বুধবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০১১

৮। ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্ম

মনে হয় এই খানে একটু থেমে প্রসঙ্গটা একটু বদলানো দরকার। কারণ এই জাতি সামরিকভাবে পরাস্ত হোয়ে (যা মোমেনদের পক্ষে সম্ভব নয়, যদি আল্লাহর(Allah) কথা সত্য হোয়ে থাকে) যাদের গোলামে পরিণত হলো তারা কারা এবং কেমন সে সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা দরকার। আল্লাহর(Allah) রসুলের (দঃ) দেয়া দায়িত্ব, সমস্ত পৃথিবীতে সংগ্রামের মাধ্যমে এই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার দায়িত্বকে ভুলে যাওয়া, আল্লাহ(Allah) ও তার রসুলের (দঃ) পুনঃ পুনঃ নিষেধ ও সতর্কবাণী সত্ত্বেও সেরাতুল মুস্তাকীম ত্যাগ কোরে দ্বীনের অতি বিশ্লেষণ কোরে অতি মুসলিম(Muslim) হোয়ে জাতিকে বহু মাযহাবে ও ফেরকায় বিভক্ত কোরে ঐক্য নষ্ট কোরে দুর্বল কোরে দেওয়ার, ভারসাম্যহীন, একপেশে, বিকৃত-সুফীবাদ শিক্ষা দিয়ে জাতিকে অন্তর্মুখী কোরে এর সংগ্রামী চরিত্র বিনষ্ট কোরে একটি অসাড়, নিষ্ক্রিয় জড় জনসংখ্যায় পরিণত কোরে দেওয়ার ভয়ঙ্কর শাস্তি হিসাবে যাদের ঘৃণিত ক্রীতদাসে পরিণত কোরে দুই শতাব্দী ধোরে তাদের জুতা লেহন করালেন, তাদের সম্বন্ধে না জানলে বর্তমানের সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়।

আল্লাহর(Allah) নবীদের (আঃ) প্রসঙ্গ বলার সময় বোলে এসেছি যে, তার সৃষ্ট প্রথম মানুষটি অর্থাৎ আদম (আঃ) থেকে শুরু কোরে মোহাম্মদ (দঃ) পর্য্যন্ত যুগে যুগে এবং প্রতি জনপদে আল্লাহ(Allah) নবী পাঠিয়ে মানুষকে জীবন-বিধান অর্থাৎ দ্বীন দান কোরেছেন। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, ঐ জীবন-বিধান অনুযায়ী চললে মানুষ সমষ্ঠিগত ও ব্যক্তিগতভাবে শান্তিতে থাকতে পারবে। তাই এর নাম তিনি দিয়েছেন ইসলাম(Islam) অর্থাৎ শান্তি। প্রথম থেকে শেষ পর্য্যন্ত এর নাম শান্তি, যে শান্তির পেছনে মানব জাতি সেই জন্ম থেকে আজ পর্য্যন্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছে, পাচ্ছে না। পাবে না, যে পর্য্যন্ত না নিজেদের মনগড়া ব্যবস্থা, বিধান ছেড়ে দিয়ে তার স্রষ্টার দেয়া বিধানকে গ্রহণ কোরবে। মোহাম্মদের (দঃ) আগে পর্য্যন্ত ঐ নবীরা (আঃ) তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা জাতির জন্য বিধান নিয়ে এসেছেন। নবীদের মধ্যে দু'টো পরিষ্কার ভাগ পাওয়া যায়। এই ভাগ বা শ্রেণীর মধ্যে একটা হলো যারা আইন-কানুন, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক বিধান ও দণ্ডবিধি নিয়ে এসেছেন। অবশ্য শুধু ঐগুলিই নয়, ঐ সঙ্গে আত্মার উন্নতির জন্য যে সব কর্ম-কাণ্ড দরকার তাও ঐ আইন-কানুনের সঙ্গেই থেকেছে-অর্থাৎ ভারসাম্যযুক্ত, যে ভারসাম্যের কথা আগে বোলে এসেছি। ঐ ভারসাম্য নষ্ট হোলেই গোটা ব্যবস্থাটাই বিকৃত হোয়ে যায়। যুগে যুগে মানুষ ঐ ভারসাম্য নষ্ট কোরে ফেলেছে, ফলে যে উদ্দেশ্যে দ্বীন আল্লাহ(Allah) পাঠিয়েছেন সেই উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হোয়ে গেছে। অর্থাৎ সমাজে শান্তি থাকেনি, শান্তির বদলে অশান্তি, সুবিচারের বদলে অবিচার জায়গা কোরে নিয়েছে। এই ভারসাম্য বিনষ্ট হোয়েছে উভয় ভাবেই-

ক) সমষ্টিগত ভাগটাকে অর্থাৎ আইন-কানুন, দণ্ডবিধির দিকটাকে অতি বিশ্লেষণ কোরে, চুলচেরাভাবে ঐ আদেশ-নিষেধগুলিকে পালন কোরতে শুরু কোরেছে কিন্তু আত্দার দিকটাকে এমনভাবে পরিত্যাগ কোরেছে যে ঐ আইন-কানুন পালন করা প্রাণহীন হোয়ে গেছে।

খ) সমষ্টিগত ভাগ অর্থাৎ আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধির ভাগটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে কোরে ব্যক্তিগতভাবে আত্মার উন্নতির ভাগটাকে পালন ও কঠিনভাবে অনুশীলন কোরতে শুরু কোরেছে এমনভাবে যে, মুষ্টিমেয় লোক আত্মার উন্নতি কোরে মহা সাধু-সন্যাসী হোয়ে গেলেও এবং তাদের অনুসারী কিছু লোক থাকলেও, সামগ্রিকভাবে জাতি বা সমাজে অপরাধ, অন্যায় বৃদ্ধি পেয়ে সেই অশান্তি, অবিচার আসন কোরে নিয়েছে। উভয় অবস্থাতেই শান্তি বিদায় নিয়েছে, উভয় অবস্থাতেই ভারসাম্য বিনষ্ট হোয়েছে। যে সমাজ বা জনপদে মানুষ দ্বীনের সমষ্টিগত আইন-কানুন, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও দণ্ডবিধি ইত্যাদিকে বিকৃত কোরে ফেলেছিলো বা কোন কারণে ধ্বংস বা নষ্ট হোয়ে গিয়েছিলো তাদের জন্য আল্লাহ(Allah) যে নবী বা রসুল পাঠিয়েছেন তারা আইন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন আর যে সমাজ আইনের আক্ষরিক অর্থ জীবনের প্রয়োগকেই যথার্থ ধর্ম পালন সাব্যস্ত কোরে আত্মার দিকটাকে পরিত্যাগ কোরেছে তাদের জন্য আল্লাহ(Allah) যে নবী পাঠিয়েছেন তারা মানুষের আত্মার উন্নতির ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন। তারা আইন-কানুন আনেননি কারণ ওটা পুর্ববর্তী নবীর সময় থেকেই ছিলো, নতুন আইনের প্রয়োজন ছিলো না। ঐ দুই শ্রেণীর নবীই এসেছেন নষ্ট ভারসাম্যকে আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য।

বিশ্বনবীর (দঃ) শ' পাঁচেক বছর আগে আল্লাহ(Allah) পাঠালেন ঈসাকে (আঃ) ইসরাইল অর্থাৎ ইহুদী জাতির মধ্যে। তখন ইহুদী জাতির অবস্থা কেমন ছিলো তা পর্যবেক্ষণ দরকার। এর আগে যার মাধ্যমে আল্লাহ(Allah) বনি ইসরাইলীদের জন্য ভারসাম্যযুক্ত দ্বীন, অর্থাৎ যার মধ্যে রাজনৈতিক, আর্থ-সমাজিক ব্যবস্থা, আইন-কানুন ও দণ্ডবিধি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তা পাঠিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন মুসা (আঃ)। মুসা (আঃ) চলে যাবার পর চিরাচরিতভাবে কিছু সময়ের মধ্যেই তার আনা দ্বীনে বিকৃতি এলো- ভারসাম্য বিনষ্ট কোরে ফেলা হলো। একটা পণ্ডিত, পুরোহিত শ্রেণী গজালো যাদের কাজই হলো ঐ দ্বীনের আইন-কানুনের অতি বিশ্লেষণ, চুলচেরা বিচার করা ও ফতোয়া দেয়া অর্থাৎ বাড়াবাড়ি। দ্বীনের আধ্যাত্মিক দিক, মানবিক দিকটা এদের ঐ আক্ষরিক বিচার-বিশ্লেষণের চাপে মারা গেল। মানুষকে এরা শিক্ষা দিলেন দৈনন্দিন জীবনে প্রতি পদক্ষেপে ঐ জীবন ব্যবস্থার আক্ষরিক অনুসরণ। পরবর্তীকালে শেষ জীবন ব্যবস্থাতে অর্থাৎ বর্তমান ইসলামেও ঠিক এই রকম বিকৃতি এসেছে। যাই হোক, ঐ বিকৃতি, ভারসাম্যহীনতাকে আবার সংস্কার কোরতে আল্লাহ(Allah) পাঠালেন তার নবী ঈসাকে (আঃ)। স্বভাবতঃই একে পাঠানো হলো তার পূর্ববর্তী সব নবীদের মত সীমিত কর্তব্য দিয়ে, অর্থাৎ শুধু ইহুদীদের জন্য। তার দায়িত্ব যে বনী ইসরাইলীদের বাইরে ছিলো না এবং সে সম্পর্কে তিনি যে সজাগ ছিলেন তা বাইবেল যিনি ভাল করে পড়বেন তার কাছেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঈসা (আঃ) যদি বনি ইসরাইলের বাইরের কোন মানুষকে তার দেখানো পথ অবলম্বন কোরতে বা তাকে অনুসরণ কোরতে আহ্বান কোরতেন তবে তা হতো সীমালংঘন ও অনধিকার চর্চা। কোন নবীর পক্ষে তা সম্ভব নয় এবং তার জীবনী সাক্ষী তিনি কখনও তা করেননি। ঈসাকে (আঃ) আল্লাহ(Allah) প্রেরিত বোলে স্বীকার কোরে নেওয়া বা তাকে অনুসরণ করাতো দূরের কথা একজন অ-ইহুদীর শুধু রোগ সারিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করা হোলে লোকটি বনি ইসরাইলী নয় বোলে তিনি অনেক ইতঃস্থত কোরেছিলেন (New Testament- Matt- 15:23)। তিনি নিজে ইহুদী ছিলেন, তার বাহাত্তর জন, মতান্তরে একশ' বিশজন সহচর ও অনুগামীর প্রত্যেকে ছিলেন ইহুদী এবং ঈসা (আঃ) তাকে স্বীকার করা বা তার অনুসরণের জন্য বনী ইসরাইল ছাড়া বাইরের কাউকে আহ্বান করেননি (পক্ষান্তরে শেষনবী মোহাম্মদের (দঃ) আরব ছাড়াও আফ্রিকান নিগ্রো, পারসিক, আফগান, রোমান এমন কি সম্ভবত ভারতীয় অনুসারী ছিলেন। এবং তিনি স্বয়ং পৃথিবীর বিভিন্ন শাসকদের শেষ ইসলাম(Islam) গ্রহণ কোরতে আমন্ত্রণ কোরেছিলেন তা ইতিহাস হোয়ে আছে)। তিনি দু'টো কথা পরিষ্কার কোরে ঘোষণা কোরেছেন- প্রথমতঃ তিনি বোললেন- আমি মুসার (আঃ) দ্বীনকে সত্য বোলে দৃঢ়ভাবে অনুমোদন, ও সত্যায়ন কোরছি। ঈসা (আঃ) এ কথা বোলেছিলেন এই জন্য যে, মুসার (আঃ) মাধ্যমে প্রেরিত বনী ইসরাইলীদের জন্য আইন-কানুন, নিয়ম, দণ্ডবিধি ইত্যাদি তখনও মোটামুটি অবিকৃত ছিলো। কাজেই ঈসার (আঃ) মাধ্যমে নতুন আইন-কানুন পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা হয়নি। মুসার (আঃ) দ্বীনের ঐ কাঠামো, অনুষ্ঠানগুলিকেই শুধু আসল জিনিষ মনে কোরে মাত্র সেগুলিকেই আকড়ে ধোরে সেগুলোর সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ কোরে আক্ষরিকভাবে প্রয়োগের অর্থহীনতা শোধরানোর জন্য আগমন হোয়েছিলো ঈসার (আঃ)। এই যে, পূর্ববর্তী দ্বীনগুলির সত্যায়ন এটা শেষ দ্বীনের কোরানেও অনেক স্থানে আছে (কোরান- সূরা আলে ইমরান ৩, সূরা আল আনয়াম ৯২)। যাই হোক, মুসার (আঃ) আইন ঠিক ছিলো বোলেই ঈসার মাধ্যমে নতুন আইন পাঠানো হয়নি। ভারসাম্য যথাস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য তার মাধ্যমে শুধু আধ্যাত্মিক দিকটার দিক নির্দেশনা এসেছিলো। এক লাখ, মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসুলদের মধ্যে আমরা মাত্র কয়েকজনের সম্বন্ধে কিছুটা জানি। এদের মধ্যে যাদের মাধ্যমে রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক দণ্ডবিধি ইত্যাদি ব্যবস্থা আল্লাহ(Allah) পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে পাই আদম (আঃ) নূহ (আঃ), (মনু), বিভিন্ন বেদ যাদের ওপর অবতীর্ণ হোয়েছিলো, মুসা (আঃ) ও মোহাম্মদ (দঃ)। আর আইন-কানুন বাদে শুধু আধ্যাত্মিক দিকটাকে পুনরুদ্ধার কোরে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য যারা এসছিলেন তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান হোলেন, বুদ্ধ, কৃষ্ণ, মহাবীর, ঈসা (আঃ) এরা কোনও আইন-কানুন আনেননি কারণ পূর্ববর্তী নবীর আনা আইন-কানুন ইত্যাদি অবিকৃত ছিলো। দ্বিতীয় কথা ঈসা (আঃ) যেটা তার জাতিকে বোললেন- সেটাতে বোললেন তিনি তার সীমিত দায়িত্বের কথা। বোললেন- আমি প্রেরিত হোয়েছি শুধুমাত্র বনী ইসরাইলের পথভ্রষ্ট মেষগুলিকে উদ্ধার কোরতে (New Testament- Matt- 10:6)। তার প্রধান বারো জন শিষ্যকে তিনি যখন প্রচার কাজে বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দিলেন তখন তাদের উপদেশ দিলেন-"তোমরা অন্য জাতিগুলির মধ্যে যেওনা এবং কোন সামারিয়ান শহর নগরে প্রবেশ কোরোনা। শুধু মাত্র ইসরাইলী বংশের পথভ্রষ্ট মেষগুলির কাছে যেতে থাকবে New Testament- Matt- 15:24)।

ঈসা (আঃ) যখন তার ওপর আল্লাহর(Allah) দেয়া দায়িত্ব পালনের অর্থাৎ বনী ইসরাইল জাতিকে ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনার প্রচার শুরু কোরলেন তখন সেই চিরাচরিত ব্যাপারের পুনরানুষ্ঠান আরম্ভ হলো, অর্থাৎ পূর্ববর্তী দ্বীনের, মুসার (আঃ) দ্বীনের ভারসাম্যহীন বিকৃতরূপের যারা ধারক-বাহক ছিলেন তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। সেই পুরানো কারণ-আত্মম্ভরিতা। কী! আমরা সারাজীবন এই বাইবেল চর্চা কোরলাম, এর প্রতি শব্দ নিয়ে কত অনুসন্ধান কোরে কত রকম ফতোয়া বের কোরলাম, আর এত সব কাজ কোরে আমরা কেউ রাব্বাই, কেউ সাদ্দুসাই ইত্যাদি হোয়েছি। আর নিরক্ষর সুতোর মিস্ত্রীর ছেলে আমাদের ধর্ম শেখাতে এসেছে। ঈসা (আঃ) তার নবুয়াত, প্রেরিতত্ব প্রমাণ কোরতে বহু চিহ্ন, মোজেজা দেখালেন, জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন, কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ্য কোরলেন, মাত্র পাঁচটি রুটি আর দুটো মাছ দিয়ে হাজার হাজার লোককে পেট ভরে খাওয়ালেন এবং শেষ পর্য্যন্ত দু'তিন দিনের মরা মানুষকে জীবিত কোরলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। ঐ পুরোহিত শ্রেণী ধর্মের ধারক-বাহক রাব্বাই সাদ্দুসাই শ্রেণী কিছুতেই তাকে স্বীকার কোরলো না এবং মাত্র কয়েকজন লোক ছাড়া আর কাউকেই ঈসাকে (আঃ) স্বীকার কোরতেও দিল না। এ ব্যাপারে পুরো লেখতে গেলে একটা পৃথক বই-ই হোয়ে যাবে। কাজেই এখানেই শেষ করার আগে শুধু একটা মাত্র উদাহরণ দেব, দেখাতে যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ঈসা (আঃ) কি ধরনের কাজ কোরেছিলেন। ইহুদী ধর্মের আইনগুলির অন্যতম প্রধান বিধান হলো সপ্তাহে একদিন, শনিবার, জাগতিক কোন কাজকর্ম না কোরে শুধু মাত্র ধর্ম-কর্ম করা এবং সিনাগগে যেয়ে উপাসনা করা। এর নাম স্যাবাথ (Sabbath)। এ আদেশ বাইবেলে (New Testament) আছে এবং এটা যে রাব্বাই, ফারিসী অর্থাৎ পুরোহিতরা তাদের মনগড়া নিয়ম বাইবেলে ঢুকিয়ে দেয়নি তার প্রমাণ- একথা পবিত্র কোরানেও আছে (কোরান- সূরা আরাফ ১৬৩, সূরা আন নহল ১২৪)। এখন বাইবেলে (New Testament) পাচ্ছি যে, ঈসা (আঃ) সিনাগগের দরজায় বোসে বছরের পর বছর ভিক্ষা কোরছে এমন একজন জন্মান্ধের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন এবং দিলেন ঐ সাবাথের দিনে, শনিবারে। ঐ জন্মান্ধটি তো সারা জীবনই ঐ সিনাগগের দরজায় বোসে ভিক্ষা কোরছিলেন। জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়াই বা অলৌকিক শক্তি (মোজেজা) দেখানই যদি তার একমাত্র উদ্দেশ্য হতো তবে ঈসা (আঃ) শনিবার ছাড়া অন্য যে কোনদিন কি তা কোরতে পারতেন না? পারতেন, কিন্তু তিনি বেছে বেছে ঐ স্যাবাথের দিনটাতেই ঐ কাজ কোরলেন- এ কথা বোঝাতে এবং জোর দিতে যে, মানবীয় কাজ, অন্যের উপকার ইত্যাদি ঐ স্যাবাথের অর্থাৎ আইনের দোহাই দিয়ে বাদ দেয়ার অর্থ হলো দ্বীনের, ধর্মের এক পা কেটে ফেলার সমান, ওটা আর তাহলে তখন চলনশীল থাকবে না, স্থবির হোয়ে যাবে। আসলে হোয়েও ছিলো তাই। যখন ঈসা (আঃ) এসেছিলেন তার আগেই ঐ স্ববিরত্বের কারণে বনি ইসরাইল, মুসার উম্মাহ, পৌত্তলিক রোমানদের গোলামে পরিণত হোয়েছিল। ঠিক যেমন পরবর্তীকালে একই কারণে শেষনবীর (দঃ) উম্মাহও খ্রীস্টান ইউরোপের গোলামে পরিণত হোয়োছিলো। স্যাবাথের দিনে জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ায় সেদিন রাব্বাই, ফারিসী, সাদ্দুসাইরা ধর ধর মার মার কোরে ছুটে এসেছিলো আল্লাহর(Allah) সত্য নবী ঈসার (আঃ) দিকে। বোলেছিলো- আমরা বোলেছিলাম না এই লোক ধর্মদ্রোহী? এই দ্যাখো! স্যাবাথের দিনের পবিত্রতা এ লোকটা নষ্ট করলো, আর এ বলে কি না সে আল্লাহর(Allah) নবী, মার ওকে। আজ যদি কেউ মসজিদে দাঁড়িয়ে সত্যিকার ইসলাম(Islam) কী তা বোলতে চেষ্টা করে তবে ঐ রাব্বাইদের হাতে ঈসার (আঃ) যে দশা হোয়েছিলো বর্ত্তমানের বিকৃত ইসলামের ধারক-বাহকদের হাতে তারও ঠিক ঐ দশা হবে।

তিন বছর অক্লান্ত চেষ্টা কোরে ঈসা (আঃ) ব্যর্থ হোলেন বনি ইসরাইলদের সত্য পথে আনতে। এইতিন বছরের প্রচেষ্টায় মাত্র ৭২ জন, মতান্তরে ১২০ জন ইহুদী তার ওপর বিশ্বাস, ঈমান আনলেন এবং তার দেখানো পথে চলতে শুরু কোরলেন। সংক্ষেপে বনি ইসরাইলের পণ্ডিতশ্রেণী, তাদের তখনকার প্রভু রোমানদের সাহায্য নিয়ে ঈসাকে (আঃ) যখন হত্যার চূড়ান্ত ব্যবস্থা করলো তখন আল্লাহ(Allah) তাকে সশরীরে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিলেন এবং তার যে শিষ্য তাকে রোমান ও পুরোহিতদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো তার দেহ ও চেহারা অবিকল ঈসার (আঃ) মত কোরে দিলেন এবং তারা তাকে ঈসা (আঃ) মনে কোরে তখনকার দিনে মৃত্যুদণ্ডের উপায় ক্রশে উঠিয়ে হত্যা কোরলো। ঈসা (আঃ) যে মাত্র ৭২ জন শিষ্য ছেড়ে গেলেন তারা প্রাণ ভয়ে নানা দিকে ছড়িয়ে ও লুকিয়ে গেলেন- কেউ কেউ একেবারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। গোপনে ব্যক্তিগতভাবে ঈসার (আঃ) শেখানো পথে চলা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় রইলো না। এর কিছুকাল পরে পল নামে একজন ইহুদী ঈসার ওপর বিশ্বাস আনলেন। ইনি সত্যই বিশ্বাস এনেছিলেন কিনা তা সন্দেহের বিষয়, কারণ তার পরবর্তী কাজ-কর্ম থেকে মনে হয় ঈসার (আঃ) শিষ্যদের মধ্যে ঢুকে তাদের সত্যপথ থেকে বিচ্যুত কোরে দেয়াই ছিলো তার উদ্দেশ্য। ঈসা (আঃ) খ্রীস্টান ধর্ম বোলে নতুন কোন ধর্ম প্রচার করার চেষ্টা কখনই করেননি বরং ইহুদীদের ধর্ম অর্থাৎ মুসার (আঃ) মাধ্যমে প্রেরিত জুডাই ধর্ম পুরোহিতদের হস্তক্ষেপের ফলে ভারসাম্য হারিয়ে যে বিকৃতির মধ্যে পতিত হোয়েছিলো, সেই বিকৃতি থেকে একে উদ্ধার কোরতে চেষ্টা কোরেছিলেন, ঠিক যেমন বুদ্ধ তদানিন্তন বৈদিক, সনাতন ধর্মের বিকৃতিকে শোধরাবার জন্য চেষ্টা কোরেছিলেন। পল ঈসার (আঃ) শিষ্যদের মধ্যে ঢুকে যে কয়টি পরিবর্তনের চেষ্টা কোরলেন তার মধ্যে একটি হোচ্ছে ঈসার (আঃ) শিক্ষাকে বনি ইসরালীদের মধ্যে সীমিত না রেখে একে অ-ইহুদীদের মধ্যে প্রচার করা। এই প্রস্তাবে ঈসার (আঃ) শিষ্যরা প্রথমে ভয়ানক ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ এটা সরাসরি তাদের শিক্ষকের শিক্ষার বিপরীত। কিন্তু পল তাদের মত বদলাতে সমর্থ হোলেন। বোধহয় কারণ এই ছিলো যে, শিষ্যরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বনি ইসরাইলীদের মধ্যে ঈসার (আঃ) শিক্ষা প্রচার অসম্ভব। যেখানে ঈসা (আঃ) নিজে ব্যর্থ হোয়ে গেছেন সেখানে শিষ্যরা যে হতাশ হবেন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বাইরে প্রচার না কোরলে ঐ শ'খানেক শিষ্যের পর পৃথিবীতে ঈসার (আঃ) শিক্ষা লুপ্ত হোয়ে যাবে, একে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে অ-ইহুদীদের মধ্যে প্রচার করা ছাড়া আর উপায় নেই। ভুললে চলবে না যে, ঈসা (আঃ) নিজে ছিলেন ইহুদী এবং জুডাই ধর্মের অনুসারী এবং তার শিষ্যরাও ছিলেন তাই, মতভেদ ছিলো শুধু আদর্শগত, আকীদাগত পুরোহিতদের সাথে। পল ঈসার (আঃ) ঘোর বিরোধী ও তাকে নির্য্যাতনকারীদের প্রথম সারির একজন ছিলেন একথা বড় কথা নয়। কারণ পৃথিবীতে বহু উদাহরণ আছে যেখানে ঘোর বিরোধী পরে দৃঢ় সমর্থক হোয়ে গেছেন। বড় কথা হলো এই যে, পল ঈসার (আঃ) সঙ্গে থেকে সরাসরি তার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেননি, কাজেই তার শিক্ষার প্রকৃত অর্থ, মর্ম তিনি পাননি। অথচ ঈসার (আঃ) পৃথিবী থেকে চলে যাবার পরে তিনিই তার শিক্ষার সবচেয়ে বড় প্রবক্তা হোয়ে দাঁড়ালেন এবং তিনি যে শিক্ষা প্রচার আরম্ভ কোরলেন তা ঈসার (আঃ) শিক্ষা থেকে বহু দূরে নয় শুধু, প্রধান প্রধান ব্যাপারে একেবারে বিপরীত। এই প্রচারের ফলে অ-ইহুদীদের মধ্যে অনেক লোক এই শিক্ষা গ্রহণ করলো এবং বেশ একটি জনসংখ্যা ঈসার (আঃ) ওপর বিশ্বাস এনে তার শিষ্যদের উপদেশ মত চলতে চেষ্টা কোরতে আরম্ভ করলো। তখন কিন্তু আর ঈসার (আঃ) শিক্ষা অবিকৃত নেই। পল তার সুবিধা ও ইচ্ছামত ঈসার (আঃ) শিক্ষাকে যোগ-বিয়োগ কোরে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছেন যে, তা আর তখন ইহুদীদের অর্থাৎ মুসার (আঃ) ধর্মও নয়, ঈসা(আঃ) মুসার (আঃ) ধর্মের বিকৃতি শুধরিয়ে সেটাকে যে ভারসাম্যে আনতে চেয়েছিলেন তাও নয়। পলের হাতে পড়ে তা এক নতুন ধর্মের রূপ নিয়েছে। বর্তমানে অনেক খ্রীস্টান ধর্ম সম্বন্ধীয় পণ্ডিত বোলছেন যে, আমরা আজ যে খ্রীস্ট ধর্ম দেখি এটাকে খ্রীস্ট ধর্ম (Christianity) না বোলে পলি ধর্ম (Paulinity) বলা উচিৎ। যাই হোক ঐ সব কারণে একে একটা নতুন নাম দেয়া দরকার হোয়ে পড়লো। মুসার (আঃ) ধর্ম অর্থাৎ জুডিয়, ইহুদী ধর্মের গলদ ও বিকৃতি সংস্কার কোরে সেটাকেই আবার পূর্ণ জীবন দেবার চেষ্টাকে মূল ইহুদী ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন কোরে একটা নতুন ধর্মই সৃষ্টি করা হলো। এই নতুন ধর্মের নাম দেয়া হলো খ্রীস্ট ধর্ম। এই যে নতুন নামে নতুন একটি ধর্ম চালু করা হলো, এটা কিন্তু ঈসার (আঃ) দেশে হলো না, কারণ ইহুদীরা ঈসাকে (আঃ) এবং তার শিক্ষাকে অস্বীকার কোরেছে ও তার অনুসারীদের দেশ থেকে বহিষ্কার কোরে দিয়েছে। প্যালেষ্টাইনে তখন ঈসার (আঃ) কোন অনুসারী নেই এবং থাকলেও তা গোপনে, বাইরে তারা ইহুদী। সুতরাং এই নতুন ধর্মের পত্তন করা প্যালেস্টাইনে নয়, জেরুযালেমে নয়, বাইরে এন্টিয়ক (Antioch) শহরে (New Testament- Acts- 11:26).

এই নতুন ধর্ম যখন ইউরোপে গৃহিত হলো এবং নানা কারণে প্রধান ধর্মে পরিণত হলো তখন এক বুনিয়াদী সমস্যা দেখা দিলো। সে সমস্যাটা হলো এই- এতদিন পর্য্যন্ত মানব সমাজ চালিত হোয়েছে ধর্ম দিয়ে এ কথা পেছনে বোলে এসেছি। সময়ে বিকৃত হোয়ে গেলেও মানব সমাজের আইন-কানুন সমস্ত কিছুই ধর্মের বিধান অনুসারে চলেছে। ওর বাইরে নিজে থেকে কোন জীবন-বিধান তৈরী কোরে নেয়া ছিলো কল্পনাতীত। ইউরোপের রাজারা খ্রীস্ট ধর্ম গ্রহণ করার পর প্রথানুযায়ী তাদের গোটা জীবনে ঐ ধর্ম চালু করার চেষ্টা কোরলেন। রোমে আসীন পোপ সমগ্র ইউরোপের জীবন-ব্যবস্থার পথ-নির্দেশ দিতে আরম্ভ কোরলেন। এইবার বাধলো গোলমাল। ঈসার (আঃ) শিক্ষা ছিলো শুধু আত্মার উন্নতির প্রক্রিয়া, কারণ মুসার (আঃ) ধর্মের আইন-কানুনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের পরিণতিতে ওটার মানবীয়, আধ্যাত্মিক দিক হারিয়ে গিয়েছিলো। ওটাকে উদ্ধার ও যথাস্থানে প্রতিষ্ঠা কোরে আবার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনাই ছিলো ঈসার (আঃ) দায়িত্ব ও কাজ। আইন-কানুন, দণ্ডবিধি মুসার (আঃ) ধর্মে স্বস্থানে ঠিক ছিলো। মুসার (আঃ) ধর্ম থেকে ঈসার (আঃ) ঐ আত্মার সংশোধনের শিক্ষার অংশটুকুকে কেটে আলাদা কোরে নিয়ে সেটাকে সামগ্রীক জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা অবশ্যই ব্যর্থ হলো। এই নতুন খ্রীস্টান ধর্মে স্বভাবতঃই কোন রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক দিক দর্শন ছিলো না, কোন দণ্ডবিধি ছিলো না। অথচ ওগুলো ছাড়া সমাজ পরিচালনা ও শাসন অসম্ভব। তবুও ঐ চেষ্টা করা হলো এবং কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেলো যে, এ অচল। প্রতি পদে ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক ব্যাপারে সংঘাত আরম্ভ হলো। এই সংঘাতের বিস্তৃত বিবরণে না যেয়ে শুধু এইটুকু বোললেই চলবে যে, এই সংঘাত এমন পর্য্যায়ে যেয়ে পৌঁছলো যে ইউরোপীয় নেতা, রাজাদের সামনে দুটো মাত্র পথ খোলা রইলো। হয় এই ধর্ম বা জীবন-ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ত্যাগ কোরতে হবে আর নইলে তাকে নির্বাসন দিতে হবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে, সেখান থেকে এটা জাতীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোন প্রভাব বিস্তার কোরতে না পারে। যেহেতু ধর্মকে মানুষের সার্বিক জীবন থেকে বিদায় দেয়া, এক কথায় সমস্ত ইউরোপের মানুষকে নাস্তিক বানিয়ে দেয়া অসম্ভব তাই শেষ পর্য্যন্ত ইউরোপ ঐ দ্বিতীয় পথটাকে গ্রহণ করলো এবং অষ্টম হেনরীর সময় ইংল্যাণ্ড প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজ অর্থাৎ খ্রীস্টান ধর্মকে মানুষের সার্বিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোরে ব্যক্তিগত জীবনে নির্বাসিত করা হলো। ইংল্যাণ্ডের পরে ক্রমে সমস্ত খ্রীস্টান জগত এই নীতি গ্রহণ ও প্রয়োগ করতে বাধ্য হলো। এরপর থেকে খ্রীস্টান জগতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, আইন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি এক কথায় জাতীয় জীবনে স্রষ্টার আর কোন কর্তৃত্ব রইলো না। জন্ম হলো "ধর্ম নিরপেক্ষতার"।

আপাতঃদৃষ্টিতে এই ঘটনাটাকে খুব বড় একটা কিছু মনে না হোলেও এ ছিলো মানুষের ইতিহাসের বৃহত্তম ঘটনাগুলির অন্যতম। এবং যেহেতু এটি এরূপ একটি ঘটনা তাই এর কিছুটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ইতিপূর্বে বোলে এসেছি যে মানুষের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ কোরে এসেছে নবীদের (আঃ) মাধ্যমে প্রেরিত আল্লাহর(Allah) দেয়া জীবন ব্যবস্থা। বিকৃতি এসেছে, ওগুলোকে এদিক ওদিক মোচড়িয়ে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, শ্রেণীর স্বার্থে ব্যবহার করা হোয়েছে (যে জন্য পরবর্তী প্রেরিতের আগমন প্রয়োজন হোয়েছে) কিন্তু সেই আল্লাহর(Allah) দেয়া ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি কোরেই মানুষের সামাজিক, অর্থনেতিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড পরিচালিত হোয়েছে। মানুষ নিজে থেকে নতুন কোন ব্যবস্থা সৃষ্টি কোরে তা জাতির জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করেনি। কোথাও কোন ক্ষুদ্র পরিসরে সে চেষ্টা কোরলেও তা গৃহীত হয়নি, অচিরেই তার মৃত্যু হোয়েছে। আল্লাহর(Allah) দেয়া জীবন-ব্যবস্থায় যে সব বিকৃতি মানুষ এনেছে তাও চালাতে হোয়েছে সেটাকে সেই আল্লারই দেয়া ব্যবস্থা বোলেই। কিন্তু ইহুদীদের ধর্মের এই আত্মার সংশোধনের চেষ্টার ব্যবস্থাকে একটি সম্পূর্ণ ধর্ম, জীবন-ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ কোরে তা প্রয়োগ কোরতে ব্যর্থ হোয়ে সেটাকে জাতীয় জীবন থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন কোরে এই প্রথমবারের মত মানুষ যে কাজটি করলো তার অর্থ হলোঃ

ক) সে ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনে নির্বাসন দেবার পর জাতীয় জীবনের যে শূন্যতা এলো (কারণ খ্রীস্টান ধর্মে জাতীয় জীবন পরিচালনার জন্য কোন আইন-কানুন ইত্যাদি কিছুই নেই) তা পূরণের ভার বাধ্য হোয়ে নিজেদের হাতে নিতে হলো। এই কাজ কোরে সে জাতীয় সার্বভৌমত্ব আল্লাহর(Allah) হাত থেকে নিয়ে বিভিন্ন রাজাদের হাতে সমর্পণ করলো। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর(Allah) হাত থেকে এই প্রথম মানুষের হাতে এলো। এই জন্যই এই কাজ মানুষের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার একটি।

খ) এই পদক্ষেপ নেবার ফলে স্বভাবতঃই ব্যক্তি জীবনের বাইরে অর্থাৎ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ইত্যাদি কোন কিছুতেই আর ন্যায় ও অন্যায়ের কোন সর্বস্বীকৃত মানদণ্ড রোইলোনা। এর আগে পর্য্যন্ত জাতীয় জীবনে ঠিক-অঠিক, ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড ছিলো ধর্ম। প্রতিটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা হতো ধর্মের সরাসরি নির্দেশে বা তার নীতির ওপর ভিত্তি কোরে। অর্থাৎ স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব। এ ব্যবস্থা ব্যক্তি জীবনে নির্বাসন দেবার পর সমস্যা হলো মানদণ্ড নিয়ে। কারণ কোন মানদণ্ড ছাড়া, কোন সিদ্ধান্ত নিরূপক কর্তৃত্ব ছাড়া কোন ব্যবস্থা অসম্ভব। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে, তার পরিণতি চরম বিশৃংখলা ছাড়া আর কিছুই হোতে পারেনা। সুতরাং মানদণ্ড একটি তৈরী কোরতেই হতো এবং করাও হলো। ইউরোপ তখন খণ্ড খণ্ড রাষ্ট্রে বা রাজত্বে বিভক্ত ছিলো এবং প্রত্যেকটি শাসিত হোচ্ছিল রাজাদের দিয়ে। এদের খ্রীস্টধর্ম গ্রহণ করার পর থেকে মানদণ্ড ছিলো আংশিকভাবে ধর্ম। এরপর ধর্মকে ব্যক্তিগত জীবনে সীমিত করার পর জাতীয় জীবনে মানদণ্ড হোয়ে দাঁড়ালো রাজাদের ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত; ব্যক্তিগত জীবনে পোপ।

এটি হলো ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির (Nation States) ওপর "ধর্ম নিরপেক্ষতার" ফল। দ্বিতীয় আরেকটি ফল হলো আন্তঃরাষ্ট্রীয় (Inter States) অর্থাৎ ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলির নিজেদের মধ্যে সমস্যার ব্যাপারে। যেহেতু প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের স্বার্থ বিভিন্ন এবং ফলে সংঘাতমুখী এবং ধর্মীয় মানদণ্ড অনুপস্থিত সেহেতু স্বভাবতঃই এই রাষ্ট্রগুলির জাতীয় মানদণ্ড হোয়ে দাঁড়ালো যার যার রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। এখন থেকে এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবীয় কোন অনুভূতি, ন্যায়-অন্যায়ের কোন প্রভাব কিছুই রইলো না এবং আজ পর্য্যন্তও নেই। পরবর্তী কালে এই বিভিন্ন খ্রীস্টান রাষ্ট্র মুসলিম(Muslim) জগতসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ সামরিক শক্তিতে অধিকার কোরে তাদের ঐ "ধর্মনিরপেক্ষতা" শিক্ষা দেবার ফলে আজ পৃথিবীময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের মানদণ্ডও ঐ একটি - যার যার রাষ্ট্রের স্বার্থ। অন্য কোন মানবীয় অনুভূতির সেখানে কোন স্থান নেই। সুতরাং পৃথিবীতে শান্তি অসম্ভব। ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করার আরও একটি সুদূর প্রসারী ফল দেখা দিলো। এর আগে রাজতন্ত্রকে ধর্মীয় অনুশাসন আংশিকভাবে হোলেও নিয়ন্ত্রণ করতো। ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করার পর ঐ নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতির কারণে রাজারা ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হোয়ে উঠলেন এবং এটা বেড়ে যেয়ে এমন অবস্থা হোয়ে উঠলো যে, দেখা গেলো যে একে আর চলতে দেয়া যায় না। কারণ রাজতন্ত্র ধর্মহীন হোয়ে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হোয়েছে। এরপর এক এক কোরে রাজতন্ত্র ধ্বসে পড়তে আরম্ভ করলো এবং সে সব স্থানে স্থান কোরে নিলো বিভিন্ন মতবাদ। কোথাও গণতন্ত্র, কোথাও সমাজতন্ত্র, কোথাও সাম্যবাদ, কোথাও একনায়কত্ব ইত্যাদি। দু'চারটি স্থানে রাজতন্ত্র টিকে থাকলেও কোননা কোন তন্ত্র বা বাদ তাদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ঠুটো জগন্নাথে পরিণত করলো।

এরপর অর্থাৎ রাজতন্ত্রের পতনের পর এলো আরেক পরিবর্তন। সেটা এই যে, 'ধর্মনিরপেক্ষতা' সৃষ্টি কোরে সাবভৌমত্ব আল্লাহর(Allah) হাত থেকে নিয়ে রাজাদের হাতে দেয়া হোয়োছিলো, এবার তাদের হাত থেকে নিয়ে যেখানে একনায়কত্ব চালু হলো সেখানে একনায়কের (Dictator) হাতে, যেখানে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ (Communism) চালু হলো সেখানে সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণীর হাতে, যেখানে গণতন্ত্র চালু হলো সেখানে জনগণের হাতে দেয়া হলো। মানব জাতির ইতিহাসে এই প্রথম আল্লাহর(Allah) সাবভৌমত্বকে অস্বীকার কোরে মানুষ তার জাতীয় জীবন-ব্যবস্থা, দ্বীন, নিজেই তৈরী কোরে নেবার দায়িত্ব গ্রহণ করলো। এই জন্য এই ঘটনাকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বোলে অভিহিত কোরেছি যা মানুষের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে কেটে ব্যক্তিগত জীবনে আবদ্ধ কোরে রাখার ফল হয়তো এ আশা করা যেতো যে জাতীয় জীবনে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড না থাকায় সেখানে যত অন্যায়ই হোক ধর্মের প্রভাবে ব্যক্তি জীবনে মানুষ ন্যায়পরায়ন ও মানবিক মূল্যবোধ পূর্ণ থাকবে। কিন্তু তাও হয়নি। কারণ মানুষের শিক্ষা ব্যবস্থার ভার রইলো ঐ ধর্মনিরপেক্ষ অর্থাৎ ধর্মহীন, ন্যায়-অন্যায় বোধহীন জাতীয় ভাগটার হাতে। সুতরাং অনিবার্য ফল স্বরূপ ব্যক্তিগত জীবন থেকেও ধর্মের প্রভাব আস্তে আস্তে লুপ্ত হোয়ে যেতে শুরু কোরলো। স্রষ্টার দেয়া জীবন-বিধানে যে দেহ ও আত্মার ভারসাম্য ছিলো তার অভাবে ঐ শিক্ষা ব্যবস্থায় যে মানুষ সৃষ্টি হোতে লাগলো তাদের শুধু একটি দিকেরই পরিচয় লাভ হলো- দেহের দিক, জড়, স্থূল দিক, স্বার্থের দিক, ভোগের দিক। জীবনের অন্য দিকটার সাথে তাদের পরিচয় বিলুপ্ত হোয়ে গেছে। অর্থাৎ 'ধর্মনিরপেক্ষতা' সৃষ্টি কোরে তা জাতীয় জীবনে প্রয়োগ করার ফলে শুধু জাতীয় জীবনই অন্যায়-অত্যাচার, অশান্তি ও রক্তপাতে পূর্ণ হয়ে যায়নি, যেখানে ধর্মকে টিকে থাকার অধিকার দেয়া হোয়েছিলো অর্থাৎ ব্যক্তি জীবনে, সেখানেও অধিকাংশ মানুষের জীবন থেকে ধর্ম বিদায় নিয়েছে, নিতে বাধ্য হোয়েছে।

যে সময়টার কথা বোলছি তখন শেষ নবীর (দঃ) উম্মাহর অবস্থা কি রকম তা মনে রাখা দরকার। নবী (দঃ) তার উম্মাহর ওপর যে কর্তব্যের দায়িত্ব অর্পণ কোরে চলে গিয়েছিলেন যে কর্তব্যের কথা মনে রেখে তা সম্পন্ন করার সংগ্রাম ষাট-সত্তর বছর পর্য্যন্ত চালিয়ে যাবার পর, পৃথিবীর একটা বিরাট অংশের ওপর আল্লাহর(Allah) দেয়া জীবন-ব্যবস্থা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা কোরে সেখানে শান্তি স্থাপন করার পর হঠাৎ তারা ভুলে গেলেন তাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী? তখন যদি তারা উদ্দেশ্য ভুলে না যেতেন, সংগ্রাম চালিয়ে যেতেন তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাকি পৃথিবীও এই জীবন-বিধানের মধ্যে চলে আসতো ও সমস্ত পৃথিবীতে সুবিচার, ন্যায় ও শান্তি (ইসলাম(Islam)) প্রতিষ্ঠিত হতো, মোহাম্মদের (দঃ) ওপর আল্লাহর(Allah) দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ হতো, তার রাহমাতুল্লীল আলামীন উপাধি অর্থবহ ও সার্থক হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ইতিহাস এই যে তা হয়নি। উদ্দেশ্য তারা ভুলে গিয়েছিলেন এবং সংগ্রাম, নবীর (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ, তারা ত্যাগ কোরেছিলেন এবং পৃথিবীর অন্যান্য রাজা-বাদশা, সম্রাটদের মত রাজত্ব কোরতে শুরু কোরেছিলেন। আল্লাহ(Allah) যে এ অপরাধের ক্ষমা করেননি তা পরবর্তী ইতিহাস। কিন্তু সর্বপ্রধান কর্তব্য ভুলে গেলেও তারা তাদের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে যথাসাধ্য কোরান ও নবীর (দঃ) অন্যান্য সুন্নাহ মোতাবেক চালাতে চেষ্টা করতেন এবং ওর ফল হিসাবে জীবনের নানা দিকে সমৃদ্ধ হোয়ে উঠেছিলেন। ঐ প্রক্রিয়ায় আল্লাহ(Allah) ও নবীর (দঃ) নির্দেশে তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণে নিজেদের নিয়োজিত কোরেছিলেন এবং ফলে জ্ঞানে সর্বপ্রকার শাখায় তারা বিপুল উন্নতি কোরেছিলেন এবং এত উন্নতি কোরেছিলেন যে, পৃথিবীর শিক্ষকের আসন দখল কোরে নিয়েছিলেন। তখন ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যান্য জায়গা থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা আসতো এই উম্মাহর বিদ্যালয়গুলিতে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য। ইউরোপীয়ানরা এদের কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিক্ষা কোরে দেশে ফিরে যেয়ে সেগুলোর চর্চা কোরে উন্নত হোতে আরম্ভ কোরলো আর এদিকে এই উম্মাহর ধর্মীয় পণ্ডিতরা ফকিহ, মুফাসসির, মুহাদ্দিসরা এই জীবন-বিধানটার বিভিন্ন আদেশ-নিষেধগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ কোরে জাতিটাকে বহু মাযহাবে (দলে) ফেরকায় বিভক্ত কোরে শুধু যে এর ঐক্য বিনষ্ট কোরে দুর্বল কোরে দিলেন তাই নয়, সবচেয়ে মারাত্মক, সর্বনাশা মতবাদ প্রচার কোরলেন এই যে, 'ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়া অন্য কোন জ্ঞান অর্জন আবশ্যকীয় নয়, ফরদ নয়। সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অতি বিশ্লেষণের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে তাদের দৃষ্টি এত অন্ধ হোয়ে গিয়েছিলো যে, 'ধর্মীয়' বোলতে যে কোরান-হাদীস বোঝায় সেই কোরান-হাদীসেই সর্বরকম জ্ঞানকেই- জ্ঞান বোঝান হয়েছে এবং কোরান-হাদীস নিয়ে অতি বিশ্লেষণ মতান্তর, তর্কাতর্কি, বাহাসকে শুধু নিষেধ নয় একেবারে কুফরী বলা হয়েছে তা তারা দেখতে পাননি (হাদীস- আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে মুসলিম(Muslim), মেশকাত)। উম্মাহর সর্বনাশের যেটুকু বাকি ছিলো, এই মতবাদে সেটুকু সম্পূর্ণ হোয়ে গেলো- অল্প দিনের মধ্যে পৃথিবীর শিক্ষক জাতিটি পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানহীন ও আরও কিছু পরে একেবারে নিরক্ষরে পর্যবর্সিত হলো।

ওদিকে ইউরোপ বোসে ছিলো না। তারা এই উম্মাহর কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান যেটুকু শিক্ষা কোরেছিলো তার চর্চা কোরে বহু উর্দ্ধে উঠে গেলো, অনেক প্রগতি করলো এবং খ্রীস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই দেখা গেলো যে ইউরোপীয়ান জাতিগুলি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পৃথিবীতে উচ্চমত স্থান অধিকার কোরে নিয়েছে এবং যে জাতিকে স্বয়ং আল্লাহ(Allah) একদা 'সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি' (কোরান- সূরা আলে ইমরান ১১০) বোলে অভিহিত কোরেছিলেন সেটা জ্ঞানহীন, শক্তিহীন, মুর্খ, নিরক্ষর একটি জনসংখ্যা- যার লেখাপড়া জানা শ্রেণীটি কোরান-হাদীসের খুঁটিনাটি ব্যাপারে নিয়ে ঝগড়াঝাটি, মারামারি কোরছে কিন্তু পৃথিবীর অন্য সব রকম জ্ঞান সম্বন্ধে জ্ঞানহীন, অন্ধ। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, ইউরোপ এই উম্মাহর কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা কোরে নিজেরা যে উন্নতি করলো সে উন্নতিটা হলো ভারসাম্যহীন, শুধু একটি দিক, দেহের দিক, জড়ের দিক। কারণ ধর্মের সর্বরকম প্রভাব থেকে তারা জাতীয় জীবনকে আলাদা কোরে ফেলেছিলো, এবং ব্যক্তিগত-মানবীয় মূল্যবোধ ও অত্যন্ত হ্রাস পেয়েছিলো। তাই পরবর্তীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনুসন্ধান ও গবেষণা কোরে আণবিক বোমা তৈরী কোরলো এবং সেই বোমা মেরে নাগাসাকি ও হিরোশিমার কয়েক লক্ষ মেয়ে, পুরুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা ও শিশু হত্যা কোরতে শান্তির রাজা (Prince of Pcace) যিশু খৃষ্টের অনুসারীদের বিবেকের কোন দংশন অনুভব হয়নি। আল্লাহর(Allah) দেয়া জীবন-ব্যবস্থার ভারসাম্য যদি বিসর্জন না দেয়া হতো, সেই জীবন-ব্যবস্থা জাতীয় জীবন থেকে কেটে আলাদা না করা হতো তবে আণবিক বোমা তৈরী করা হোলেও তারা ঐ ব্যবহার বন্ধ কোরে দিতো। উদাহরণ স্বরূপ- শেষ ইসলামে শুধু সশস্ত্র সত্য বিরোধীদের ছাড়া আর কাউকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শুধু যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, নিরস্ত্র নর-নারী, শিশু হত্যা নিষিদ্ধ তাই নয়, সত্য বিরোধীদের পশু, এমনকি যে গাছগুলি ফল দেয় তা পর্য্যন্ত কাটা নিষিদ্ধ। ঐ নির্দেশ যিনি এই জীবন-ব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছুও জানেন তাকে বোলতে হবে না। প্রতিটি সামরিক অভিযানের আগে মহানবী (দঃ) থেকে শুরু করে প্রতিটি নেতা তাদের সেনাপতিদের ঐ কথাগুলো মনে করিয়ে দিতেন। এই উম্মাহর হাতে আণবিক অস্ত্র থাকলেও তা শুধুমাত্র যুদ্ধরত শত্রু ছাড়া আর কারো ওপর প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারতো না। এই হোচ্ছে জীবনের দুই দিকের নিয়ন্ত্রণ, ভারসাম্য। যে সম্বন্ধে আল্লাহ(Allah) বোলছেন- আমি তোমাদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ (কোরান- সূরা আল বাকারা ১৪৩) জাতি বানালাম।

তা হোলে এখন আমরা একটা পরিষ্কার ধারণা পাচ্ছি যে কি ধরনের, কি রকম জাতিগুলি সামরিকভাবে উম্মাহকে পরাজিত কোরে তাকে কয়েকশ' বছরের জন্য ঘৃণিত গোলামীতে শৃংখলাবদ্ধ করলো। ইউরোপের এই বিভিন্ন জাতিগুলির আইন-কানুন, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক দণ্ডবিধি ইত্যাদি সব কিছুই ছিলো তাদের নিজেদের তৈরী- তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত। সুতরাং এক রাষ্ট্রের আইন-কানুনের সাথে অন্য রাষ্ট্রের আইন-কানুন সম্পূর্ণ মিল ছিলো না, আজও নেই। আর ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি সবাইর ছিলো একটিমাত্র- রাষ্ট্রের স্বার্থ। এবং আজও তাই আছে। ধর্মকে তারা ব্যক্তিজীবনে একঘরে কোরে দিলেও প্রাচ্যের দেশগুলি জয় করার পর সেখানে খ্রীস্টধর্ম প্রচার কাজে তারা চার্চ, পাদরী ও মিশনারীদের উৎসাহ ও সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে। 'ধর্মনিরপেক্ষরা' (Secular) এ ব্যাপারে ধর্মকে পুরোভাবে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিলো প্রাচ্যের এই দেশগুলিতে যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষিত হোলে তাদের প্রভাব আরও ফলপ্রসূ হবে, মুষ্ঠি আরও দৃঢ় হবে, অধিকার আরও স্থায়ী হবে। জাতীয় জীবনে মানুষের তৈরী জীবন-ব্যবস্থায় বিশ্বাসী অর্থাৎ মোশরেক ইউরোপীয়ান রাষ্ট্রগুলির গোলামে পরিণত হবার পর এই উম্মাহর মধ্যে তারা তাদের ব্যবস্থা প্রবর্তন করলো। তারা আল্লাহর(Allah) সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান কোরে মানুষের সার্বভৌমত্বের যে শিক্ষা দিলো তা এই হতভাগ্য জাতি গ্রহণ কোরে মোশরেক ও কাফের হোয়ে গেলো। কিন্তু মোশরেক, কাফের হোয়েও মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বোলে এবং ব্যক্তি জীবনে খুব নামায, রোযা, ইত্যাদি কোরে নিজেদের খুব ভালো মুসলিম(Muslim) মনে কোরতে থাকলো।

কোন মন্তব্য নেই: