বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১১

৯। খ্রীস্টানদের তৈরী 'ইসলামী' শিক্ষা ব্যবস্থা

উৎস: Islam and Dajjal

আরও একটি পরিবর্তন এলো। প্রথমে সমস্ত মানব জাতির ওপর এই শেষ জীবন ব্যবস্থা প্রবর্তন কোরে পৃথিবীময় ন্যায় ও শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দিয়ে এই জাতি উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হোয়ে গিয়েছিল, রোয়ে গিয়েছিলো মুসলিম(Muslim) হোয়ে। অর্থাৎ ঐ শেষ জীবন ব্যবস্থা তাদের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে কার্যকরী রোইলো। কাজেই তারা মুসলিম(Muslim) কিন্তু আল্লাহ(Allah)র দেয়া উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম ত্যাগ করার ফল হিসাবে আকীদা বিকৃত হোয়ে দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ফলে বিকৃত সুফী মতবাদের প্রভাবে ঐক্যহীন একটি স্থবির প্রাণহীন জনসংখ্যায় পরিণত হলো যেটা শত্রুর আক্রমণের মুখে সহজেই ভেঙ্গে পড়লো। কিন্তু এই বার শত্রু যখন তাদের নিজের তৈরী আইন ও শাসন ব্যবস্থা তাদের দাস জাতির ওপর প্রবর্তন করলো তখন এই জাতি আর ঐ মুসলিম(Muslim)ও রোইলো না, হোয়ে গেলো তাদের প্রভুদের মত মোশরেক ও কাফের। পূর্ববর্তী দ্বীন গুলির বিকৃত অবস্থা ও মানুষের তৈরী আইন-কানুন ধ্বংস কোরে আল্লাহ(Allah)র পাঠানো আইন কানুন প্রবর্তন কোরে পৃথিবীময় শান্তি (ইসলাম(Islam)) প্রতিষ্ঠা যে জাতির দায়িত্ব সেই জাতিই যদি জাতীয় জীবনে ঐ আইন-কানুন পরিত্যাগ কোরে যে আইন-কানুন ধ্বংস করার কথা সেই আইন কানুন গ্রহণ করে তবে সে জাতির রইলো কি? জাতীয় জীবনে মানুষের তৈরী, ইউরোপের তৈরী আইন-কানুন গ্রহণ কোরে এই জাতি কার্যতঃ মোশরেক ও কাফের হোয়ে গেলো এবং সেই যে মোশরেক ও কাফের হলো তা থেকে সে আজও প্রত্যাবর্তন করেনি, আজও সেই মোশরেকই আছে।

আমি সম্পূর্ণ সচেতন, আমি কী লিখছি। এই কথায় এই জাতিটি যেটি নিজেকে শুধু মো'মেন ও মুসলিম(Muslim) নয় একেবারে উম্মতে মোহাম্মদী বোলে আহাম্মকের স্বর্গে বাস কোরছে, সেটা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে। কারণ আমার কথায় গত কয়েকশ বছরের মধ্যকার বেশীরভাগ পীর, দরবেশ, সুফী, তথাকথিত আলেম, মাশায়েখ, ফকীহ ইত্যাদি সবাই এসে যাচ্ছেন। কিন্তু উপায় কি? যে সত্য আল্লাহ(Allah) আমাকে তার অসীম অনুগ্রহে উপলব্ধি কোরিয়েছেন তা আমাকে বোলতে হবে। আজ যদি হিন্দুদের (যদিও হিন্দু বোলে কোন ধর্ম নেই) বলা যায় নিজের দেহের ভেতরে এই বিশাল সৃষ্টির স্রষ্টার আত্মা নিয়ে হাতে তৈরী কাঠ পাথরের মুর্তির পায়ে প্রণত হোয়ে স্রষ্টাকে অপমান করছো, খ্রীস্টানকে বলা যায় যিশুকে (আঃ) স্রষ্টার সন্তান বোলে বিশ্বাস কোরে যিশুকেই তার স্রষ্টার কাছে লজ্জিত করছো তবে তাদের যে মনোভাব হবে নিজেদের মুসলিম(Muslim), উম্মতে মোহাম্মদী বোলে বিশ্বাসী এই জাতিটাকে তোমরা কার্যতঃ মোশরেক বোললে এদেরও ঠিক সেই মনোভাবই হবে। কোন সন্দেহ নেই যে এই জাতিটা ইউরোপের দাসে পরিণত হবার পরও বহু লোক আল্লাহ(Allah) ও তার রসুলে (দঃ) পরিপূর্ণ বিশ্বাসী ছিলো, কিন্তু সে বিশ্বাস ছিলো ব্যক্তিগতভাবে, জাতিগত ভাবে নয়। কারণ জাতিগত ভাবে তাদের রাজনৈতিক আর্থ সামাজিক ও শিক্ষা ব্যবস্থা তো তখন ইউরোপীয়ান খ্রীস্টানদের হাতে এবং তারা ইসলামী(Islam) ব্যবস্থা বোদলে নিজেদের তৈরী ব্যবস্থা এই জাতির জীবনে প্রতিষ্ঠা কোরেছে। জাতীয় জীবন থেকে আল্লাহ(Allah)র দেয়া রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা কেটে ফেলে শুধু ব্যক্তিগত জীবনে তা বজায় রাখলে আল্লাহ(Allah)র চোখে মুসলিম(Muslim) বা মোমেন থাকা যায় কিনা এ প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর হোচ্ছে- না, থাকা যায় না। তার বই কোরানে আল্লাহ(Allah) বোলেছেন- তোমরা কি বইয়ের (কোরানের) কিছু অংশ বিশ্বাস কর, আর কিছু অংশ বিশ্বাস কর না? যারা তা করে (অর্থাৎ আল্লাহ(Allah)র আদেশ সমূহের এক অংশ বিশ্বাস করে না বা তার ওপর আমল করে না) তাদের প্রতিফল হচ্ছে এই পৃথিবীতে অপমান, লাঞ্ছনা এবং কেয়ামতের দিনে কঠিন শাস্তি। তোমরা কী করছ সে সম্বন্ধে আল্লাহ(Allah) বেখেয়াল নন (কোরান সূরা আল বাকারা ৮৫)। লক্ষ্য করুন, আল্লাহ(Allah) পরিষ্কার ভাষায় কী বোলেছেন। তার আদেশ নিষেধ গুলির কতকগুলি মেনে নেয়া আর কতকগুলিকে না মানার অর্থ আল্লাহ(Allah)কে আংশিকভাবে মানা অর্থাৎ শেরক। তারপর বোলছেন এর প্রতিফল শুধু পরকালেই হবে না এই দুনিয়াতেও হবে আর তা হবে অপমান ও হীনতা। আল্লাহ(Allah) মো'মেনদের প্রতিশ্র্#১২৮;তি দিয়েছেন উভয় দুনিয়াতে অন্য সবার ওপর স্থান ও সম্মান। এ প্রতিশ্রুতি তার কোরানের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এখন যদি এই লোকগুলিকে তিনি বলেন, তোমাদের জন্য এই দুনিয়াতে অপমান ও কেয়ামতে কঠিন শাস্তি, শব্দ ব্যবহার করেছেন 'শাদীদ' ভয়ংকর তবে আল্লাহ(Allah) তাদের নিশ্চয়ই মোমেন বোলে স্বীকার কোরছেন না। যদিও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ(Allah)র আইন-কানুন (শরীয়াহ) তারা পুংখানুপুংখভাবে মেনে চলেন।

আল্লাহ(Allah) কোরানে আরো বোলেছেন- হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা পূর্ণভাবে সম্পূর্ণভাবে ইসলামে(Islam) প্রবিষ্ট হও (বাকারা- ২০৮)। আকীদা বিকৃতি হোয়ে যাওয়ার ফলে আজ আল্লাহ(Allah)র এই আদেশের অর্থ করা হয় এই যে, ইসলামে(Islam)র খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি পালন কর। আসলে এই আয়াতে আল্লাহ(Allah) মো'মেনদের অর্থাৎ যারা আল্লাহ(Allah)কে বিশ্বাস করে তাদের বোললেন যে, ইসলাম(Islam)কে অর্থাৎ আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন বিধানকে সম্পূর্ণ ও পূর্ণভাবে গ্রহণ কর এর কোন একটা অংশকে নয়। শুধু জাতীয়, রাষ্ট্রীয় অংশটুকু নয় ব্যক্তিগত অংশকে বাদ দিয়ে, কিম্বা শুধু ব্যক্তিগত অংশটুকু নয়, জাতীয় অংশকে বাদ দিয়ে। ঐ কথার পরই তিনি বোলছেন- এবং শয়তানের কথামত চলো না। অর্থাৎ ঐ আংশিকভাবে ইসলামে(Islam) প্রবেশ কোরলে তা শয়তানের অনুসরণ করা হবে, শয়তানের কথামত চলা হবে। শয়তান তাই চায়, কারণ আংশিকভাবে অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে আল্লাহ(Allah)র আইন, বিধান প্রতিষ্ঠা না কোরে শুধু ব্যক্তিগত জীবনে তা মেনে চোললে সুবিচার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবেনা এবং ফাসাদ ও সাফাকুদ্‌দিমা চোলতেই থাকবে। যেমন আজ শুধু পৃথিবীতে নয়, মুসলিম(Muslim) নামের এই জাতিতেও নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ও অন্যান্য খুঁটিনাটি পূর্ণভাবে পালন করা সত্ত্বে আল্লাহ(Allah)কে দেয়া তার চ্যালেঞ্জে শয়তান আপাততঃ জিতে আছে। সুতরাং এই জাতি (উম্মাহ) যখন ইউরোপীয়ানদের কাছে যুদ্ধে হেরে যেয়ে তাদের দাসে পরিণত হলো এবং তাদের রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা যখন তাদের বিদেশী প্রভূরা পরিবর্তন কোরে তাদের নিজেদের তৈরী ব্যবস্থা প্রবর্তন করলো, তখন আর এই জাতি মুসলিম(Muslim)ও রইলো না হোয়ে গেল মোশরেক এবং কাফের। এদেরকে যে আর উম্মতে মোহাম্মদী তো নয়ই এমনকি মুসলিম(Muslim) বা প্রকৃত মোমেনও বলা যাবে না তার আরও একটি প্রধান কারণ আছে। প্রত্যেক জাতির নেতাও সেই সেই জাতির অন্তর্ভূক্ত। সে হিসাবে বিশ্বনবী (দঃ) এই জাতির অন্তর্ভূক্ত। তাহোলে বোলতে হয় আল্লাহ(Allah) নবীদের নেতা, মানব জাতির শ্রেষ্ঠতম মানুষ, স্রষ্টার প্রিয় বন্ধু- তারপরই যার স্থান, তিনি ইউরোপীয়ান খ্রীস্টানদের ঘৃণিত দাসজাতির নেতা। এ অসম্ভব। পৃথিবীর যে কেউ মানতে পারে মানুক, আমি মানি না। এর একমাত্র উত্তর হোচ্ছে তিনি ঐ দাস জাতির নেতা নন এবং ঐ দাস জাতি তার জাতি নয়। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ঐ নবী (দঃ) বোলেও গেছেন। তিনি বোলেছেন- সে জাতি কেমন কোরে ধ্বংস হবে যার প্রথমে আমি মধ্যে মাহদী আর শেষে ঈসা। কিন্তু এদের ফাঁকে (অর্থাৎ মধ্যবর্তী) যারা তারা আমার নয় আমিও তাদের নই (হাদীস- জাফর (রাঃ) থেকে রাযিন মেশকাত)। যারা মহানবীর (দঃ) নয় এবং মহানবী (দঃ) যাদের নন তারা যে উম্মতে মোহাম্মদী তো নয়ই মুসলিম(Muslim)ও যে নয় তা তো আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বনবীর (দঃ) সঙ্গী (আসহাব) অবস্থায় ও বিশ্বনবীর (দঃ) পর সংখ্যায় সামান্য হোয়েও, সর্বদিক দিয়ে নগণ্য হোয়েও তাদের চেযে সংখ্যায়, অস্ত্রে, সামরিক শিক্ষায় বহু শ্রেষ্ঠ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রতিবার জয়ী জাতিটি ছিলো তার (দঃ) উম্মাহ। তারপর যখন জাতিটি আয়তনে বিরাট হলো, সংখ্যায়, অস্ত্রশস্ত্রে, সম্পদে অতুলনীয় হওয়া সত্ত্বেও তাদের চেয়ে অনেক ছোট শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে তাদের ক্রীতদাসে পরিণত হলো, তখন আর সেটা তার(দঃ) উম্মাহও নেই মুসলিম(Muslim)ও নেই। তাই সেই ঘৃণিত দাস জাতির সঙ্গে একই সাথে চিহ্নিত না হওয়ার জন্য তিনি (দঃ) বোলছেন তারা আমার নয়, আমিও তাদের নই। কিন্তু তিনি (দঃ) অস্বীকার কোরলে কি হবে, ঐ দাস জাতির সাধারণ মানুষ ও ফকীহ, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, মুফতি, পীর, মাশায়েখ, ইউরোপীয়ান খ্রীস্টানদের গোলাম অবস্থায় থেকেই তাকে (দঃ) তাদের নেতা বোলে পরিচয় দিয়ে তাকে (দঃ) অসম্মান, অপমান কোরে আসছে কয়েক শতাব্দী ধোরে।

মোট কথা এই জাতির জন্ম হোয়েছিলো পূর্ববর্তী দ্বীনগুলির বিকৃত অবস্থা ও পরবর্তীতে মানুষের তৈরী জীবন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পৃথিবীময় এই শেষ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা কোরে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার সুনিশ্চিত করার জন্য। আল্লাহ(Allah) তার শ্রেষ্ঠ নবীকে (দঃ) পাঠিয়েই ছিলেন এই কাজ করার জন্য (কোরান- সূরা আল ফাতাহ ২৮)। যে কাজের দায়িত্ব পরে এসে পড়লো এই জাতির ওপর এবং জাতি তা পালনও করলো ৬০/৭০ বছর পর্য্যন্ত। কিন্তু তারপর ঐ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভুলে যাবার ফলে আকীদা বিকৃত হোয়ে যাবার ফলে যখন সব কিছু নষ্ট হোয়ে গেলো শত্রুর কাছে সামরিকভাবে পরাজিত হোয়ে তাদের গোলামে পরিণত হলো তখন আর ঐ জাতি মুসলিম(Muslim)ও রোইলোনা, মো'মেনও রইলোনা, উম্মতে মোহাম্মদী তো দূরে কথা। কারণ যে জীবন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার কথা সেই গায়রুল্লাহর তৈরী জীবন ব্যবস্থাকে গ্রহণ করার পর ঐ জাতির অস্থিত্বের আর কোন অর্থ থাকে না, অর্থ রোইল না। ইউরোপীয়ান খ্রীস্টানদের দাসে পরিণত হবার পরও এ জাতির চোখ খুললো না। মনে এ চিন্তাও এলো না যে একি? আমার তো অন্য জাতির গোলাম হবার কথা নয়। আল্লাহ(Allah) প্রতিশ্রুতি তো এর উল্টো, আমাকেই তো পৃথিবীর সমস্ত জাতির ওপর প্রাধান্য দেবার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়ে ছিলেন। আমরা যখন মুষ্টিমেয় ছিলাম তখন তো আমাদের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। ঐ মুষ্টিমেয় যোদ্ধার কারণে আমরা পৃথিবীর একটা বিরাট অংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় কি হলো? সেই মুষ্টিমেয়ের কাছে পরাজিত শত্রু আজ আমাদের জীবন বিধাতা। এসব চিন্তা এ জাতির মনে এলো না কারণ কয়েক শতাব্দী আগেই তাদের আকীদা বিকৃত হোয়ে গিয়েছিলো। কোরান হাদীসে পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতরা এ জাতির এক অংশের আকীদা এই কোরে দিয়েছিলেন যে, ব্যক্তিগতভাবে খুঁটিনাটি শরীয়াহ পালন কোরে চোললেই "ধর্ম পালন" করা হয় এবং পরকালে জান্নাত লাভ হবে। অন্যদিকে ভারাসাম্যহীন বিকৃতি তাসাওয়াফ অনুশীলনকারীরা জাতির অন্য অংশের আকীদা এই কোরে দিয়েছিলেন যে, দুনিয়াবিমুখ হোয়ে নির্জনতা অবলম্বন কোরে ব্যক্তিগতভাবে আত্মার ঘষামাজা কোরে পবিত্র হোলেই "ধর্ম পালন" করা হয় ও আল্লাহ(Allah)র নৈকট্য লাভ হয়। জাতীয় জীবন কোন্ আইনে চোলছে, কার তৈরী দণ্ডবিধিতে (Penal code) আদালতে শাস্তি হোচ্ছে তা দেখবার দরকার নেই। এই আকীদা (Penal, Concept) দৃষ্টিভঙ্গি যে বিশ্বনবীর (দঃ) শিক্ষার বিপরীত তা উপলব্ধি করার শক্তি তখন আর এ জাতির ছিলো না। কারণ ফতোয়াবাজীর জ্ঞানই যে একমাত্র জ্ঞান, পৃথিবীর অন্যান্য কোন জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, পণ্ডিতদের এই শিক্ষার ও ফতোয়ার ফলে এই জাতি একটি মুর্খ জাতিতে পর্যবসিত হোয়ে গিয়েছিলো, দৃষ্টি অন্ধ হোয়ে গিয়েছিলো। স্থানে স্থানে কিছু সংখ্যক লোক বাদে সমস্ত জাতিটাই এই অজ্ঞানতার ঘোর অন্ধকারের মধ্যে বোসে ভারবাহী পশুর মত ইউরোপীয়ান প্রভূদের পদসেবা করলো কয়েক শতাব্দী ধোরে। এই কয়েক শতাব্দীর দাসত্বের সময়ে এই জাতি অকৃত্রিম হৃদয়ে তার খ্রীস্টান প্রভুদের সেবা কোরেছে। প্রভুরা যখন নিজেদের মধ্যে মারামারি কোরেছে তখন এরা যার যার প্রভুর পক্ষ নিয়ে লড়েছে ও প্রাণ দিয়েছে। যে মহামূল্যবান প্রাণ শুধুমাত্র পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম(Islam)) প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে উৎসর্গ করার কথা সে প্রাণ এরা দিয়েছে ইউরোপীয়ান খ্রীস্টান প্রভূদের সাম্রাজ্য বিস্থারের যুদ্ধে, প্রভূদের নিজেদের মধ্যে মারামারিতে। আল্লাহ(Allah)র শাস্তি কী ভয়ংকর।

এখন দেখা দরকার এই জাতিটিকে পরাজিত কোরে দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ কোরে তাদের আল্লাহ(Allah) প্রদত্ত আইন-কানুন নিষিদ্ধ কোরে মোশরেক ও কাফের বানানোর পর ইউরোপীয়ান জাতিগুলি তাদের প্রভুত্ব স্থায়ী করার জন্য কি কি ব্যবস্থা নিলো। এই নতুন প্রভ রা বোকা ছিলো না। তারা ভালোকোরেই জানতো যে, কোন জাতিকে তারা শৃংখলিত কোরতে পেরেছে এবং কেন পেরেছে। বুদ্ধিমান শত্রু বুঝছিলো যে, যে জাতির সামনে তারা একদিন ঝড়ের মুখে শুকনো পাতার মত উড়ে গিয়েছিলো তাদের তারা আজ পদানত কোরতে পেরেছে, কারন জাতিটি তাদের জন্য যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট কোরে দেয়া ছিলো তা থেকে ভ্রষ্ট হোয়ে গিয়েছে এবং ঐ লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার ফলশ্রুতিতে তাদের বহির্মুখী ও বিস্ফোরণমুখী চরিত্র পরিবর্তীত হোয়ে অন্তর্মুখী হোয়ে জাতির গতি রুদ্ধ হোয়ে স্থবির হোয়ে গিয়েছে। এবং এই গতিহীনতা ও স্থবিরত্বের অবশ্যম্ভাবী ফল জাতির পণ্ডিতরা তাদের জীবন ব্যবস্থা দ্বীনের আদেশ নিষেধ গুলির চুলচেরা সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ কোরে নানা রকম মাযহাব ও ফেরকা সৃষ্টি করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবং বিকৃত ভারসাম্যহীন সুফীরা আত্মা ঘষামাজার নানা পন্থা তরিকা সৃষ্টি করার সুযোগ ও সময় পেয়েছিলেন। শত্রু এও বুঝেছিলো যে, যতদিন তারা তাদের দাস জাতিটাকে ঐ লক্ষ্য ভুলিয়ে রাখতে পারবে, যতদিন এই জাতি তাদের দ্বীনের ব্যবহারিক দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ম কানুনের মাসলা মাসায়েল পালন নিয়ে ব্যস্থ থাকবে, যতদিন তারা তাদের আত্মা পরিষ্কার ধোয়া মোছায় ব্যাপৃত থাকবে ততদিন তাদের কোন ভয় নাই। কিন্তু একবার যদি এই জাতি কোনও ভাবে আল্লাহ(Allah) ও তাদের নেতা (দঃ) যে লক্ষ্য, যে দিন-নির্দেশনা হেদায়াত তাদের দিয়েছেন তা ফিরে পায় তবে ঠিক আগের মতই তারা আবার এই জাতির সামনে শুকনো পাতার মত উড়ে যাবে এবং তাদের প্রকৃত লক্ষ্যকে যদি তাদের সামনে থেকে আড়াল কোরে রাখতে হয় তবে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ কোরতে হবে।

বুদ্ধিমান শত্রুরা ঠিক এই পদক্ষেপই নিলো। নিদারুণ পরিহাস এই যে, ইউরোপীয়ান বিজয়ী জাতিগুলি এই দাস জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা অধ্যয়ন ও পরীক্ষা কোরে দেখতে পেলো যে, এই জাতিটিকে দাসত্বের শিকলে চিরদিন আবদ্ধ কোরে রাখার জন্য যে রকমের শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরী ও প্রচলন করা দরকার তা কোরতে তাদের খুব বেশী পরিশ্রম কোরতে হবে না। কারণ এই জাতির ফূকাহা, মুফাস্সির, মোহাদ্দিস ও মুফতি এক কথায় পণ্ডিতরা ইতিপূর্বেই সে জন্য অতি সুন্দর ক্ষেত্র প্রস্তুত কোরে রেখেছেন। তারা জাতির একটি অংশকে যা শেখাচ্ছিলেন তাতে জাতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে কিছু নেই, যা আছে তা ভুল। এবং প্রচুর পরিমাণে আছে ছোটখাটো খুঁটিনাটির অবিশ্বাস্য চুলচেরা বিশ্লেষণ, তাই নিয়ে বহুবিধ মতভেদ ও ঝগড়া। এই অধ্যয়নের ফলে তারা এটাও বুঝতে পারলো কেন এই জাতিটি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে পৃথিবীর শিক্ষকের আসন থেকে এতো অল্প সময়ের মধ্যে একটি অশিক্ষিত মুর্খ জাতিতে পর্যবসিত হোয়েছে। তারা আরও দেখলো যে, ঐ বিশ্লেষণকারী পণ্ডিতদের এবং সুফীদের শিক্ষার ফলে এই জাতির যে সামরিক শিক্ষা ও প্রেরণা ছিলো তা সম্পূর্ণভাবে চাপা পড়ে গেছে বা একেবারে বাদ পড়ে গেছে। সুতরাং ইউরোপীয়ান প্রভুরা এই দাস জাতির পণ্ডিতদের প্রস্তুত ক্ষেত্রের ওপরই এক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললো- এই শিক্ষায় জাতিটি আগের চেয়েও বেশী চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যাপৃত হয়, আরও ফেরকায় বিভক্ত হয়ে মারামারি করে, আরও অন্তুর্মুখী হয় এবং প্রভুরা আরও নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত হোয়ে প্রভুত্ব ও শোষণ কোরতে পারে। এই সময়ের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ কোরলে মনে হয় বিভিন্ন ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি একত্রে মিলিত হয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কারণ মরক্কো থেকে বোর্নিও পর্য্যন্ত প্রায় সম্পূর্ণ "মুসলিম(Muslim)" জগত অধিকার কোরেছিলো ইউরোপের ছোট বড় বিভিন্ন জাতিগুলি এবং সকলেই একই রকমের পদক্ষেপ নিয়েছিলো। সেটা হলো এই যে, প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ গোলাম জাতির মধ্যে দু'রকম শিক্ষা পদ্ধতি চালু করলো। একটা হলো তাদের নিজেদের যার যার দেশে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি। এটা চালু কোরতে তারা খানিকটা বাধ্যও হলো। কারণ তারা যে বিরাট ভূভাগ ও জনসংখ্যা অধিকার কোরেছিলো তা ভালভাবে শাসন কোরতে যে পরিমাণ মানুষ দরকার তাদের দেশগুলি থেকে অত মানুষ আনা কার্যত সম্ভব ছিলো না, দেশীয় লোকজনের সাহায্য অপরিহার্য ছিলো। তাছাড়া তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হোলে দেশে তাদের অনুগত একটি শ্রেণী সৃষ্টি হবে এ উদ্দেশ্যও ছিলো। তবে ঐ শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা ব্যাপারে বিদেশী প্রভূরা সর্বত্র সতর্ক থেকেছে যে, তাদের নিজেদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় যে নিজের জাতির প্রতি ভালবাসা, আনুগত্য ও বিশ্বস্থতা গড়ে ওঠে এদের বেলায় যেন তা না হয় বরং তারা যেন নিজেদের পরিচয় না পায়। তাদের অতীত ও বর্তমান সম্বন্ধে যেন অবজ্ঞা ও ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং প্রভুদের সম্বন্ধে যেন তারা হীনমন্যতায় ডুবে থাকে। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় তারা পাঠ্যবস্তু পাঠ্যক্রম (Curriculum) এমনভাবে তৈরী করলো যাতে এই জাতির ইতিহাসের বদলে ইউরোপের বিভিন্ন জাতিগুলির ইতিহাস স্থান পেলো। বিজ্ঞানের যে ভিত্তি মুসলিম(Muslim) জাতি স্থাপন কোরেছিলো, যে ভিত্তির ওপর পরে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জাতিগুলি যে উন্নতি কোরেছিলো তা লুপ্ত কোরে দিয়ে, মুসলিম(Muslim) আবিষ্কারকদের নাম বাদ দিয়ে নিজেদের নাম বসিয়ে তারা শিক্ষার্থীরের মনে বিশ্বাস জন্মিয়ে দিলো যে, জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রবর্তক, প্রচলক শুধু তারাই। প্রাচ্যের জাতিগুলির ধর্ম, বিশ্বাস, কুসংস্কার, মানুষগুলি পশু পর্য্যায়ের। সামরিক দিক দিয়ে তারা এই দাস জাতির ছাত্র-ছাত্রীদের শেখালো যে, হ্যানিবল, সিজার আর নেপোলিয়নের মত বিজয়ী সেনাপতি ইতিহাসে আর হয়নি। ছাত্র-ছাত্রীরাও তাই শিখলো ও বিশ্বাস করলো। তারা জানলোনা যে পৃথিবীর ইতিহাসে চির অপরাজিত অর্থাৎ জীবনে কোন যুদ্ধেই হারেননি এমন সেনাপতি হোয়ে গেছেন মাত্র পাঁচ জন, এবং এই পাঁচজনই প্রাচ্যের। এই পাঁচ জন হোচ্ছেন শেষ নবী মোহাম্মদ (দঃ) বিন আব্দুল্লাহ, আল্লাহ(Allah)র তলোয়ার খালেদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ), স্পেনের খলিফা আবদুর রহমান, সুলতান মাহমুদ এবং চেঙ্গিস খান। এবং এই পাঁচ জনের মধ্যে চারজনই মুসলিম(Muslim)। পাশ্চাত্যের কিছু কিছু ইতিহাসবিদ ওহোদের যুদ্ধে বিশ্বনবীকে (দঃ) পরাজিত বোলে দেখাতে চেষ্টা কোরেছেন তাদের চিরাচরিত অভ্যাস মোতাবেক তাঁকে ছোট করার জন্য। কিন্তু ঐ যুদ্ধে তার পরাজয় হয়নি। বিপর্যয় হোয়েছিলো, তিনি গুরুতর আহত হোয়েছিলেন, কিন্তু পরাজিত হননি। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম(Muslim)দের একটা শিক্ষা দেবার জন্যই আল্লাহ(Allah) ঐ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। সে শিক্ষা হলো এই যে, নেতার বা সেনাপতির আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন না কোরলে কি হয়। খুব বেশী বোললে ওহোদ যুদ্ধের ফলাফল কে সমান সমান অর্থাৎ অচলাবস্থা (Stalemate) বলা যায়। বদর, ওহোদ বা খন্দক; এর যে কোন একটি যুদ্ধেই যদি মহানবী (দঃ) পরাজিত হোতেন তবে ঐ খানেই ইসলামে(Islam)র সমাপ্তি ঘটতো। সসৈন্যে আলপস পর্বত অতিক্রম কোরেছিলেন বোলে নিপোলিয়ানকে অসম্ভব সম্ভবকারী মানুষ বোলে শেখানো হলো এবং এই দুর্ভাগ্য জাতির ছেলেমেয়েরা তাই শিখলো এবং বিশ্বাস করলো। তারা জানলোও না যে এর চেয়েও শতগুন অসম্ভব কাজ করেছিলেন তাদের জাতিরই একজন। ইস্থাম্ব ল জয় করার যুদ্ধে সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ তার সম্পূর্ণ নৌবহরকে পাহাড়ের উপর দিয়ে টেনে অতিক্রম করেছিলেন।

এই শিক্ষা ব্যবস্থায় এই দাস জাতির যুব সম্প্রদায়ের মন মানসিকতায় হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দিতে আরেক ব্যবস্থা নেওয়া হলো। সেটা হলো শিক্ষার মাধ্যম করা হলো বিভিন্ন বিজয়ী প্রভুদের ভাষা। একদা অর্দ্ধেক পৃথিবী বিজয়ী এই জাতিটাকে সামরিকভাবে পরাস্থ কোরে তাকে খণ্ড খণ্ড কোরে ভাগ কোরে নিয়ে ইউরোপীয়ান জাতিগুলি যার ভাগে যে ভাগ পড়েছিলো সে ভাগে নিজেদের ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করলো। হীনমন্যতায় আপ্লুত করা ছাড়াও আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো আরবী ভাষা থেকে এদের বিচ্ছিন্ন করা, কারণ গোলামে পরিণত হবার আগে সর্বত্র এই জাতির শিক্ষার মাধ্যম ছিলো আরবী, যার ফলে বহু ভাগে বিভক্ত হোয়ে গেলেও সবারই একটা সাধারণ ভাষা (Lingua Franca) হিসাবে আরবী একটা ঐক্যসূত্র হিসাবে কাজ কোরছিলো। ঐ ঐক্যসুত্র কেটে দেওয়াও ছিলো শিক্ষার মাধ্যম পরিবর্তন করার উদ্দেশ্য। কিন্তু নিজেদের ইউরোপীয়ান ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা কোরলেও প্রভুরা পাঠ্যবস্তু এমনভাবে নির্ধারণ করলো যাতে এরা পাশ্চাতের বিদ্যালয়গুলির শিক্ষার্থীদের মত প্রকৃত শিক্ষা না পায়, কিন্তু শুধু প্রভুদের পক্ষ হোয়ে তাদের প্রশাসন চালাতে সাহায্য কোরতে পারে। এটুকু করার জন্য যতটুকু অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান ও বিকৃত ইতিহাস শিক্ষা দরকার শুধু ততটুকুই করার ব্যবস্থা রইলো। এক কথায় ঐ শিক্ষায় সৃষ্টি হলো একটা কেরানীকুল, যারা মাঝারি ও নিম্ন পর্য্যায়ের ঔপনিবেশিক প্রশাসন চালিয়ে যেতে পারে। এই শিক্ষার মাধ্যমে সৃষ্টি ‘শিক্ষিত' শ্রেণীটাই ইউরোপীয়ান প্রভুদের পক্ষ হোয়ে অতি বিশ্বস্থভাবে প্রশাসন চালিয়েছে। এমন সতর্কতার সাথে এই শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালন করা হলো যে, এক পুরুষেরও কম সময়ে বিভিন্ন অধিকৃত দেশে একটি শ্রেণী সৃষ্টি হলো যারা লেখাপড়া জানে কিন্তু হীনমন্যতায় এমন পর্য্যাযে নেমে গেছে যে পাশ্চাত্য প্রভুরা লাথি মারলে নিজে কতখানি ব্যথা পেয়েছে সেটা বোধ করার আগে প্রভুর পায়ে আঘাত লাগলো কিনা সেই চিন্তা কোরেছে। এই শ্রেনীটি ইউরোপীয়ান প্রভুদের পক্ষ হোয়ে যার যার দেশে ঔপনেবেশিক শাসনের মধ্য ও নিম্ন পর্য্যায়ের প্রশাসন চালিয়েছে, কোথাও প্রভুদের বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান হোলে তাকে দমন কোরেছে, প্রভুদের আদেশে নিজেদের জাতির লোকের বুকে গুলী চালিয়েছে, তাদের জন্য নিজের জাতির বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি কোরেছে। এই শিক্ষিত শ্রেণীটি চলাফেরায়, কথা বার্তায়, পোশাক পরিচ্ছদে আপ্রাণ চেষ্টা কোরেছে তাদের প্রভুদের অনুকরণের। ঐ শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে এই দাস জাতির মধ্যেই একটা অংশ বিজাতীয় হোয়ে গজালো যাদের মন মগজে দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।

পাশ্চাত্য প্রভুরা গোলাম জাতিগুলোকে মানাসিকভাবে সত্যিকার বিশ্বস্থ দাস বানানোর পরও নিশ্চিত হলো না। কারণ জাতির অনেক বৃহত্তর অংশ তাদের ঐ শিক্ষার প্রভাবের বাইরে ছিলো। যখন সামরিকভাবে যুদ্ধে পরাজিত কোরে এই বিরাট জাতিটাকে তারা দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ কোরেছিল তখন এই জাতির মধ্যে হাজার হাজার বিদ্যালয়, বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও তাতে কোটি কোটি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করতো। ইসলামে(Islam)র প্রকৃত শিক্ষা সেখানে ছিলোনা সে কথা বলার অপেক্ষা করে না। কারণ তা থাকলে তো আর তাদের পাশ্চাত্যের দাসে পরিণত হোবার প্রশ্নই আসে না। ইসলামে(Islam)র পণ্ডিতদের কার্যেরফলে ঐ শিক্ষা বহু পূর্বেই এই দ্বীনের আদেশ নিষেধের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশ্লেষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো এবং ঐ বিদ্যালয় ও বিশ্বাবিদ্যালয়গুলিতে ঐ ক্ষতিকর বিষয়গুলিই শিক্ষা দেয়া হতো, যার ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের সুউচ্চ আসন থেকে জাতি এর আগেই মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু পাশ্চাত্য প্রভুরা নিশ্চিন্ত হোতে পারলোনা। দাস জাতির এই বৃহত্তর অংশ থেকে নিরাপদ হবার জন্য তারা যেসব পদক্ষেপ নিলো তা হোচ্ছে এই ক) প্রথমে তারা এই জাতির তখন বিদ্যমান বিদ্যালয়গুলি, যেগুলির নাম ছিলো মাদ্রাসা, তা ধ্বংস কোরে দিলো। এই ধ্বংস তারা করলো কয়েকটি উপায়ে, বেছে বেছে কতকগুলি বন্ধ কোরে দিলো, কতকগুলিকে সর্বরকম সাহায্য বন্ধ কোরে দিয়ে স্বাভাবিক মৃতু্যর মধ্যে ফেলে দিলো। বিভিন্ন ইউরোপীয়ান জাতিগুলি বিভিন্ন 'মুসলিম(Muslim)' দেশগুলিতে কেমন কোরে তাদের নিজস্ব ধারার শিক্ষা যা আরবীর মাধ্যমে ছিলো তা ধ্বংস কোরে দিয়েছিলো তার বিস্তৃত বিবরণে যেতে চাই না, কারণ বই বহু বড় হোয়ে যাবে। শুধু এইটুকু হোলেই আমাদের চলবে যে, কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি এই দাঁড়ালো যে, এই জাতির একটি ক্ষুদ্র অংশ পরিবর্তিত হোয়ে কালো এবং বাদামী ইউরোপীয়ানে পরিণত হল আর বাকি বৃহত্তর অংশ মুর্খ ও নিরক্ষর লোকসংখ্যায় পর্যবসিত হলো । খ) এতেও নিজেদের নিরাপদ মনে না কোরে পাশ্চাত্য প্রভুরা ঐ বৃহত্তর অংশ থেকেও নিরাপদ হবার জন্য অন্য পদক্ষেপ নিলো। সেটা হলো- সেই আরবী মাধ্যমে নতুন কোরে মাদ্রাসা শিক্ষা চালু করা। কিন্তু তফাৎ এই যে, এই শিক্ষা এমন হওয়া যে, এই জাতি যেন কখনও তার প্রকৃত স্বত্ত্বা খুঁজে না পায়। পেছনে বোলে এসেছি যে, এই কাজ করার জন্য অতি সুন্দর ভিত্তি আমাদের পণ্ডিতরা, ফকীহ ও মুফাস্সিররা তৈরী কোরে রেখেছিলেন। ঐ ভিত্তির ওপর পাশ্চাত্য প্রভুদের আরবী শিক্ষিত (Orientalists) পণ্ডিতরা এই নতুন মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচী ও পাঠ্যবস্তু নির্ধারণ কোরলেন। কোরলেন অতি সতর্কতার সাথে। অতি সতর্কতার সাথে এই দ্বীনের সামরিক দিকটা বাদ দেয়া হলো, জাতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মনে পড়তে পারে এমন সব কিছুকে ছেটে ফেলা হলো এবং অতি ছোট খাটো তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় ব্যাপার ও বিষয় দিয়ে নতুন পাঠ্যক্রম (Syllabus and Curriculum) তৈরী করা হলো। বিশেষভাবে স্থান দেয়া হলো অপ্রয়োজনীয় কিন্তু বিতর্কিত বিষয়গুলি। নামায, রোযা, হজ-যাকাতের ফারায়েজের, বিবি তালাকের, কাপড় চোপড়ের, দাড়ী টুপির অবিশ্বাস্য ও চুল চেরা বিশ্লেষণ ও বিতর্কিত বিষয়ের বিচার। উদ্দেশ্য হলো এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা যেন ঐ ছোটখাটো বিষয়বস্তুর মধ্যেই সীমিত থাকে, ওর উর্দ্ধে যেন উঠতে না পারে। ব্যক্তিগত এবাদতের সুক্ষ্মতম প্রক্রিয়াও এ পাঠ্যবস্তু থেকে বাদ গেলো না, কিন্তু জাতীয় ব্যাপারের মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে কোনঠাসা কোরে দেয়া হলো, সম্ভব হলে একেবারে বাদ দেয়া হলো।

এত কিছু কোরেও পাশ্চাত্য প্রভূরা নিশ্চিত হোতে পারলোনা। এই জাতির কাছ থেকে তারা কী প্রচণ্ড মার খেয়েছিলো তা তারা ভুলে যায়নি, তাদের ভয়ও যায়নি। তাই অতভাবে এই জাতিটাকে পদানত রাখার বন্দবস্তু কোরেও নিশ্চিত হোতে পারলোনা। এই যে নতুন ব্যবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষা তারা চালু করলো এর পরিচালনার ভারও তারা প্রথম দিকে নিজেদের হাতে রাখলো, শুধু পাঠ্যবস্তু নির্দ্ধারণ কোরে দিয়েই মুসলিম(Muslim)দের হাতে ছেড়ে দিলোনা।

মুসলিম(Muslim) বিশ্বের সর্বত্র তারা এই নীতি অবলম্বন করলো। আলজেরিয়া ও অন্যান্য উপনিবেশে ফ্রান্স; ট্রিপলী, লিবিয়া, ইটালী, মিশর, ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ; ইন্দোনিশীয়া, ইন্দোচীনে ওলন্দাজ (ডাচ) এক কথায় সর্বত্র ইউরোপীয় শক্তিগুলি এই জাতিটাকে অন্ধ কোরে রাখার মোটামুটি একই পদ্ধতি কার্যকর করলো। সবগুলির বিবরণে না যেয়ে শুধু এই দেশের উদাহরণ সত্যান্বেষী মনের জন্য যথেষ্ট হবে মনে করি। এই নতুন ব্যবস্থায় প্রথম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় কোলকাতায়, নাম আলীয়া মাদ্রাসা। প্রতিষ্ঠা করেন (১৭৮০) সনে বড় লাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস। এই আলীয়া মাদ্রাসার প্রথম অধ্যক্ষ (Principal) নিযুক্ত হন একজন বৃটিশ খ্রীস্টান, নাম ডঃ এ. স্প্রিঙ্গার এম. এ। তারপর একাদিক্রমে ২৭ জন খ্রীস্টান এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন কোরেছেন এবং তা করেছেন তারা ক্রমাগত ১৪৬ বছর (১৭৮০ থেকে ১৯২৬)। তারাই ছাত্রদের কি শিক্ষা দেওয়া হবে তা নির্দ্ধারণ কোরেছেন ও তা কার্যকর কোরেছেন। ঐ মাদ্রাসা থেকে যত আলেম, ফাজেল, কামেল ইত্যাদি বের হোয়ে জাতির অন্য লোকদের ইসলাম(Islam) শিখিয়েছেন তারা সবাই 'ইসলাম(Islam)' শিখেছেন খ্রীস্টান শিক্ষকদের কাছ থেকে। খ্রীস্টানরা কী 'ইসলাম(Islam)' শিখেয়েছেন তা অনুমান কোরতে বেগ পেতে হয়না। একটু আগেই তা বোলে এসেছি। কী নিদারুণ পরিহাস। একটা জাতির মধ্যে কতখানি বিকৃতি আসলে খ্রীস্টানদের কাছ থেকে ইসলাম(Islam) শিখে পাস কোরে বের হোয়ে এসে জোব্বা গায়ে দিয়ে, মাথায় পাগড়ী পড়ে, লম্বা দাড়ী ঝুলিয়ে বাকি অশিক্ষিত জাতির মধ্যে পৌরহিত্য কোরে সসম্মানে বাস করা যায়। এটা শুধু এদেশেই নয় 'মুসলিম(Muslim)' বিশ্বের সর্বত্র এইই ইতিহাস। যাই হোক, পাশ্চাত্য প্রভুরা এই মাদ্রাসাগুলির পরিচালনার ভার বহু বছর পর্য্যন্ত তাদের নিজেদের হাতেই রাখলো। তারপর যখন তারা নিশ্চিত হলো যে, আরবী ভাষার মাধ্যমে কোরান হাদীসের বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি কোরেই শিক্ষা দিয়ে এদের এমন পর্য্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হোয়েছে যে, অপ্রয়োজনীয়, বিতর্কিত মাসলা-মাসায়েলের জালে এরা এমনভাবে পেঁচিয়ে গেছে ও বাকি অশিক্ষিত জাতিকে পেঁচিয়ে ফেলেছে যে আর তাদের ওর মধ্য থেকে ছুটবার আশংকা নেই, তখন তারা ঐ মাদ্রাসা পরিচালনার ভার 'মুসলিম(Muslim)' দের হাতে ছেড়ে দিলো এবং দিলো ঐ মাদ্রাসা ব্যবস্থায় শিক্ষিতদের হাতেই। কলকাতার আলীয়া মাদ্রাসার মত বহু মাদ্রাসা খ্রীস্টান প্রভুরা বিরাট 'মুসলিম(Muslim)' বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা কোরে লক্ষ লক্ষ 'আলেম, ফাজেল, কামেল, ' ইত্যাদি তৈরী কোরে সমাজের মধ্যে ছেড়ে দেয়। নিরক্ষর মুর্খ জনসাধারণ তাদের কাছ থেকেই 'ইসলাম(Islam)' শেখে। প্রাথমিক ফকীহ, মুফাস্সিরদের দুর্ভাগ্যক্রমে দ্বীনুল কাইয়্যেমা ও সিরাতুল মুস্থাকীমের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন কোরতে ব্যর্থ হোয়ে অতি বিশ্লেষনে যেয়ে সর্বনাস কোরেছিলেন, কিন্তু তারা প্রকৃতপক্ষেই জ্ঞানী ও পণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু খ্রীস্টান পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে থেকে তাদের কাছ থেকে 'ইসলাম(Islam)' শিখে এবার যে আলেম, ফাজেল শ্রেণীটি বের হোয়ে এলো- এরা না ছিলো জ্ঞানী , না ছিলো পণ্ডিত। খ্রীস্টান শিক্ষকরা এদের যে শিক্ষা দিয়েছিলো তাতে জাতীয় জীবনের কিছুমাত্র ছিলোনা, ছিলো শুধু ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি মাসলা মাসায়েল এবং বিশেষ করে যেগুলো পূর্ববতর্ী মাযহাব ও ফেরকা সৃষ্টির কারণে বহুল বিতর্কিত। খ্রীস্টান শিক্ষকরা সতর্কতার সাথে ঐসব বিতর্কিত মাসলা মাসায়েলের মধ্যেই এদের শিক্ষা সীমিত রেখেছিলো এই উদ্দেশ্যে যে, এরা যেন ঐ বিতর্কিত মাসলা মাসায়েলের তর্কাতর্কি ও মারামারিতে জীবন কাটিয়ে দেয়, জনসাধারণও যেন ইসলাম(Islam) বোলতে ব্যক্তিগত জীবনের ঐ খুঁটিনাটি মাসলাকেই সম্পূর্ণ ইসলাম(Islam) মনে করে এবং পাশ্চাত্য প্রভুদের জন্য কোন দুশ্চিন্তার কারণ না হয়।

এই পরিকল্পনা ও তা বাস্থাবায়ন যে তাদের আশাতীত ফল দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজ পর্য্যন্ত মুসলিম(Muslim) বিশ্বে যে মাদ্রাসা ব্যবস্থায় শিক্ষা চালু আছে তা ঐ খ্রীস্টান প্রভুদের তৈরী করা; যা থেকে অতি ক্ষুদ্র মন মগজ ও প্রায়ান্ধ দৃষ্টি নিয়ে এক পুরোহিত শ্রেণী বের হয়ে আসছে, যারা স্বল্প বেতনে মসজিদের এমাম, মোয়াজ্জিন হওয়া, মুরদা দাফন করা, মিলাদ পড়ানো ছাড়া জাতীয় আর কোন কাজের উপযুক্ত নয় এটাও প্রভুদের পরিকল্পনা মোতাবেকই। কারণ ঐ মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তারা অন্য কোন এমন শিক্ষা (Vocaional) অন্তর্ভূক্ত করেনি, যাতে এরা উপার্জন কোরে খেতে পারে। উদ্দেশ্য হলো এরা যেন পুরোপুরি পুরোহিত শ্রেণীতে পরিণত হয় এবং ফলে জনসাধারণ আরও বেশী ঐ বিকৃত ব্যক্তিগত বিকর্কিত মাসলা মাসায়েল শিখে তা নিয়ে ব্যাপৃত থাকে ও শাসকরা আরও নিশ্চিন্ত হতে পারে।

কয়েক শতাব্দী ধোরে ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি এই তথাকথিত মুসলিম(Muslim) জগতের খণ্ড খণ্ড অংশগুলি শাসন ও শোষণ করার পর সময় এলো এদের চলে যাবার। মোটামুটি এই শতাব্দীর মাঝামাঝি ঐ খণ্ড খণ্ড অংশগুলিকে "স্বাধীনতা" দিয়ে ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি প্রাচ্য থেকে চলে গেলো। এই চলে যাবার কারণ প্রধানত এই নয় যে, এই দাস জাতি তার দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে, সে আবার নিজেকে চিনতে পেরেছে এবং নিজের হারানো স্থান ফিরে পেতে বিদ্রোহ কোরেছে। অবশ্য বিদ্রোহ দু এক জায়গায় যে হয় নি তা নয়, হোয়েছে কিন্তু তা ভৌগোলিক স্বাধীনতার জন্য। আসল কারণ হলো ইউরোপীয়ান রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোরে এমন ক্ষতিগ্রস্থ ও দুর্বল হোয়ে গিয়েছিলো যে, তাদের আর এশিয়া আফ্রিকাময় বিরাট উপনিবেশগুলিকে ধোরে রাখার মত শক্তি ছিলো না। কিন্তু ইচ্ছা কোরলে তারা ঐ দুর্বল শক্তি নিয়েও আরও কিছুকাল তাদের অধিকৃত দেশগুলিকে অধীন রাখতে পারতো। কিন্তু তা কোরতে গেলে তাদের যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন খুব ক্ষতিগ্রস্থ হতো। তাই তারা বুদ্ধিমানের মত ভাল সম্পর্ক বজায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে এই পরাধীন দাস জাতিগুলিকে আপাত স্বাধীনতা দিয়ে ইউরোপে ফিরে গেলো।

উপনিবেশগুলিকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেবার পর ইউরোপীয়ান প্রভুরা চিন্তা করলো ক্ষমতা কাদের হাতে ছেড়ে যাবে? অবশ্য সিন্ধান্ত নিতে বেশী কষ্ট হয়নি, কারণ ভবিষ্যতে কোন্ শ্রেণী তাদের দ্বারা প্রভাবিত হবে, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ কোরবে, এবং তাদের খুশী রাখতে চেষ্টা কোরবে তা অতি পরিষ্কার। কাজেই যাবার সময় তারা ক্ষমতা ছেড়ে গেলো ঐ শ্রেণীটির হাতে, যাদের তারা এতদিন তাদের ভাষার মাধ্যমে, তাদের তৈরী পাঠ্যবিষয়বস্তু শিক্ষা দিয়ে তাদের নিজ জাতির মন মানসিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোরে তাদের বিশ্বস্থ দাসে পরিণত কোরেছিলো। অবশ্য অন্য কোন শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা দেয়াও যেতোনা, কারণ ইউরোপীয়ান প্রভুদের সৃষ্ট 'ঐ শিক্ষিত' শ্রেণীটি বাইরে ছিলো আর দু'টি মাত্র শ্রেণী। সে দুটির একটি হলো তাদেরই মাদ্রাসায় 'শিক্ষিত' পুরোহিত শ্রেণী, অন্যটি নিরক্ষর ও অশিক্ষিত জনসাধারণ। পুরোহিত শ্রেণীটি মাসলা মাসায়েল ছাড়া আর কিছুই জানতোনা, রাষ্ট্র পরিচালনা তাদের পক্ষে অসম্ভব ছিলো, আর নিরক্ষর অশিক্ষিতদের হাতে শাসনভার দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা। কাজেই ক্ষমতা হাতে এলো কালো ফরাসী, বাদামী ইংরাজ, হলদে ওলন্দাজদের হাতে। আগেই বোলে এসেছি এরা প্রভুদের শিক্ষার গুণে চামড়ার রং বাদে আর সব দিক দিয়ে ইউরোপীয়ান। নিজেদের ইতিহাস, জীবন ব্যবস্থা (দ্বীন) সভ্যতা কৃষ্টি সব কিছু থেকেই এরা ছিলো বিচ্ছিন্ন- শুধু বিচ্ছিন্ন নয় বিরোধী, বিগত প্রভুদের সম্বন্ধে গভীর হীনমন্যতায় আপ্লুত। ক্ষমতাপ্রাপ্ত এই শ্রেণীর আশা আকাংখার সঙ্গে তাদের নিজ নিজ জাতির আশা আকংখার কোন মিল ছিলো না, এমন কি বহু ক্ষেত্রে ও বিষয়ে ছিলো বিরোধী। আন্দোলন ও সংগ্রামের ফল হিসাবে যে সব দেশে স্বাধীনতা এসেছে সেসব দেশে মুখ্যতঃ জনসাধারণের প্রচেষ্টার ফলেই এসেছে, কিন্তু ক্ষমতা এসেছে ঐ 'শিক্ষিত' শ্রেণীটির হাতে।

এই ক্ষমতার হাত পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী ফল এই হলো যে, নতুন শাসকরা এতদিন পর স্বাধীন হোয়ে তাদের জীবন ব্যবস্থা - যেটাকে বিদেশী প্রভুরা বিসর্জন দিয়েছিলো, সেটাকে আবার জাতীয় জীবনে পুনর্বাসন করলো না। তারা পূর্ব প্রভুদের চালু করা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দণ্ডবিধি এমনকি শিক্ষা ব্যবস্থা পর্য্যন্ত ঠিক যা ছিলো তাই রাখলো এবং তাদের নিজ নিজ জাতির জীবনে চাপালো। এই নতুন শাসক শ্রেণীর কাছে ইউরোপীয়ানদের সৃষ্ট ব্যবস্থার চেয়ে ভাল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন কানুন সম্ভব ছিলো না। আল্লাহ(Allah)র দেয়া আইন-কানুন তাদের কাছে চৌদ্দশ' বছরের পুরানো সুতরাং পরিত্যাজ্য। এই অপরিসীম হীনমন্যতার ফল এই হলো যে, জেলখানার দরজা খুলে দিয়ে পুলিশ চোলে গেলেও কয়েদীরা জেলখানাতেই বাস কোরতে লাগলো এবং জেল পুলিশ তাদের বেত মেরে, চাকুক মেরে, ঘাড় ধোরে যে কাজ কর্ম করাতো তারা নিজেরাই তা রুটিন মাফিক কোরতে থাকলো। শুধু তফাতের মধ্যে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে কিছু লোককে তারা নির্বাচিত করলো চলে যাওয়া পুলিশ প্রভুদের স্থান পুরণের জন্য। এই নতুন পুলিশ পূর্বতন পুলিশদের মতই বেত মারে, ঘাড় ধোরে তাদের আগের মতই দৈনন্দিন কাজ কর্ম করাতে থাকলো। তারা কয়েদীদের বোঝালো যে, আগের পুলিশ চোলে গেছে, আমরা স্বাধীন হোয়েছি, কিন্তু আমরা এখানেই থাকবো এবং যেভাবে এতদিন চোলেছি ওমনিই চোলবো; কারণ এটাই ভাল, এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর হোতে পারে না। সাধারণ অশিক্ষিত কয়েদীরা অধিকাংশই তাদের কথা বিশ্বাস করলো এই জন্য যে, তারা যখন স্বাধীন ছিলো সে সময়ের কথা তারা ততদিনে ভুলে গেছে। তাদের অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে তখন লজ্জাকর অজ্ঞতা। জেলখানার বাইরে যে আল্লাহ(Allah) উন্মুক্ত দুনিয়া রোয়েছে তা তাদের জানতে দেয়া হয়নি। আমরা এখনও আমাদের পূর্ব প্রভুদের জেলখানাতেই আছি- শুধু শারিরীকভাবে সেই পুলিশ নেই- তাদের ওয়ার্ডাররা (Warder) আছে, তারাই এখনও আমাদের নিয়ন্ত্রণ ও শাসন কোরছে। শুধু আশার কথা এই যে, বিদেশী পুলিশ থাকতেও ছিলো এবং এখনও কিছু কয়েদী আছে যাদের মন মগজ তারা জয় কোরতে পারেনি, যারা বিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম, জেহাদ কোরে যাচ্ছে আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন ব্যবস্থা আবার জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা কোরতে। এরা সংখ্যায় অল্প, বিচ্ছিন্ন তবু এরা মানসিকভাবে ঐ ওয়ার্ডারদের চাপানো খ্রীস্টান প্রভুদের তৈরী আইন-কানুন মেনে নেয়নি। এই নতুন স্বাধীন কিন্তু সেই জেলখানায় বসবাসকারী জাতিগুলির মধ্যে ওয়ার্ডারদের শ্রেণীর কয়েদীরা ছাড়াও লম্বা কুর্তাপরা পাগড়ীধারী কয়েদীরাও বহুসংখ্যক আছে, আর আছে বিরাট সংখ্যায় অজ্ঞ অশিক্ষিত প্রায় পশু পর্য্যায়ের কয়েদীরা। স্বাধীন হবার পর বিদেশী প্রভুদের ট্রেনিং প্রাপ্ত শিক্ষিত শ্রেণীটি যখন ক্ষমতা হাতে পেয়ে প্রভুদের তৈরী আইন-কানুন ইত্যাদি সব কিছু সমগ্রভাবে (Lock, Stock and Barrel) কয়েদীদের ওপর চাপালো তখন ঐ লম্বা কোর্তা, পাগড়ীধারী শ্রেণীটি যেটি নিজেদের অতি উৎকৃষ্ট মুসলিম(Muslim) ও উম্মতে মোহাম্মদী বোলে বিশ্বাস করে সেটিও বিচ্ছিন্ন ও মৃদু প্রতিবাদের বেশী কিছুই করলোনা। কারণ তারাও তাদের ইসলাম(Islam) শিখেছিলো সেই বিদেশী প্রভুদের কাছ থেকেই, যে ইসলামে(Islam) ব্যক্তিগত দৈনন্দিন-জীবনের মাসলা মাসায়েল ছাড়া আর কিছুই নেই। তাদের ইসলামে(Islam) একথা বলে না যে জাতীয় জীবনে আল্লাহ(Allah)র দেয়া আইন-কানুন ও দণ্ডবিধিকে বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন-কানুন ও দন্ডবিধি গ্রহণ কোরলে আল্লাহ(Allah)র সার্বভোমত্বই অস্বীকার করা- যা সরাসরি শেরক ও কুফর। তাছাড়া ঐ বহু প্রকারের মাযহাব ফেরকায় বিভক্তির জন্য তারা ঐক্যবদ্ধ হোয়ে দাঁড়িয়ে তাদের নিজস্ব জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করার দাবীও কোরতে পারেনি। ঐ দাবী কোরে আসছে ঐ অল্প সংখ্যক লোক, যাদের মন মগজ বিদেশী প্রভুরা ও পরে যাদের হাতে প্রভুরা ক্ষমতা ছেড়ে গেলো তারা জয় কোরতে পারেনি। কিন্তু তারা এখনও পর্যন্ত কৃতকার্য হোতে পারেনি। পারেনি তার কতকগুলি কারণ আছে। সংখ্যাল্পতা ছাড়াও তারা এখনও বিচ্ছিন্ন এবং ইসলাম(Islam) কী সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি- যাকে বলা হয় আকীদা, সেই আকীদার অভাব এবং ক্ষমতাসীন ওয়ার্ডারদের বিরোধীতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভিন্ন জেলখানায় অর্থাৎ বিভিন্ন দেশে ঐ ছোট্ট ছোট্ট দলগুলির আওয়াজ ক্রমশঃ উচ্চ হোচ্ছে এবং মরক্কো থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত এই বিরাট এলাকার প্রতি দেশে একটা স্পন্দন অনুভূত হোচ্ছে, যেটা বিগত বিদেশী প্রভূদের এবং তাদের প্রতিভূ দেশী ওয়ার্ডাদের শংকিত কোরে তুলছে।

1 টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

অনেক মূল্যবান বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম,,