তারপর সূরা ফাতাহতে আল্লাহ(Allah) বোলছেন- "যখন অবিশ্বাসীরা তোমাদের (মুসলিমদের) সঙ্গে যুদ্ধ কোরবে (এখানে আল্লাহ(Allah) সশস্ত্র যুদ্ধের কথা বোলছেন, কারণ শব্দ ব্যবহার কোরেছেন কিতাল) তখন নিশ্চয়ই তারা পালিয়ে যাবে। (অর্থাৎ হেরে যাবে) অতঃপর তাদের রক্ষা করার কোন অভিভাবক বা সাহায্যকারী থাকবে না। এটা সর্বকালে (পূর্বকাল থেকে সব সময়ই) আল্লাহ(Allah)র সুন্নাহ (রীতি) এবং আল্লাহ(Allah)র এই সুন্নাহ (রীতি) তিনি কখনও বদলান না (কোরান- সূরা আল ফাতাহ ২২-২৩)। লক্ষ্য করুন, মুসলিম(Muslim) জাতিকে, উম্মতে মোহাম্মদীকে আল্লাহ(Allah) কী বোলছেন। তিনি বোলছেন- তোমাদের সঙ্গে যখনই অবিশ্বাসীদের (এখানে অবিশ্বাসী অর্থ যারা শেষ নবীর (দঃ) ওপর অবতীর্ণ জীবন ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না) যুদ্ধ হবে তখনই তারা পরাজিত হোয়ে পালিয়ে যাবে। কারণ হিসাবে বোলছেন যে, তাদের রক্ষা করার জন্য কোন অভিভাক বা সাহায্যকারী নেই অর্থাৎ আল্লাহ(Allah)তো উম্মাতে মোহাম্মদীর অভিভাবক এবং সাহায্যকারী আর ঐ পক্ষে কে অভিভাবক বা সাহায্যকারী? আর কেউ নেই। কাজেই পরাজয় ছাড়া তাদের জন্য আর কী সম্ভব? এই বোলে পরের আয়াতে আল্লাহ(Allah) বোলছেন- এটা অর্থাৎ এই কাজ আমার সর্বকালের সুন্নাহ। সুন্নাহ শব্দের অর্থ হলো কারো কোন রীতি, নীতি, অভ্যাস, নিয়ম ইত্যাদি এবং আল্লাহ(Allah) বোলছেন এটা আমার সর্বকালের রীতি, অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদীর আগেও যে নবীদের (আঃ) তিনি পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাদের উম্মাহগুলিও- যখন অবিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ হোয়েছে তখনও আল্লাহ(Allah) সব সময়ই তাদের জয়ী কোরেছেন, তাদের শত্রুরা হেরে পালিয়ে গেছে। এরপর বোলছেন আল্লাহ(Allah)র এই সুন্নাহ কখনও বদলাবার নয়।

আল্লাহ(Allah)র এই কথা যে কত সত্য তার প্রমাণ আমরা পাই যখন আমরা উম্মতে মোহাম্মদী অর্থাৎ প্রথম ৬০/৭০ বছরের ইতিহাস পড়ি। সংখ্যায়, আয়োজনে, অস্ত্র, শস্ত্রে, বাহনে, রশদে এক কথায় প্রতি ক্ষেত্রে নগন্য এই জাতি দুইটি বিশ্বশক্তিকে পরাজিত করলো। আল্লাহ(Allah) তার সুন্নাহ বজায় রাখলেন। কিন্তু এইবার ইউরোপ থেকে যে আক্রমণ এলো সে আক্রমণে এই জাতি প্রতি যুদ্ধে পরাজিত হলো, যদিও আক্রমনগুলি এসেছিলো ই্উরোপের বিভিন্ন ছোট বড় রাষ্ট্রগুলি থেকে। এই পরাজয় প্রমাণ করলো যে, এই জাতি আর আল্লাহ(Allah)র চোখে মো'মেনও নয় উম্মতে মোহাম্মদীও নয়। কারণ যদি এই জাতি মো'মেন হোয়ে থেকেও যুদ্ধে পরাজিত হোয়ে খ্রীস্টান ইউরোপের দাসে পরিণত হোয়ে যায় তবে আল্লাহ(Allah)র বাণী মিথ্যা (নাউজুবিল্লাহ)। আর নইলে তিনি তার সুন্নাহ বদলিয়ে ফেলেছেন এবং পুর্ববর্তী সব নবীদের উম্মাতের বেলায় না বদলিয়ে তার সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর (দঃ) উম্মাহর বেলায় এসে প্রথম তার সুন্নাহ ত্যাগ কোরলেন। এর দু'টোর একটাও সম্ভব নয়, কাজেই একমাত্র সিদ্ধান্ত হলো এই যে, যখন ইউরোপের রাষ্ট্রগুলি এই জাতিকে, যে জাতি তখনও নিজেকে মো'মেন ও উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনে কোরতো (এবং আজও করে) আক্রমণ করলো তখন সেটা আর মো'মেন নয় উম্মতে মোহাম্মদীও নয়। দ্বীনের অতি বিশ্লেষণের ফলে বিভিন্ন মযহাবে ও ফেরকায় বিভক্ত, ছিন্নভিন্ন, ঐক্যহীন এবং সুফী মতবাদের প্রভাবে বিকৃত আকীদায় অন্তমুর্খী, স্থবির জনসংখ্যা। আল্লাহ(Allah) আর ঐ জনসংখ্যার অভিভাবকও নন, সাহায্যকারীও নন। কাজেই অবশ্যম্ভাবী ফল পরাজয়। সেই যে বিশ্বনবী (দঃ) সতর্ক কোরে দিয়েছিলেন দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করোনা, পরাজিত হবে- ঠিক তাই হলো।

সশস্ত্র সংগ্রামে পরাজিত কোরে খ্রীস্টান রাষ্ট্রগুলি এই বিরাট জাতিটাকে খণ্ড খণ্ড কোরে এক এক রাষ্ট্র এক এক খণ্ড অধিকার কোরে শাসন ও শোষণ কোরতে লাগলো। এতদিন এই জাতির সংবিধান ছিলো কোরান ও হাদীস। রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ইত্যাদির উৎস ছিলো ঐ কোরান ও হাদীস। বিচরালয়ে বিচার হতো আল্লাহ(Allah)র দেয়া আইনে (ফিকাহ), দণ্ড দেয়া হতো আল্লাহ(Allah)র ও রসুলের (দঃ) নির্দেশ মোতাবেক। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে তো জাতি বিচ্যুত হোয়ে গিয়েছিলোই তা না হলে তো আর শত্রুর ক্রীতদাসে পরিণত হোতে হোত না। কিন্তু তবুও পরাজিত হবার আগে পর্য্যন্ত এই জাতির সব কিছুই পরিচালিত হতো কোরান সুন্নাহ মোতাবেক (যা এখন আমাদের মধ্যে নেই) অর্থাৎ ঐ জাতি উম্মতে মোহাম্মদী না থাকলেও মুসলিম(Muslim) ছিলো। কিন্তু উদ্দেশ্য অর্জনের সংগ্রাম ত্যাগ করা, লক্ষ্য ভ্রষ্ট হওয়া কী অমার্জনীয় অপরাধ তার প্রমাণ এই যে, মুসলিম(Muslim) থাকা সত্ত্বেও সালাত, সওম, হজ, যাকাত ইত্যাদি নিষ্ঠার সাথে করা সত্ত্বেও প্রচুর নফল বা সালাত, যিকর, মোরাকেবা, তসবিহ, দাড়ী, টুপি, পাগড়ী, খানকাহ, হুজরা, লক্ষ লক্ষ সুফী দরবেশ, ও তাদের কোটি কোটি মুরীদ সত্ত্বেও আল্লাহ(Allah) এই জাতিকে ইউরোপের ছোট ছোট খ্রীস্টান জাতির পদানত কোরে তাদের ক্রীতদাস বানিয়ে দিলেন। অপমানের চূড়ান্ত কোরবার জন্য আল্লাহ(Allah) এতখানি কোরলেন যে, পুর্তগালের মত মাত্র কয়েক লক্ষ লোকের একটি ছোট্ট রাষ্ট্রের গোলাম বানিয়ে দিলেন এই উম্মাহর কয়েক কোটি মানুষকে। যখন এই উম্মাহ সশস্ত্র সংগ্রামে শত্রুর কাছে পরাজিত হলো তখন কোরান মোতাবেক প্রমাণ দেখিয়ে এসেছি যে, তারা আর আল্লাহ(Allah)র চোখে মো'মেন নেই। এবার হাদীস দিয়ে দেখাচ্ছি। একদিন মহনবী (দঃ) সালাতের পর স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশীক্ষণ দোয়ায় ব্যাপৃত রোইলেন। সাহাবারা (রাঃ) অপেক্ষা কোরছিলেন। দোয়া শেষে তারা জিজ্ঞাসা কোরলেন আজ এত দেরী হলো কেন? আল্লাহ(Allah)র রসুল (দঃ) বোললেন- আজ আমি আল্লাহ(Allah)র কাছে তিনটি জিনিষের জন্য প্রার্থনা কোরছিলাম। একটা হলো (পূর্ববর্তী অনেক উম্মাহর মত তাদের পথ ভ্রষ্টতার জন্য) আমার উম্মাহকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস কোরে দিওনা, দ্বিতীয়টা আমার উম্মাহ যেন শত্রুর কাছে কখনো পরাজিত না হয় এবং তৃতীয়টি হলো আমার উম্মাহ যেন নিজেদের মধ্যে মারামারি না করে। আল্লাহ(Allah) প্রথম দু'টি মনযুর কোরেছেন, তৃতীয়টি করেননি [হাদীস খাব্বাব বিন আমর (রাঃ) থেকে তিরমিযি, নাসায়ি, মেশকাত]। দ্বিতীয়টি লক্ষ করুন। 'আমার উম্মাহ যেন শত্রুর কাছে পরাজিত না হয়' এবং ওটা আল্লাহ(Allah) মনযুর কোরলেন। এরপর যদি ঐ উম্মাহ আটলান্টিকের তীর থেকে বোর্নিও পর্য্যন্ত সর্বত্র যুদ্ধে পরাজিত হোয়ে ঘৃণিত ক্রীতদাসে পরিণত হয় তবে হয় স্বীকার কোরতে হবে যে, আল্লাহ(Allah) নবীকে (দঃ) দেয়া তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ কোরলেন আর তা না হলে ঐ জাতি আর মোহাম্মাদের (দঃ) প্রকৃত উম্মাহও নয় মো'মেন নয়। আর কোনও সিদ্ধান্ত নেই। আল্লাহ(Allah)র ঐ প্রতিশ্রুতি শুধু ঐ একটা হাদীসে নয়, আরও হাদীসে আছে। উদাহরণ স্বরূপ আমর বিন কায়েস থেকে দারিমী মেশকাত ইত্যাদি। এছাড়াও মো'মেন হোলে যে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে জয় স্বয়ং আল্লাহ(Allah)র প্রতিশ্রুতি তা কোরানের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। যেমন সূরা ইমরানের ১৩৯ আয়াত, সূরা নূরের ৫৫ আয়াত ইত্যাদি। শুধু প্রতিশ্রুতি নয় সুরা রুমের ৪৭ আয়াতে আল্লাহ(Allah) বোলছেন- মো'মেনদের সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্য, আল্লাহ(Allah) যদি নিখুঁত হোয়ে থাকেন তবে তিনি ঐ জাতিটি যেটি ইউরোপের সামরিক আক্রমণে পর্যূদস্থ হোয়ে গেলো, ঐ জাতিটাকে মো'মেন বোলে স্বীকৃতি দেননি, আর তা না হলে তিনি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হোয়েছেন। আল্লাহ(Allah) ছোবহান যেমন সত্য তেমনি সত্য যে তিনি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হোতে পারেন না। কাজেই অনিবার্য সিদ্ধান্ত হলো যে, ঐ জাতি মো'মেন ছিল না। অথচ ভুললে চলবে না যে, এই সময় এই জাতির সংবিধান কোরান হাদীস, বড় বড় ফকীহ, মুফাস্সির, মোহাদ্দিস, পীর, দরবেশ, সুফী ইত্যাদি কিছুরই অভাব ছিলো না, শুধু অভাব ছিলোনা বোললে হয় না বরং বোলতে হয় এসব দিয়ে জাতি ভরপুর ছিলো। কিন্তু আল্লাহ(Allah) এসব কিছুই দেখলেন না, তোয়াক্কা কোরলেন না। তিনি এই উম্মাহকে ইউরোপের খ্রীস্টান জাতিগুলির গোলামে পরিণত কোরে দিলেন। এবং দিলেন এই বিরাট জাতিটার সবটকু- শিয়া, সুন্নী, হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বালী ও অন্যান্য কোন ফেরকাও বাদ রোইলো না। বাদ রোইলো শুধু মধ্য আরবের ঐ জায়গাটুকু যেখানে কাবা আর বিশ্বনবীর (দঃ) রওজা মোবারক অবস্থিত। ওটুকুও যদি খৃষ্টান শক্তিগুলি দখল কোরতে চাইতো তবে তাও রক্ষা করার শক্তি এ জাতির ছিলো না। কিন্তু বোধহয় আল্লাহ(Allah)র তার নিজের ও তার প্রিয় হাবিবের সম্মান ও ইযযতের খাতিরে নিজে এ স্থানটুকু রক্ষা কোরলেন।

এই জাতি এই উম্মাহর জন্য আল্লাহ(Allah) ও তার রসুল (দঃ) যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ কোরে দিয়েছিলেন সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হওয়ার শাস্থি কী ভয়াবহ হলো। এই যুদ্ধে ইউরোপীয়ান খ্রীস্টান লক্ষ লক্ষ পুরুষ-নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা শিশুকে গুলি কোরে, ট্যাংকের তলায় পিষে, আগুনে পুড়িয়ে এমনকি জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা কোরেছে, লাইন কোরে দাঁড় করিয়ে মেশিনগান কোরেছে, আল্লাহ(Allah) কি এসব দেখেন নি? নিশ্চয়ই দেখেছেন, কিন্তু একটি আংগুল তুলেও সাহায্য করেননি। কারণ তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শুধু মো'মেনকে, উম্মাতে মোহাম্মদীকে সাহায্য করার। এই জাতিটি যে তখনও মুসলিম(Muslim) তিনি তাও পরোওয়া কোরলেন না। এই উম্মাহকে পরাজিত কোরে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করার পর ইউরোপীয়ান জাতিগুলি তাদের যার যার দখল করা এলাকায় তাদের নিজেদের তৈরী আইন ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করলো।

কোন মন্তব্য নেই: