বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১১

১৬। মো'মেন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী

উৎস: Islam and Dajjal
বর্তমান সময়ে চালু ইসলামে ‘মো'মেন', ‘মুসলিম(Muslim)' ও ‘উম্মতে মোহাম্মদী'এই তিনটিকে একার্থবোধক অর্থাৎ তিনটিই একই জিনিস হিসাবে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তিনটিই আলাদা, যদিও পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আকীদা সঠিক করার জন্য এই তফাৎ বুঝে নেওয়া দরকার।

প্রথমতঃ মো'মেন শব্দটা এসেছে ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস থেকে। যে বা যারা আল্লাহ্, রসুল, কোরান, মালায়েক (ফেরেশতা) শেষ বিচার, জান্নাত, জাহান্নাম, এক কথায় আল্লাহ(Allah) কোরানে যা বোলেছেন, এবং রসুল (দঃ) হাদীসে যা বোলেছেন তা সব নিঃসন্দেহে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন, সেসব লোক মো'মেন। কিন্তু মো'মেন হওয়া মানেই মুসলিম(Muslim) হওয়া নয়। কারণ কোন লোক সব কিছু বিশ্বাস কোরেও, সত্য জেনেও আল্লাহ(Allah)র দেওয়া জীবন ব্যবস্থাকে জাতীয়, সামাজিক জীবনে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা নাও কোরতে পারেন। বিশ্বাস কোরেও প্রয়োগ না করার কারণ অনেক কিছু হোতে পারে। যেমন-বিকৃত আকীদা, হীনমন্যতা, পাশ্চাত্য জগত সেকেলে ভাববে- আধুনিক জগতে এটার আইন অচল ইত্যাদি ধারনা(আকীদা)। এই সব লোক ব্যক্তিগতভাবে মো'মেন হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম(Muslim) নন, উম্মতে মোহাম্মদীও নন। আল্লাহ(Allah) ধোরে নিচ্ছেন যে- যে আমাকে ও আমার কথা বিশ্বাসই করলো সে স্বভাবতঃই পৃথিবীর অন্য সমস্ত কিছু অস্বীকার কোরে আমার দেওয়া দ্বীন তার পূর্ণ জীবনে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা কোরবে। কাজেই তিনি কোরানে বহু জায়গায় মো'মেনদের ক্ষমা, দয়া ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু হীনমন্যতায় বা আকীদা বিকৃতির জন্য যারা ‘দ্বীন' জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা কোরবেনা তাদের তিনি ঈমান থাকা সত্ত্বেও মো'মেন বোলে স্বীকার কোরবেন না। তারা মুসলিম(Muslim)ও নয়, উম্মতে মোহম্মদী তো নয়ই। উদাহরণ বর্তমানে ‘মুসলিম(Muslim)' বোলে পরিচিত জনসংখ্যাটি।

দ্বিতীয়তঃ মুসলিম(Muslim) শব্দ এসেছে সালাম থেকে। যিনি বা যারা আল্লাহ(Allah)র দেওয়া জীবন ব্যবস্থা, দ্বীনকে সামগ্রীকভাবে তসলিম অর্থাৎ সসম্মানে গ্রহণ কোরে তা জাতীয়, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা কোরেছেন, অন্যসব রকম ব্যবস্থাকে বর্জন কোরেছেন তিনি বা তারা মুসলিম(Muslim)। এখানেও একজন মুসলিম(Muslim) হোয়েও মো'মেন নাও হতে পারেন। যেমন- কোথাও দেশসুদ্ধ সকলে মুসলিম(Muslim) হোয়ে গেলো। সেখানে একজন বা কিছুসংখ্যক মোশরেক বা নাস্তিক নানা রকম সামাজিক অসুবিধার কথা চিন্তা কোরে মুসলিম(Muslim) হোয়ে গেলো, অর্থাৎ আল্লাহ(Allah), রাসুল (দঃ) ও ইসলাম(Islam)কে পূর্ণভাবে বিশ্বাস না কোরেও সমাজের অন্য সবার সাথে আল্লাহ(Allah)র আইন ও দ্বীন স্বীকার ও তসলিম কোরে নিলো। এ লোক মুসলিম(Muslim), কিন্তু মো'মেন নয়। এর উদাহরণ দেওয়া যায় ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই। নবী করীমের (দঃ) ওফাতের আগেই সম্পূর্ণ আরব মুসলিম(Muslim) হোয়ে গিয়েছিলো এটা ইতিহাস। কিন্তু আল্লাহ(Allah) নবীকে (দঃ) সম্বোধন কোরে বোলেছেন-"আরবরা বলে, আমরা বিশ্বাস করেছি (ঈমান এনেছি)। বল, তোমরা বিশ্বাস করনি। বরং বল, আমরা শুধু আত্মসমর্পণ কোরেছি। কারণ বিশ্বাস (ঈমান) তোমাদের আত্মায় প্রবেশ করেনি।"

এর ঠিক পরের আয়াতেই আল্লাহ(Allah) প্রকৃত মো'মেন কে, তা আমাদের বোলে দিচ্ছেন। আল্লাহ(Allah) বোলেছেন-"শুধু তারাই মো'মেন যারা আল্লাহ(Allah) ও তাঁর রসুলকে বিশ্বাস করে, তারপর আর (সে সম্বন্ধে) কোন সন্দেহ পোষণ করেনা এবং তাদের সম্পদ (টাকা-পয়সা ও সম্পত্তি) ও প্রাণ দিয়ে আল্লাহ(Allah)র রাস্তায় জেহাদ করে। (শুধু) এরাই হলো অকপট সত্য (কোরান- সূরা আল হুজরাত-১৪, ১৫)। অর্থাৎ মো'মেন হোতে হোলে এবং আকীদা যদি বিকৃত না হয় তবে অবশ্য অবশ্যই জানমাল দিয়ে আল্লাহ(Allah)র রাস্তায় জেহাদ কোরতে হবে। যে কথাটা আমার এই সমস্ত বইটায় বোলতে চেষ্টা কোরেছি। আল্লাহ(Allah)র কথা যে সত্য তা প্রমাণ হোয়ে গেলো রসুলাল্লাহ (দঃ) এর ওফাতের সঙ্গে সঙ্গেই। চারদিকে বহু লোক ইসলাম(Islam)কে অস্বীকার কোরে বিদ্রোহী হোয়ে উঠলো। অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ ইসলাম(Islam)কে গ্রহণ করার ফলে তারা বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে ইসলাম(Islam)কে স্বীকার কোরে মুসলিম(Muslim) হোয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু সত্যিকার বিশ্বাস তারা করেনি, তারা মুসলিম(Muslim) হোয়েছিলো- কিন্তু মো'মেন হয়নি।

মো'মেন ও মুসলিম(Muslim) যে এক নয় তা হাদীস থেকেও দেখাচ্ছি। সা'দ (রাঃ) বোলছেন- একবার আমি রসুলুল্লাহর (দঃ) কাছে বসা ছিলাম- যখন তিনি একদল লোককে দান কোরছিলেন। সেখানে এমন একজন লোক বসা ছিলেন যাকে আমি একজন উত্তম মো'মেন বোলে বিশ্বাস কোরতাম। কিন্তু তিনি (নবী করিম দঃ)তাঁকে কিছুই দিলেন না। এ দেখে আমি বোললাম ইয়া রসুলুল্লাহর (দঃ) আপনি ওনাকে কিছু দিলেন না? আমার দৃঢ় বিশ্বাস উনি একজন মো'মেন। রসুলুল্লাহর (দঃ) বোললেন মো'মেন বোলোনা মুসলিম(Muslim) বলো। আমি কিছু সময় চুপ থেকে আবার ঐ কথা বোললাম এবং তিনিও আবার ঐ জবাবই দিলেন-মো'মেন বোলোনা, মুসলিম(Muslim) বলো। তৃতীয়বার আমি ঐ কথা বোললে রসুলুল্লাহর (দঃ) বোললেন- সা'দ! আমি অপছন্দনীয় লোকদেরও দান করি এই কারণে যে আমার আশংকা হয় তারা অভাবের চাপে জাহান্নামের পথে চলে যেতে পারে।"(হাদীস- বোখারী) এখানে মহানবীর (দঃ) কথা থেকেই পরিষ্কার হোয়ে যাচ্ছে যে মো'মেন ও মুসলিম(Muslim) এক নয়।

এই হাদীসের আরেকটি চিত্তাকর্ষক দিক আছে। সা'দ (রাঃ) যার জন্য সুপারিশ কোরছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি যোয়াইল (রাঃ) যার সম্বন্ধে মহানবী (দঃ) স্বয়ং বিভিন্ন সময়ে প্রশংসা কোরেছেন। অর্থাৎ সা'দ (দঃ) ঠিকই বোলেছিলেন যে তিনি উত্তম মো'মেন। আসল কথা, বিশ্বনবী (দঃ) সেদিন দান কোরছিলেন মুসলিম(Muslim)দের- মো'মেনদের নয়, তাই তিনি সেদিনের দানে যোয়াইল (রাঃ)কে অন্তর্ভূক্ত করেননি এবং সা'দ (রাঃ) যখন তাকেও দান কোরতে অনুরোধ কোরলেন তখন তিনি (দঃ) সা'দ (রাঃ)কে বোললেন মো'মেন বোলোনা, মুসলিম(Muslim) বলো। অর্থাৎ আজকের দান নিতে হোলে যোয়াইল (রাঃ)কে মুসলিম(Muslim) হিসাবে নিতে হবে। এ ছাড়াও আল্লাহ(Allah) কোরানের বহু জায়গায় মো'মেনদের এবং মুসলিম(Muslim)দের আলাদা আলাদা ভাবে সম্বোধন কোরেছেন।

তৃতীয়তঃ উম্মতে মোহাম্মদী। এ সম্বন্ধে পেছনে বোলে এসেছি। আল্লাহ(Allah) আদম (আঃ) থেকে শুরু কোরে তার প্রত্যেক নবী-রসুল (আঃ)কে পাঠিয়েছেন একটিমাত্র উদ্দেশ্য দিয়ে তাহলো যার যার জাতির মধ্যে আল্লাহ(Allah)র তাওহীদ ও তার দেওয়া জীবন ব্যবস্থা দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। শেষ নবীকে (দঃ) পাঠালেন সমস্ত মানব জাতির ওপর এই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য (কোরান-সূরা আল-ফাতাহ-২৮, সূরা আত-তওবা-৩৩, সূরা আস-সফ্-৯) পূর্ববর্তী নবীদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তারা অনেকেই তাদের জীবনেই পূর্ণ কোরে যেতে পেরেছিলেন, কারণ তাদের দায়িত্বের পরিসীমা ছিলো ছোট। কিন্তু এই শেষ জনের (দঃ) দায়িত্ব হলো এত বিরাট যে এক জীবনে তা পূর্ণ কোরে যাওয়া অসম্ভব। অথচ যতদিন ঐ দায়িত্ব পূর্ণ করা না হবে ততদিন তার ওপর আল্লাহ(Allah)র দেওয়া দায়িত্ব অপূর্ণ-অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাই তিনি (দঃ) এমন একটি জাতি সৃষ্টি কোরলেন, পৃথিবী থেকে তাঁর চলে যাওয়ার পরও যে জাতি তার ওপর আল্লাহ(Allah)র দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য তারই মত সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই জাতি হলো তার উম্মাহ-উম্মতে মোহাম্মদী- মোহাম্মদের জাতি। বিশ্বনবী (দঃ) তার উম্মাহকে পরিষ্কার কোরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তার চলে যাবার পর তিনি যেমন কোরে সংগ্রাম কোরে সমস্ত আরবে দ্বীন প্রতিষ্ঠা কোরলেন, ঠিক তেমনি কোরে বাকি দুনিয়ায় ঐ দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত হবে। ঐটাকে তিনি বোললেন ‘আমার সুন্নাহ'; অর্থাৎ আমি সারা জীবন যা কোরে গেলাম। এবং এও বোললেন যে, যে আমার এই সুন্নাহ ত্যাগ কোরবে সে বা তারা আমার কেউ নয়; অর্থাৎ আমার উম্মত নয়। অবশ্যই, কারণ আল্লাহ(Allah) যে দায়িত্ব দিয়ে তাকে পৃথিবীতে পাঠালেন, যে দায়িত্ব তিনি এক জীবনে পূর্ণ কোরতে না পারায় এক উম্মাহ সৃষ্টি কোরে তার ওপর অর্পন কোরে চোলে গেলেন, সেই দায়িত্ব যে বা যারা ছেড়ে দেবে-ত্যাগ কোরবে, তারা নিশ্চয়ই তার কেউ নয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম যিনি বিশ্বনবীকে (দঃ) প্রেরিত বোলে স্বীকার কোরে এই দ্বীনে প্রবেশ কোরলেন; অর্থাৎ আবু বকর (রাঃ) মুসলিম(Muslim) হোয়েই রসুলাল্লাহকে (দঃ) জিজ্ঞাসা কোরলেন- "হে আল্লাহ(Allah)র রসুল! এখন আমার কাজ কি? কর্তব্য কি?" আল্লাহ(Allah)র শেষ নবী (দঃ) যে উত্তর দিয়েছিলেন তা আমরা ইতিহাসে ও হাদীসে পাই। তিনি বোললেন, "এখন থেকে আমার যে কাজ তোমারও সেই কাজ।" কোন সন্দেহ নেই যে যদি প্রত্যেকটি মানুষ-যারা ঈমান এনে মহানবীর (দঃ) হাতে মুসলিম(Muslim) হোয়েছিলেন তারা আবু বকরের (রাঃ) মত- যদি ঐ প্রশ্ন কোরতেন তবে তিনি (দঃ) প্রত্যেককেই ঐ জবাব একই দিতেন। "আমার যে কাজ" বোলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন? তাঁর (দঃ) কী কাজ ছিলো? তাঁর কাজ তো মাত্র একটা, যে কাজ আল্লাহ(Allah) তার ওপর অর্পণ কোরেছেন। সেটা হলো সমস্ত রকমের জীবন-ব্যবস্থা ‘দ্বীন' পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন কোরে দিয়ে এই শেষ দ্বীনকে মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসে পাচ্ছি, শেষ-ইসলাম(Islam)কে গ্রহণ করার দিনটি থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্য্যন্ত আবু বকরের (রাঃ) কাজ একটাই হোয়ে গিয়েছিলো। সেটা ছিলো মহানবীর (দঃ) সংগ্রামে তাঁর সাথে থেকে তাঁকে সাহায্য করা। শুধু আবু বকর নয়, যে বা যারা নবীকে (দঃ) বিশ্বাস কোরে মুসলিম(Muslim) হোয়েছেন সেই মুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্য্যন্ত তিনি বা তারা বিশ্বনবীকে (দঃ) তাঁর ঐ সংগ্রামে সাহায্য কোরে গেছেন, তাঁর সুন্নাহ পালন কোরে গেছেন। আর কেমন সে সাহায্য! স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ত্যাগ কোরে, বাড়ী-ঘর-সম্পত্তি-ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ কোরে, অর্দ্ধাহারে-অনাহারে থেকে, নির্মম অত্যাচার সহ্য কোরে, অভিযানে বের হোয়ে গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে এবং শেষ পর্য্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন দিয়ে। এই হলো তার উম্মাহ, উম্মতে মোহাম্মদী তাঁর প্রকৃত সুন্নাহ পালনকারী জাতি।

উম্মতে মোহাম্মদীর যে অর্থ বোললাম, আবু বকর (রাঃ) সহ সমস্ত সাহাবারা যে সেই অর্থেই বুঝেছিলেন; বিশ্বনবী (দঃ) যে সেই অর্থেই তাদের বুঝিয়েছিলেন তার অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে রসুলাল্লাহর (দঃ) পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ৬০/৭০ বৎসর পর্য্যন্ত তাঁর উম্মাহর কার্য্যাবলী। এ ইতিহাস অস্বীকার করার কারো উপায় নেই যে নবী করিমের (দঃ) পর তাঁর ঐ উম্মাহ বৃহত্তর ক্ষেত্রে অর্থাৎ আরবের বাইরে তাঁর ঐ সংগ্রাম ছড়িয়ে দিলো এবং পৃথিবীর একটা বিরাট অংশে এই দ্বীন প্রতিষ্ঠা করলো। আমি উম্মতে মোহাম্মদীর যে অর্থ-সংজ্ঞা কোরছি তা যদি ভুল হোয়ে থাকে তবে ঐ উম্মাহর ঐ কাজের আর মাত্র দু'টি অর্থ হোতে পারে। সে দু'টি হোচ্ছে- ক) অস্ত্রের জোরে পৃথিবীর মানুষকে ধর্মান্তরিত করা। এটা হোয়ে থাকলে আল্লার বাণী- "বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা নিষিদ্ধ"(কোরান- সূরা আল-বাকারা-২৫৬) এর অর্থ আল্লাহ(Allah)র নবীও (দঃ) বোঝেননি, তাঁর সাহাবীরাও বোঝেননি বা অস্বীকার করেছেন (নাউযুবিল্লাহ)। আর তা হোলে অন্ততঃ ঐ সময়ের জন্য আটলান্টিকের তীর থেকে চীনের সীমান্ত আর উরাল পর্বত থেকে ভারত মহাসাগর এই ভূখণ্ডে একটাও অমুসলিম(Muslim) থাকতো না। কিন্তু ইতিহাস তা নয়। খ) পর-রাজ্য পর-সম্পদ লোভে আলেকজাণ্ডার, তৈমুর, হালাকু ইত্যাদির মত সাম্রাজ্য বিস্তার। যদি তা হোয়ে থাকে তবে মোহাম্মদ (দঃ) অবশ্যই আল্লাহ(Allah)র রসুল ছিলেন না (নাউযুবিল্লাহ)। তৃতীয় এমন কোন কারণ হোতে পারে না যেজন্য একটি দেশের প্রতিটি যুদ্ধক্ষম ব্যক্তি তার পার্থিব সব কিছু কোরবান কোরে বছরের পর বছর একটানা যুদ্ধ কোরে যেতে পারে। রসুলুল্লাহ (দঃ) বোলেছেন, "যে বা যারা আমার সুন্নাহ ত্যাগ কোরবে তারা আমাদের কেউ নয়।" যে বা যারা রসুলুল্লাহর কেউ নয় সে বা তারা কি তাঁর উম্মাহ, ‘উম্মতে মোহাম্মদী'? সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়- অবশ্যই নয়। অর্থাৎ তাঁর (দঃ) সুন্নাহ ও তাঁর উম্মাহ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটা ছাড়া আরেকটা নেই। আল্লাহ(Allah) তাঁর নবীর (দঃ) ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ কোরেছিলেন; শুধু দায়িত্ব অর্পণ কোরেছিলেন তাই নয়, যে কাজটা কোরতে তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, যে কাজ তিনি দায়িত্ব পাবার মুহূর্ত থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্য্যন্ত কোরে গেলেন- অর্থাৎ সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এই জীবন ব্যবস্থা, এই শেষ দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা- এটাই হলো তাঁর প্রকৃত সুন্নাহ। এই সুন্নাহ ত্যাগকারীদের সম্বন্ধেই তিনি বোলেছিলেন ‘তারা আমার নয়'। তার ব্যক্তি জীবনের ছোটখাট, কম প্রয়োজনীয় অভ্যাসের সুন্নাহ বোঝাননি। একটা গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উল্লেখ কোরছি। তিনি (দঃ) বোলেছেন-"এমন সময় আসবে যখন আমার উম্মাহ প্রতিটি ব্যাপারে বনি ইসরাইলকে নকল কোরবে। এমনকি তারা যদি তাদের মায়ের সাথে প্রকাশ্যে ব্যাভিচার করে তবে আমার উম্মাহ থেকেও তাই করা হবে। বনি ইসরাইলরা বাহাত্তর ফেরকায় (ভাগে) বিভক্ত হোয়েছিল, আমার উম্মাহ তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। এর একটি ভাগ ছাড়া বাকি সবই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।" সাহাবারা প্রশ্ন কোরলেন-"ইয়া রসুলাল্লাহ! সেই এক ফেরকা কোনটি?" তিনি (দঃ) জবাব দিলেন-"যার ওপর আমি ও আমার সঙ্গীরা (আসহাব) আছি" (হাদীস- আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে- তিরমিযি, মেশকাত)। এই হাদীসটির কয়েকটি অংশ আছে। আমরা একটা একটা কোরে বুঝে নিতে চেষ্টা করবো। প্রথম কথা হলো- প্রথমেই যে তিনি ‘আমার উম্মাহ' বোলে শুরু কোরলেন তাতে তিনি তাঁর প্রকৃত উম্মাহ বোঝাননি। পেছনে যেমন বোলে এসেছি অন্য জাতিগুলি থেকে আলাদা কোরে বোঝাবার জন্য অর্থাৎ In general sense দ্বিতীয়তঃ বনি ইসরাইল বোলতে তিনি বর্তমানে ইহুদী-খ্রীস্টান (Judio-Christian Civilisation) সভ্যতা বুঝিয়েছেন। ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা' শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে খ্রীস্টান ইউরোপ ও আমেরিকার কথাই মনে আসে। কিন্তু আসলে এরা গোড়া ইহুদী। ঈসা (আঃ) খাঁটি ইহুদী বংশে জন্মেছিলেন, নিজে ইহুদী ছিলেন, তাঁর প্রত্যেকটি শিষ্য ইহুদী ছিলেন, ইহুদীদের বাইরে তাঁর শিক্ষা প্রচার করা তাঁরই নিষেধ ছিলো। অর্থাৎ মুসার (আঃ) দ্বীনকে তাঁর ধর্মের আলেম-যাজকরা বিকৃত, ভারসাম্যহীন কোরে ফেলায় সেটাকে আবার ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনাই ছিল তাঁর কাজ, নতুন কোন ধর্ম সৃষ্টি করা নয়। কিন্তু সেটাকে কেমন কোরে একটা নতুন ধর্মের রূপ দেওয়া হোয়েছিলো তা পেছনে বোলে এসেছি। কাজেই বিশ্বনবী (দঃ) এখানে আলাদা কোরে খ্রীস্টান না বোলে একেবারে গোড়ায় ধোরে শুধু ইহুদী বোলছেন, কিন্তু বোঝাচ্ছেন আজকের এই জুডিও খ্রীস্টান সভ্যতা। তিনি বোলছেন আমার উম্মাহ ঐ ইহুদী-খ্রীস্টান অর্থাৎ বর্তমানের পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নকল-অনুকরণ কোরতে কোরতে হীনমন্যতার এক বীভৎস পর্য্যায় পর্য্যন্ত যাবে। আজ নিজের জাতিটির দিকে চেয়ে দেখুন- যেটাকে সবাই বিনা দ্বিধায় উম্মতে মোহাম্মদী বোলে বিশ্বাস করে- এ জাতির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শিক্ষা, আইন-দণ্ডবিধি ইত্যাদি প্রত্যেকটি জিনিস ঐ ইহুদী-খ্রীস্টানদের নকল-অনুকরণ। এ সমস্ত ব্যাপার থেকে আল্লাহ(Allah)র দ্বীন ও তাঁর আদেশ সম্পুর্ণভাবে বাদ দেয়া হোয়েছে। যে উম্মাহটাকে সৃষ্টিই করা হোয়েছে ঐগুলি নিস্ক্রীয়-অকেজো কোরে দিয়ে বিশ্বনবীর (দঃ) মাধ্যমে দেওয়া দ্বীনকে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করার জন্য, সেই উম্মাহই যদি নিজেরটা ত্যাগ করে ঐগুলিই গ্রহণ ও নিজেদের ওপর প্রতিষ্ঠা করে তবে সেই উম্মাহকে ‘উম্মতে মোহাম্মদী' বলার চেয়ে হাস্যকর ও অসত্য আর কী হোতে পারে?

দ্বিতীয় কথা হলো রসুলাল্লাহ (দঃ) বোলেছেন- বনি ইসরাইল বাহাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হোয়ে গিয়েছিলো, আমার উম্মাহ তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে, এবং মাত্র একটি ফেরকা (যেটা জান্নাতী) বাদে সবগুলি ফেরকাই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। অতি স্বাভাবিক কথা। কারণ যে ঐক্য ছাড়া পৃথিবীতে কোন কাজই করা সম্ভব নয়, কাজেই যে ঐক্যকে অটুট রাখার জন্য আল্লাহ(Allah) সরাসরি হুকুম কোরলেন-"আমার দেওয়া দ্বীন সকলে একত্রে ধোরে রাখো এবং নিজেরা বিচ্ছিন্ন হোয়োনা"(কোরান- সূরা আলে ইমরান-১০৩); যে ঐক্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মহানবী (দঃ) বোললেন, "কোরআনে কোন আয়াতের অর্থ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কুফর"[হাদীস- আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে- মুসলিম(Muslim), মেশকাত]; যে ঐক্য ও শৃংখলা সুদৃঢ় করার জন্য বোললেন-"কান কাটা নিগ্রো ক্রীতদাসও যদি তোমাদের নেতা হয় তাহোলেও ঐক্যবদ্ধভাবে তার আদেশ নির্দেশ পালন কর"[হাদীস- ইরবাদ বিন সারিয়াহ (রাঃ) থেকে আহমদ, আবু দাউদ তিরমিযি এবং ইবনে মাজাহ, মেশকাত]; (এই ঐক্য অটুট রাখার জন্য আল্লাহ(Allah) ও তাঁর রসুল(দঃ) কতভাবে চেষ্টা কোরেছেন তা কোরান এবং হাদীস থেকে দেখাতে গেলে আলাদা বই হোয়ে যাবে।) সেই ঐক্যকে যারা ভেংগে তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হোয়ে যাবে- তারা আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে না তো কোথায় নিক্ষিপ্ত হবে? জান্নাতে?

তৃতীয় কথা হলো যে একটি মাত্র ফেরকা (ভাগ) জান্নাতী হবে- যেটার কথা রসুলাল্লাহ (দঃ) বোলেছেন- সেটা সেই কাজ নিয়ে থাকবে যে কাজের ওপর তিনি ও তাঁর আসহাব ছিলেন। তিনি (দঃ) ও তাঁর আসহাব (রাঃ) কিসের ওপর- কোন কাজের ওপর ছিলেন? সেই মহাজীবনী যারা পড়েছেন, তাঁর (দঃ) সাহাবাদের ইতিহাস যারা পড়েছেন-তাদের এ কথা স্বীকার করা ছাড়া কোন পথ নেই যে, নবুয়াত পাওয়ার সময় থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্য্যন্ত এই অতুলনীয় মানুষটির একটিমাত্র কাজ ছিলো। সেটা হলো এই শেষ জীবন-ব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরে মানুষের জীবনে ন্যায়-শান্তি আনা। এবং তার জীবিত অবস্থায় ও তাঁর ওফাতের পরে তাঁর সঙ্গীদেরও (আসহাব) জীবন ঐ একই কাজে ব্যয় হোয়েছে। অর্থাৎ নেতা ও তার জাতির সম্পূর্ণ জীবন কেটেছে মানব জাতির কল্যানের জন্য। যে কল্যাণের একটিমাত্র পথ-মানবের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ(Allah)র দেওয়া জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা, এক কথায় আল্লাহ(Allah)কে দেওয়া ইবলিসের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আল্লাহ(Allah)কে জয়ী কোরে সমস্ত মানব জাতিকে অন্যায়-অবিচার-অশান্তি-যুদ্ধ ও রক্তপাত থেকে উদ্ধার কোরে পরিপূর্ণ শান্তি, ইসলাম(Islam) প্রতিষ্ঠা করা। যে বা যারা এই সংগ্রাম কোরবে শুধু তারাই রসুলাল্লাহর (দঃ) সুন্নাহ পালনকারী, অর্থাৎ যার ওপর আল্লাহ(Allah)র রসুল(দঃ) ও তার আসহাব (রাঃ) ছিলেন। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য কোরলে দেখা যাবে বিশ্বনবীর (দঃ) ঐ সঙ্গীরা (আসহাব) তাঁর ওফাতের পর তাদের নেতার ওপর আল্লাহ(Allah)র অর্পিত কাজ একাগ্রচিত্তে চালিয়ে গেলেন, পার্থিব সমস্ত কিছু উৎসর্গ কোরে চালিয়ে গেলেন। কারণ তাদের কাছে ঐ কাজ ছিলো বিশ্বনবীর (দঃ) সুন্নাহ। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য কোরলে আরও দেখা যায় যে, বিশ্বনবীর (দঃ) সংসর্গ যারা লাভ কোরেছিলেন; সরাসরি তাঁর কাছ থেকে এই দ্বীন শিক্ষা কোরেছিলেন; এই দ্বীনের উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া শিক্ষা কোরেছিলেন তারা তাঁর(দঃ) ওফাতের পর ৬০/৭০ বছর পর্য্যন্ত বেঁচেছিলেন। এবং ঐ ৬০/৭০ বছর পর বিশ্বনবীর (দঃ) সাক্ষাত-সঙ্গীরা (রাঃ) শেষ হোয়ে যাবার পরই পৃথিবীতে এই দ্বীন প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ হোয়ে গিয়েছিলো। এই সংগ্রাম যেই মুহূর্তে বন্ধ হলো জাতি হিসাবে ত্যাগ করা হলো সেই মুহূর্ত থেকে জাতি হিসাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী শেষ হোয়ে গেলো। সেই জন্য মহানবী (দঃ) তাঁর সুন্নাহ বোলতে শুধু তাঁর নিজের সুন্নাহ বোললেন না। বোললেন- "আমি ও আমার সঙ্গীরা যার ওপর আছি।" এবং অন্য সময় এও বোললেন যে "আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০বছর।"

এই সংগ্রাম-জেহাদ ত্যাগ কোরে অর্থাৎ আল্লাহ(Allah)র রসুলের (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ ত্যাগ কোরে এই জাতি যখন শান-শওকতের সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য রাজতন্ত্রের মত রাজত্ব কোরতে শুরু করলো তখন এক সমস্যা দেখা দিলো। সেটা হলো এই জাতি তার নেতার সুন্নাহ পালন কোরবে কেমন কোরে? প্রকৃত সুন্নাত ত্যাগ করা হোয়েছে অথচ সুন্নাহ ছাড়া চলবেও না। কারণ আল্লাহ(Allah)র রাসুল বোলেছেন, "তার সুন্নাহ ত্যাগ করা অর্থই উম্মতে মোহাম্মদী থেকে বহিষ্কার হওয়া।" এই সমস্যা থেকে জাতিকে উদ্ধার কোরলেন সেই অতি বিশ্লেষণকারী পণ্ডিত শ্রেণী, ফকীহ- মুফাসসির ইত্যাদি। সেটা হলো আসল সুন্নাহ যখন বর্জনই করা হোয়েছে তখন নকলটাই করা যাক। তখন সুন্নাহ হিসাবে নেয়া আরম্ভ হলো বিশ্বনবীর (দঃ) ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলি যে গুলির সাথে তাঁর জীবনের মুখ্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কোন সম্পর্ক নেই। তাঁর খাওয়া-শোয়া-ওঠা-বসা ইত্যাদি নেহায়েত ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার। তাঁর (দঃ) সুন্নাহ বোলতে তিনি কখনই এগুলি বোঝাননি, বোঝালেও ওগুলো পালন না করার জন্য তার উম্মাহ থেকে বহিষ্কার অবশ্যই বোঝাননি। কারণ যে কাজের জন্য তাঁকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিলো অর্থাৎ ‘সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া যে পর্য্যন্ত না সমস্ত পৃথিবীর মানুষ আল্লাহ(Allah) ছাড়া কারো বিধান মানিনা এবং মোহাম্মদ (দঃ) আল্লাহ(Allah)র প্রেরিত একথা বিশ্বাস না করে- নামায কায়েম না করে, যাকাত না দেয় [হাদীস- আবদুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে বোখারী, মেশকাত] ঐ কাজের সাথে ঐ সংগ্রামের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত অভ্যাস-পছন্দ-অপছন্দের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু ঐ সমাধানই গ্রহণ করা হলো এবং আজ পর্য্যন্ত এ হাস্যকর সমাধানই এই জাতি অতি নিষ্ঠার সাথে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পালন করার চেষ্টা কোরছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের ধার্মিকরা যেমন প্রত্যেকে ভাবেন যে ‘একমাত্র আমার ধর্মই ঠিক, বাকিরা সব বিপথগাম, নরকে যাবে' ঠিক তেমনি ভাবে তিয়াত্তর ফেরকার মধ্যে বাহাত্তর ফেরকার প্রত্যেকটি মানুষ অতি নিশ্চিত যে শুধু ঐ ফেরকাই রসুলাল্লাহর (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ পালনকারী এবং সুতরাং সে-ই নির্দিষ্ট জান্নাতী ফেরকা। তারাই যে নবীর (দঃ) সুন্নাহ পালনকারী তাতে মানুষের যাতে কোন সন্দেহ না থাকে এজন্য অনেক ফেরকা তাদের ফেরকার নামেই সুন্নাহ শব্দটা যোগ কোরে রেখেছেন; অর্থাৎ একমাত্র আমরাই সুন্নাহ পালনকারী সেই জান্নাতী ফেরকা। তারা একথা বুঝতে অসমর্থ যে বিশ্বনবী (দঃ) তাঁর সুন্নাহ বোলতে যা বুঝিয়েছিলেন তার ধারে কাছেও তারা নেই। আসল জান্নাতী ফেরকার সুন্নাহর সাথে বাকি বাহাত্তর ফেরকার সুন্নাহর আসমান-যমিন তফাৎ। বাহাত্তর ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো দাঁত মেসওয়াক করা; জান্নাতী ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো রসুলাল্লাহ (দঃ) ও আবু ওবায়দার (রাঃ) মত জেহাদে সশস্ত্র সংগ্রামে দাঁত ভেঙ্গে ফেলা। বাহাত্তর ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো নিজেদের ঘরে বা হুজরায় মাথার কাছে তসবিহ রেখে ডান পাশে শোয়া; জান্নাতী ফেরকার কাছে হলো মাথার কাছে অস্ত্র রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে শোয়া। বাহাত্তর ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো টুপি-পাগড়ী পড়া; জান্নাতী ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো শিরস্ত্রাণ পড়া। বাহাত্তর ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো লম্বা জোব্বা পড়া; জান্নাতী ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো যোদ্ধার কাপড় ও বর্ম পড়া। বাহাত্তর ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো খাবার পর মিঠাই খাওয়া; জান্নাতী ফেরকার কাছে সুন্নাহ হলো অনাহারে থেকে পেটে পাথর বেঁধে যুদ্ধ করা। আরও বহু আছে, দরকার নেই। বাহাত্তর ফেরকার সুন্নাহ পালন কোরতে রসুলাল্লাহ (দঃ) ও তাঁর সাহাবাদের (রাঃ) মত কোরবানীর প্রয়োজন হয় না, আহত হোতে হয় না, নিগৃহীত-অপমানিত হোতে হয় না, বিপদের সম্মুখীন হোতে হয় না। কাজেই তারা অতি নিষ্ঠার সাথে ঐ অতি নিরাপদ সুন্নাহগুলি পালন করেন এবং নবীর (দঃ) ও আল্লাহ(Allah)র সন্তুষ্টি আশা করেন। শুধু আশা করেন না, ও সম্বন্ধে তারা অতি নিশ্চিত। যদিও তারা জান্নাতের সুগন্ধ পর্য্যন্ত পাবেন না, কারণ- বিশ্বনবী (দঃ) বোলেছেন তারা না'রী, আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। বাহাত্তর ফেরকা যে সুন্নাহগুলি পালন করেন সেগুলি শুধু বিশ্বনবীর (দঃ) সুন্নাহ নয় সেগুলি লক্ষ কোটি খ্রীস্টান-ইহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধের সুন্নাহও'। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষই দাঁতন (মেসওয়াক) করে, কোটি কোটি অমুসলিম(Muslim) মাথায় টুপি দেয়, পাগড়ী পড়ে, দাড়ী রাখে, মোচ কামিয়ে ফেলে, খাবার পর মিঠাই খায়, ডানপাশে শোয়। এগুলি বাহাত্তর ফেরকার অতি প্রিয় সুন্নাহ। কিন্তু জান্নাতী ফেরকা যে সুন্নাহ পালন করে সে সুন্নাহ একমাত্র বিশ্বনবী (দঃ) ও তাঁর আসহাব ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ পালন করেন না। সেটা হলো শেষ জীবন-ব্যবস্থা দ্বীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অপরিসীম দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম। বিশ্বনবীর (দঃ) পবিত্র দেহে ছিলো যুদ্ধে যখম হওয়ার চিহ্ন, তাঁর আসহাবদের মধ্যে বোধ হয় একটা লোকও খুঁজে পাওয়া যেতোনা যার গায়ে অস্ত্রের আঘাত ছিলোনা, বহু সাহাবী ছিলেন যাদের সমস্ত শরীর অস্ত্রের আঘাতের চিহ্নে ভরপুর ছিলো। ঐ সুন্নাহ হলো সেই একমাত্র জান্নাতী ফেরকার সুন্নাহ। বাকি বাহাত্তর ফেরকার সুন্নতীদের সারা গায়ে সুঁচের দাগও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আল্লাহ(Allah)র দেওয়া জীবন-ব্যবস্থা দ্বীনুল কাইয়্যেমা'কে সমস্ত পৃথিবীতে কার্যকরী কোরে মানব জাতির মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম(জেহাদ) ও সশস্ত্র সংগ্রাম (কিতাল) করার যে সুন্নাহ বিশ্বনবী (দঃ)ও তাঁর সঙ্গীরা (রাঃ) রেখে গেছেন সেই সুন্নাহকে বুঝিয়েছিলেন যখন তিনি বোলেছিলেন যার ওপর আমি ও আমার সঙ্গীরা আছি। এবং এও বোলেছেন যে যারা এই সুন্নাহ ছেড়ে দেবে তারা আমাদের কেউ নয় অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদী নয়। মহানবীর (দঃ) আসহাব যে নিঃসংশয়ে বুঝতে পেরেছিলেন কোনটা তাঁর প্রকৃত সুন্নাহ, তার অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে সেই উম্মতে মোহাম্মদীর ইতিহাস; তা পেছনে বোলে এসেছি। এখন যিনি আল্লাহ(Allah)র রসুলের (দঃ) রেসালতের পর এই জাতির হাল ধোরেছিলেন সেই আবু বকরের (রাঃ) একটা কথা উল্লেখ কোরছি। জাতির খলিফা নির্বাচিত হোয়ে তার প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি বোললেন, "মুসলিম(Muslim)রা! তোমাদের মধ্যে কেউ যেন জেহাদ পরিত্যাগ না করে। কোন জাতি একবার জেহাদ ত্যাগ কোরলে আল্লাহ(Allah) সে জাতিকে অপদস্ত-অপমানিত না কোরে ছাড়েন না"। বিশ্বনবীর (দঃ) ঘনিষ্টতম সঙ্গী (সাহাবা) তার সর্ব রকম বিপদ-আপদে সুখ-দুঃখের চিরসঙ্গী- নবীর (দঃ) জীবিতকালেই যাকে উম্মতে মোহাম্মদীর নামাযে এমামতি করার হুকুম দেওয়া হোয়েছিলো- সেই আবু বকর (রাঃ) কি মহানবীর (দঃ) কাছে থেকে ইসলাম(Islam)-ইসলামের মর্মবাণী-প্রকৃত সুন্নাহ-এসব কি শিক্ষা করেননি? নিশ্চয়ই কোরেছিলেন এবং শুধু আবু বকর (রাঃ) নন, বিশ্বনবীর (দঃ) প্রত্যেক সাক্ষাত-সঙ্গীরা (রাঃ) কোরেছিলেন। আবু বকরের (রাঃ) মত তারাও জানতেন তাদের নেতার প্রকৃত সুন্নাহ কোনটা, তাই তাদের শেষ মানুষটা বেঁচে থাকা পর্য্যন্ত ঐ জেহাদ চালিয়ে গেছেন। আবু বকরের (রাঃ) ঐ সাবধান বাণী কতখানি সত্য ছিলো তা ইতিহাস। যতদিন এই জাতি একাগ্র লক্ষ্যে (হানিফ) ঐ সুন্নাহ অর্থাৎ জেহাদ চালিয়ে গেলো ততদিন আল্লাহ(Allah) স্বয়ং তাদের অভিভাবক হোয়ে তাদের সঙ্গে রোইলেন। তা না থাকলে তাদের ঐ অবিশ্বাস্য বিজয় অসম্ভব ছিলো। তারপর ৬০/৭০ বছর পর যখন এই জাতি ঐ জেহাদ বন্ধ করলো, তখন সংখ্যায় তারা প্রাথমিক অবস্থার চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ বেশী, পৃথিবীর প্রায় অর্দ্ধেক তাদের দখলে। হোলে কি হবে? জেহাদ ছাড়া অর্থ বিশ্ব নবীর (দঃ) সুন্নাহ ছাড়া, অর্থাৎ উম্মতে মোহম্মদী হোতে বহিষ্কার। কারণ তিনি তো বোলেই দিয়েছেন, যে আমার সুন্নাহ ছাড়লো সে আমাদের কেউ নয়। আবু বকর (রাঃ) বোলেছিলেন ‘জেহাদ ছাড়লে আল্লাহ(Allah) অপদস্ত অপমানিত কোরবেন'। দেখা গেলো আবু বকর (রাঃ) অনেক কম বোলেছিলেন। কারণ আল্লাহ(Allah) শুধু অপদস্ত-অপমানিতই কোরলেন না, তিনি শত্রুদের দিয়ে নবীর (দঃ) ব্যক্তিগত অভ্যাসের সুন্নাহ পালনকারী এবং সুতরাং উম্মতে মোহাম্মদীর দাবীদার এই বিরাট জাতিটাকে লাইন কোরে দাঁড় করিয়ে মেশিন গান কোরে, ট্যাংকের তলায় পিষে, জীবন্ত কবর দিয়ে, ফাঁসি দিয়ে, বেয়নেট করে, আগুনে পুড়িয়ে, তাদের মেয়েদের আফ্রিকা আর ইউরোপের বেশ্যালয়ে বিক্রি কোরিয়ে এবং তারপরে তাদের ঘৃণিত ক্রীতদাসে পরিণত কোরে দিলেন। এই সময়ের ইতিহাস পড়লে মনে হয় আল্লাহ(Allah) তাঁর প্রিয় নবীর (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ ত্যাগ করার, দ্বীনের অতি বিশ্লেষণ করে জাতিকে টুকরো টুকরো কোরে দেওয়ার এক বহির্মূখী গতিকে উল্টিয়ে অন্তর্মূখী কোরে দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে শেষ কোরে দেওয়ার শাস্তি দিতে তার গযবের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। সে শাস্তির ইতিহাস পড়লে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়। ভুললে চলবে না যে যখন এই লোমহর্ষক শাস্তি আল্লাহ(Allah) এই জাতিকে দিয়েছিলেন তখন এই জাতির আইন-কানুন-বিচার-দণ্ডবিধি ইত্যাদি সবই কোরান-হাদীস মোতাবেক অর্থাৎ জাতি তখনও উম্মতে মোহাম্মদী না হোলেও মুসলিম(Muslim)। কিন্তু আল্লাহ(Allah) তাও পরোয়া কোরলেন না। আর আজতো তাও নেই, ওগুলোও তো গায়রুল্লাহর মানুষের তৈরী, যেগুলো ধ্বংস কোরে আল্লাহ(Allah)র দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য উম্মতে মোহাম্মদীকে সৃষ্টি করা হোয়েছিলো। এই জাতি সেই কুফর ও শেরককে গ্রহণ কোরেও, সেই মোতাবেক জাতীয় জীবন চালিত কোরেও নবীর (দঃ) কতকগুলি অপ্রয়োজনীয়-নিরাপদ নেহায়েত ব্যক্তিগত অভ্যাসকে অতি নিষ্ঠার সাথে নকল কোরে নিজেকে অতি উৎকৃষ্ট উম্মতে মোহাম্মদী ভাবছে। কী পরিহাস, কী হাস্যকর।

রসুলাল্লাহর (দঃ) প্রকৃত সুন্নাহ অর্থাৎ এই দ্বীনকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দিয়ে তার উম্মাহ থেকে বহিষ্কৃত হওয়া ছাড়াও আরও বহু ক্ষতি হোয়েছে। শুধু তাদের নয়, সমস্ত মানব জাতির মহা ক্ষতি হোয়েছে। কেমন কোরে তা বোলছি। পরিবার পরিজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘর-বাড়ী এমন কি দেশ ত্যাগ কোরে অর্থাৎ ইসলামের সন্ন্যাস (হাদীস- ইসলামে সন্ন্যাস নেই; ইসলামের সন্ন্যাস জেহাদে ও হজ্জে) গ্রহণ কোরে মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে প্রায় অর্দ্ধেক পৃথিবীতে এই শেষ দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার পর যখন এই উম্মাহ তার নেতার সুন্নাহ ছেড়ে দিলো- তখন তারা এমন প্রচণ্ড শক্তিশালী যে তাদের বাঁধা দেবার মত তখন আর কেউ নেই। তখন যদি তারা না থামতেন তবে সমস্ত পৃথিবীতে এই দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হয়ে মানব জাতির জীবন থেকে সমস্ত অন্যায়-অবিচার-অশান্তি-রক্তপাত বন্ধ হোয়ে শান্তি ও নিরাপত্তায় ভরপুর হোয়ে যেতো। তাদের ঐ থেমে যাওয়ার ফলে মানব জাতির মধ্যে যত অশান্তি-অন্যায়-অবিচার-যুদ্ধ-রক্তপাত হোয়েছে, হোচ্ছে ও হবে তার জন্য দায়ী তারা যারা নবীর (দঃ) ঐ প্রকৃত সুন্নাহ পরিত্যাগ কোরেছিলেন। গতিশীলতা (Dynamic) হারিয়ে জাতি যখন স্থবির হোয়ে গেলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাতে জাতি-ধ্বংসকারী বিষ জন্মানো আরম্ভ হলো। পানির স্রোত যতক্ষণ বইতে থাকে, চলমান থাকে ততক্ষণ পানি তাজা থাকে। স্রোত বন্ধ হোয়ে গেলেই পানিতে পচন ধরে বিষ জন্মায়। সুন্নাহ ছেড়ে দিয়ে গতিহীন স্থবির হবার পরই পচন ধরলো, সে পচন হলো দ্বীনের অতি বিশ্লেষণ, যেটার কথা বিশ্বনবী (দঃ) বোলে গিয়েছিলেন-‘অতি বিশ্লেষণ কোরোনা, পূর্ববর্তী উম্মাহগুলির মত ধ্বংস হোয়ে যাবে”। দ্বিতীয় পচন হলো ভারসাম্যহীন বিকৃত সুফীবাদের অনুপ্রবেশ, যেটা ঐ গতিশীলতার ঠিক বিপরীত, যেটা জাতির আকীদা উলটিয়ে পেছন দিকে মুখ কোরে দিলো। বিশ্ব নবীর (দঃ) ওপর আল্লাহ(Allah)র দেয়া দায়িত্বকে যারা মাঝপথে স্তব্ধ কোরে দিয়েছিলেন, তারা আল্লাহ(Allah)র দেওয়া বিশ্বনবীর (দঃ) উপাধি, ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন' কেও পূর্ণ হোতে দেননি; অর্থাৎ তিনি (দঃ) এখনও ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন' হননি। ব্যাখ্যা কোরছি- ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন' শব্দের অর্থ হলো (পৃথিবীর) জাতি সমূহের ওপর (আল্লাহ(Allah)র) রহমত। এখন প্রশ্ন হোচ্ছে আজ পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখুন দেখি। কোথায় সে রহমত? পৃথিবীর সর্বত্র অশান্তি, হাহাকার, অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ রক্তপাত বুক ভাংগা দুঃখ। মানুষের ইতিহাসে বোধহয় একত্রে একই সঙ্গে দুনিয়ার এত অশ্রু, এত অশান্তি কখনো ঘটেনি। নবী করিমের (দঃ) আগেও বোধহয় পৃথিবীর একখানে অশান্তি থাকলে অন্যখানে খানিকটা শান্তি থাকতো। বিজ্ঞানের কল্যাণে আজ পৃথিবী ছোট, আজ একই সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যে রক্তারক্তি-অশান্তি হোচ্ছে তা ইতিহাসে বোধহয় আর কখনো হয়নি।

তর্ক যাদের অভ্যাস তারা হয়ত আমার একথা মানবেন না। বোলবেন এর আগে যে হয়নি সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত হব কেমন কোরে, কারণ অতীতে মানুষ এক জায়গার খবর অন্য জায়গায় পেতো না। ঠিক কথা, মানছি আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু একটা কথায় আমি নিশ্চিত এবং আশা করি ঐ তার্কিকরাও নিশ্চিত হবেন যে, ইতিহাসে ত্রিশ বছরের মধ্যে দুইটি বিশ্বযুদ্ধ কোরে ষোল কোটি মানুষ এবং তারপর থেকে এখন পর্য্যন্ত পাঁচ কোটি মানুষ এত কম সময়ের মধ্যে কখনই হতাহত হয়নি। এত অন্যায়ও মানুষের ইতিহাসে আর কখনো হোয়েছে কিনা সন্দেহ। তার চেয়েও বড় কথা, মানব জাতি আণবিক যুদ্ধ কোরে আজ ধ্বংসের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা আজকের, বর্তমানের। রাসূলাল্লাহর (দঃ) পৃথিবীতে আসার চৌদ্দশ' বছর পর। তাহোলে তিনি কেমন কোরে পৃথিবীর মানুষের জন্য রহমত? এর জবাব হোচ্ছে এই যে, আল্লাহ(Allah) তাকে (দঃ) যে জীবন ব্যবস্থা, দ্বীন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সেই দ্বীন মানব জাতির ওপর সমষ্টিগতভাবে প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা কোরলে যে শান্তি, সুবিচার, নিরাপত্তা মানুষের জীবনে নেমে আসবে সেটা হলো আল্লাহ(Allah)র রহমত, তার দয়া। কারণ তিনি ঐ জীবন ব্যবস্থা না দিলে মানুষ কখনই তা নিজেরা তৈরী কোরে নিতে পারতো না, যদি করতো তবে তা সীমাহীন অশান্তি আর রক্তপাত ডেকে আনতো, যেমন আজ কোরছে। সেই জীবন ব্যবস্থা, দ্বীন, সংবিধান তিনি যার মাধ্যমে মানুষকে দিলেন তাকে তিনি উপাধি দিলেন রহমাতুল্লিল আলামিন। কিন্তু যতদিন না সমগ্র মানব জাতি নিজেদের তৈরী জীবন ব্যবস্থা সমূহ পরিত্যাগ কোরে মোহাম্মদের (দঃ) মাধ্যমে প্রেরিত আল্লাহ(Allah)র দেয়া জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োগ কোরবে ততদিন তারা সেই অশান্তি, অন্যায় (ফাসাদ) ও যুদ্ধ রক্তপাতের (সাফাকু দ্দিমা) মধ্যে ডুবে থাকবে, আজকের মত। এবং ততদিন বিশ্বনবীর (দঃ) ঐ উপাধি অর্থবহ হবেনা, অর্থপূর্ণ হবেনা এবং আজও হয়নি। তার উম্মাহ ব্যর্থ হোয়েছে তার (দঃ) উপাধিকে পরিপূর্ণ অর্থবহ কোরতে। তবে ইনশাল্লাহ সেটা হবে, সময় সামনে। স্রষ্টার দেওয়া উপাধি ব্যর্থ হোতে পারেনা, অসম্ভব। এ ব্যাপারে সম্মুখে আলোচনা করবো।

কার্লমার্কস, কমিউনিজম বোলে একটি জীবন ব্যবস্থা সৃষ্টি কোরেছেন। এটাও একটা দ্বীন এবং অবশ্যই এই আশা নিয়ে যে তার অনুসারীরা একে সমস্ত পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা কোরবে এবং তা কোরতে সর্বরকম সংগ্রাম কোরবে। তার অনুসারীরা তা কোরেছেও। অর্থনৈতিক অবিচার, অন্যায়কে শেষ কোরে সুবিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারা অসীম ত্যাগ, সাধনা, সংগ্রাম, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীর এক বিরাট অংশে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠা কোরেছে। আজ বা ভবিষ্যতে যদি কমিউনিষ্টরা তাদের উদ্দেশ্য ভুলে যেয়ে কার্ল মার্কসের ব্যক্তিগত অভ্যাসগুলিকে অনুকরণ কোরতে থাকে তবে মার্কস কি তাদের অনুসারী কমিউনিষ্ট বোলে স্বীকার কোরবেন? এই প্রশ্নটাই কোরেছিলাম একজন উৎসর্গকৃত প্রাণ যুবক কমিউনিষ্ট কর্মীকে। বোলেছিলাম ‘আচ্ছা বলতো! ভবিষ্যতে কখনো মার্কস কবর থেকে উঠে এসে যদি দেখেন যে, তোমরা কমিউনিজমকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ কোরেছে। শুধু তাই নয়, যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য তিনি সংগ্রাম শুরু কোরেছিলেন সেই পুঁজিবাদকে তোমরা গ্রহণ কোরেছো, তোমাদের সংবিধান বাদ দিয়ে জাতীয় জীবনে পাশ্চত্যের ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কোরেছো, কিন্তু ব্যক্তি জীবনে তোমরা কমিউনিজম বিশ্বাসী, তোমরা মার্কসের মত চুল দাড়ি রাখ, তার মত হ্যাট পড়ো, তার মত কাপড় পড়ো, মার্কস যে কাতে ঘুমাতেন তোমরাও সেই কাতে শোও, যেভাবে দাঁত মাজতেন সেইভাবে মাজ, হাতে কাস্তে হাতুড়ী মার্কা ব্যাজ পড়, সুর কোরে দ্যাস ক্যাপিটাল পড় এবং কে কত সুন্দর সুর কোরে তা পড়তে পারে তার প্রতিযোগিতা করে পুরষ্কার দাও এবং এসব কোরে সত্যি বিশ্বাস কর যে তোমরা অতি উৎকৃষ্ট কমিউনিষ্ট এবং মার্কসের বিশ্বস্ত অনুসারী- তবে মার্কস কি কোরবেন? কমিউনিস্ট কর্মীটি অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, তা কী কোরে সম্ভব? আমাদের কমিউনিস্ট বলেই স্বীকার করবেন না। আমরা যদি পুঁজিবাদী গণতন্ত্রই গ্রহণ করি তবে আমরা আর কমিউনিস্ট রোইলাম কি করে? বললাম, ধোরে নাও না তাই কোরলে, কোরলে মার্কস কি কোরবেন? একটু চিন্তা কোরে সে বললো, আমাদের কমিউনিস্ট বোলেই স্বীকার কোরবেন না। আমাদের গায়ে থুথু দেবেন। অনুরূপ অবস্থায় মহানবী (দঃ) কি কোরবেন তা আমাদের কষ্ট কোরে অনুমান কোরতে হবে না। কারণ সে কথা তিনি (দঃ) আমাদের আগেই বোলে দিয়েছেন। তিনি বোলেছেন, তোমাদের আগে আমি হাউসে পৌছব, আমার সামনে দিয়ে যারা যাবে তারা পানি পান কোরবে এবং যারা পান করবে তারা আর কখনও তৃষ্ণার্ত হবে না। লোকজন যাদের আমি চিনি এবং যারা আমায় চেনে পানি পান করার জন্য আমার কাছে আসবে কিন্তু তাদের ও আমার মধ্যে বাধা-ব্যবধান সৃষ্টি করা হবে। তখন আমি বলবো, এরা তো আমার লোক। বলা হবে, আপনি জানেন না, আপনার পর এরা কি বেদা'ত কোরেছিল। তখন আমি বলবো, দূর হও, দূর হও, যারা আমার পর বেদা'ত কোরেছো [হাদীস সহল বিনসা'দ (রাঃ) থেকে- বুখারী, মুসলীম, মেশকাত-মুসনাদ আহমদ ইত্যাদি]। এই অনেকটা শাব্দিক অনুবাদকে সহজ ভাষায় বোললে এই দাঁড়ায়- আল্লাহ(Allah)র রসুল (দঃ) সবার আগে হাউসে কাওসারে পৌছে যাবেন, তারপর তার উম্মাতের মানুষ তার সামনে দিয়ে যেতে থাকবে আর তিনি (দঃ) তাদের কাওসারের পানি পান করাতে থাকবেন, যে পানি একবার পান কোরলে মানুষ আর কখনও তৃষ্ণার্ত হয় না। এর মধ্যে এমন একদল মানুষ আসবে যারা কাওসারের পানি পান কোরতে অগ্রসর হোলেও রসুলাল্লাহ (দঃ) ও তাদের মধ্যে এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হবে। তখন তিনি বোলবেন, এরাতো আমার লোক অর্থাৎ আমার উম্মত। তখন বলা হবে অর্থাৎ আল্লাহ(Allah) বোলবেন, আপনি জানেন না আপনার পর আপনার উম্মাহর ঐসব লোক আপনি যে দ্বীন রেখে এসেছিলেন তার মধ্যে কি কি বেদা'ত কোরেছে। এই কথা শুনে ব্যাপারটা বুঝে বিশ্বনবী (দঃ) ঐ সমস্ত লোকদের বোলবেন, দূর হও! দূর হও! যারা আমার পর দ্বীনে বেদা'ত কোরেছো। অর্থাৎ মহানবী (দঃ) তার উম্মাহর ঐ লোকদের ভাগিয়ে দেবেন, তাদের কাওসারের পানি পান কোরতে দিবেন না, কারণ তারা বেদা'ত কোরেছিলো। বেদা'ত কি তা অন্যত্র লিখেছি (বে'দাত অধ্যায় দেখুন)। এখানে এইটুকুই লিখবো যে, আল্লাহ(Allah) রসুলের (দঃ) মাধ্যমে যে দ্বীন, জীবন ব্যবস্থা মানব জাতিকে দিয়েছেন তা পরিপূর্ণ, তাতে কোন কিছু নতুন সংযোজন হলো বেদা'ত। এই বেদা'তকে, সংযোজনকে মহানবী (দঃ) শেরক বোলেছেন, কারণ এটা করা মানে আল্লাহ(Allah)র সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা, এবং প্রকারান্তরে বলা যে আল্লাহ(Allah)র দ্বীন পূর্ণ নয়। শুধু নতুন সংযোজনই যদি শেরক হয়, যে শেরক আল্লাহ(Allah) প্রতিজ্ঞা কোরেছেন মাফ কোরবেন না বোলে, তবে শুধু সংযোজন নয়, দ্বীনের সর্বপ্রধান অর্থাৎ জাতীয় ভাগটিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি বর্জন কোরে সেখানে ইউরোপের ইহুদী-খ্রীস্টানদের তৈরী ব্যবস্থা জীবনে প্রয়োগ কোরে রসুলের (দঃ) ব্যক্তিগত সুন্নাহগুলি পালন কোরে যারা নিজেদের উম্মতে মোহাম্মদী বোলে মনে কোরে আত্মপ্রবঞ্চনায় ডুবে আছেন তাদের কি অবস্থা হবে? প্রত্যেক নবীর (আঃ) একটি কোরে হাউস থাকবে এবং তারা প্রত্যেকে যার যার উম্মাহকে কেয়ামতের দিনে তা থেকে পানি পান করাবেন। আমাদের প্রিয় নবীও (দঃ) তার হাউজে কাওসার থেকে তার উম্মাহকে পানি পান করাবেন। আল্লাহ(Allah) যখন নবীকে (দঃ) বেদা'তকারীদের পানি পান করাতে বাধা দেবেন তখন বোঝা গেলো তারা আর নবীর (দঃ) উম্মত নয়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে তারা অবশ্যই তার উম্মত ছিলো, নইলে মহানবী (দঃ) প্রথমে একথা কেন বোলবেন যে, ওরাতো আমার লোক, অর্থাৎ আমার উম্মত। ঐ লোকগুলি আজকের "উম্মতে মোহাম্মদী"। দৃশ্যতঃ এত উৎকৃষ্ট উম্মতে মোহাম্মদী যে আল্লাহ(Allah)র সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল পর্য্যন্ত প্রায় ধোকায় পতিত হবেন। আল্লাহ(Allah) বাধা না দিলে তো কাওসারের পানি পান করিয়েই দিতেন। বিশ্বনবী (দঃ) যখন তাদের ‘দূর হও, দূর হও' বোলে ভাগিয়ে দিবেন তখন অবশ্যই একথা পরিষ্কার যে তার উম্মাহ থেকেই ভাগিয়ে দেবেন। কাপড়ে চোপড়ে, চলাফেরায়, কথাবার্তায়, খাওয়া দাওয়ায়, শোয়ায় তারা উৎকৃষ্ট সুন্নাহ পালনকারী কিন্তু আসলে বেদা'ত ও শেরকে নিমজ্জিত। যাত্রাদলের কাঠের বন্দুক দেখতে একদম বন্দুক, কিন্তু তা থেকে গুলি বের হয়না। এরা নিজেদের ফাঁকি দিচ্ছেন, অন্যকে ফাঁকি দিচ্ছেন এবং কেয়ামতে আর একটু হোলেই একেবারে স্বয়ং নবীকরীম (দঃ) কেই ফাঁকি দিয়ে ফেলেছিলেন আর কি!

মোমেন, মুসলিম(Muslim) ও উম্মতে মোহাম্মদীর যে সংজ্ঞা দিয়ে এলাম এর শেষ কথা এই যে, মোমেন ও মুসলিম(Muslim) আদম (আঃ) থেকে প্রত্যেক নবীর সময়ই ছিলো কিন্তু উম্মতে মোহাম্মদী শুধু শেষ নবীর (দঃ) পর থেকে। এই উম্মাহর একমাত্র সাফায়াতকারী তিনি। তিনি যদি আমাদের তার উম্মাহ বোলে স্বীকার না করেন, দূর হও! দূর হও! বোলে তাড়িয়ে দেন। তবে জাহান্নাম ছাড়া আমাদের আর কোন জায়গা নেই।

কোন মন্তব্য নেই: